নারী শিক্ষার গোড়ার কথা

পাপড়ি বড়ৃয়া | শনিবার , ১২ মার্চ, ২০২২ at ১০:২০ পূর্বাহ্ণ

ঊনিশ শতকে নারীর পুঁথি পাঠকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ পাপ বলত। প্রচলিত ধারণা ছিল যে শিক্ষিত পত্নীর স্বামী নিরক্ষর পত্নীর স্বামীর থেকে তাড়াতাড়ি মারা যায়। ঊনিশ শতকেই নারী শিক্ষার প্রসারে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক উদ্যোগ শুরু হয়। বাংলায় নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রথম ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে বেথুন কলেজ। প্রথমে হিন্দু ফিমেল স্কুল হিসেবে এর কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৪৯ সালের ৭ মে মাসে বিদ্যালয়টির নামকরণ হয় বেথুন স্কুল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। তিনি ১৮৪৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলের আইন উপদেষ্টা হিসেবে ভারতে আসেন। তিনি কাউন্সিল অব এডুকেশনেরও সভাপতি ছিলেন। নারীশিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ভারতীয় নারীর কল্যাণের ইয়ং বেঙ্গল দল সদা মুখর ছিল। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কালীকৃষ্ণ মিত্রর স্মরণে ১৮৪৭ সালে কলকাতার উপকণ্ঠে বারাসতে বালিকাদের জন্য একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন পূর্বতন হিন্দু স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র এবং তখনকার বারাসত গভর্নমেন্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্যারী চরণ সরকার। যার নাম রাখা হয় কালীকৃষ্ণ গার্লস হাই স্কুল। সম্ভবতঃ এই স্কুলটিই বেথুন সাহেবকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল যখন তিনি সেখানে কাউন্সিল অফ এডুকেশনের সভাপতি হিসাবে পরিদর্শনে যান।
কলকাতায় এই ধরনের প্রচেষ্টা এই প্রথম ছিল যা তৎকালীন সমাজে গভীর রেখাপাত করেছিল। বেথুন স্কুলের কর্মকান্ড বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের সমর্থন থাকলেও বৃহত্তর জনসমর্থন লাভে স্কুলটি প্রথমে ব্যর্থ হয়। ১৮৬৮ সালে তদানীন্তন প্রধান শিক্ষিকা মিস পিগট এই স্কুল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন কারণ তিনি খ্রীষ্টান ধর্ম পঠনপাঠনের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন যা ভারতীয় সমাজে ভীতিপ্রদ ঘৃণ্য বিদেশী ধর্ম হিসাবে পরিগণিত ছিল। স্কুলটি প্রথম দিকে বহু দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে চলে যতদিন না স্কুলটি অ্যানেট অ্যাক্রয়েড ও দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীদের মতো কিছু ব্রাহ্ম সমাজীয় লোকেদের পরিচালিত বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিলিত হয়।
বেথুন স্কুল বাঙালি ভদ্রলোকদের চোখ খুলে দিয়েছিল। এর দেখাদেখি আরো অনেক মেয়েদের স্কুল এরপরে খুলতে শুরু করে। তবে ধর্মনিরপেক্ষ স্কুলগুলি খোলার পর আগের যে ধর্মপাঠসর্বস্য স্কুল ছিল সেগুলো উঠে যায়। বেথুন স্কুলটি স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের কট্টর অংশ থেকে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যখন ছাত্রীরা রাস্তা দিয়ে চারপাশে ঢাকা পালকি চড়ে নতুন স্কুলে পড়তে যেত তখন লোকজন অবাক হয়ে তাকাত এবং গালিগালাজ করত। বিখ্যাত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সেসময়কার সমাজচিত্রকে সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন:
‘‘যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে,
এ বি শিখে, বিবি সেজে, বিলাতি বোল কবেই কবে;
আর কিছুদিন থাকরে ভাই! পাবেই পাবে দেখতে পাবে,
আপন হাতে হাঁকিয়ে বগি গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।’’
১৮৩৮ সালের এক সরকারি রিপোর্ট অনুসারে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ১৯টি মেয়েদের স্কুলে প্রায় ৪৫০টি বালিকাকে ভর্তি করা হয়েছিল। তখনও বাংলার সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের এইসব স্কুলে যাবার অনুমতি ছিল না। জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন ভারতে নারী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করলে পন্ডিত মদন মোহন তর্কালঙ্কার, রামগোপাল ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ১৮৪৯ সালের ৭ মে কলকাতার মির্জাপুরে রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের দান করা জমিতে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় নাম পরিবর্তিত হয়ে বেথুন স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। মাত্র একুশ জন ছাত্রী নিয়ে বেথুন স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই স্কুলের কার্যকারী সমিতির প্রথম সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন তার যাবতীয় স্থাবর ও অস্থাবর সমপত্তি এই স্কুলকে দান করেন। কিন্তু ১৮৫১ সালের ১২ আগস্ট বিটন সাহেব মৃত্যুবরণ করলে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসী বেথুন স্কুলের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে কর্নওয়ালিস স্কোয়ারের পশ্চিম দিকের একটি নতুন ভবনে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত করে। এরপরে বেশ কিছু মেধাবী ছাত্রী স্কুলটিতে যোগ দেন যেমন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, সরলা দাস, অবলা দাস যাঁদের সবাই পরবর্তীকালে বিখ্যাত হন।
বেথুন স্কুল থেকে প্রথমবারের মতো মিস কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ১৮৭৯ সালে এন্ট্রাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেথুন স্কুলকে কাদম্বিনী উচ্চশিক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁর স্বীকৃতিতে বেথুন স্কুলকে কলেজের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়। একজন মাত্র ছাত্রী কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে নিয়ে কলেজের পঠন-পাঠন শুরু হয়। কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের গভীর আগ্রহের কারণে সরকার বেথুন স্কুলকে ডিগ্রির সমপর্যায়ে উন্নীত করে। ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী ও তার সাথে চন্দ্রমুখী বসু দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চন্দ্রমুখী বসু ইংরেজিতে অনার্সসহ এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং বেথুন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষা নিযুক্ত হন। ১৮৮৭-১৮৮৮ সালে কলেজ শাখায় এগারো জন ছাত্রী ভর্তি হয়। ১৯২৫ ফজিলতুন্নেসা জোহা বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন। পরবর্তীতে কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান এবং একই সঙ্গে কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বেথুন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের মধ্যে শামসুন্নাহার মাহমুদ আর আখতার ইমাম যিনি পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপিকা ও রোকেয়া হলের প্রভোস্ট হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান নারী ছিলেন যাঁরা নারীশিক্ষার প্রসার ছাড়াও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কামিনী রায়, সরলা দেবী চৌধুরানী, ড.দীপ্তি ত্রিপাঠী, লীলা রায়। আর স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল্যবান অবদান রাখেন বীণা ভৌমিক, মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোগী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা যোশী। ১৮৯০ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে বাইশ জন মহিলা পরীক্ষার্থী বি.এ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পদ্মাবতী স্বর্ণপদক প্রদান করে। অনেক দশক ধরেই বেথুন স্কুলের ছাত্রসংখ্যা অপরিবর্তিত থেকে যায়। এদের অধিংশই ছিল ব্রাহ্ম পরিবারের। ১৮৮৮ সালে বেথুন স্কুলের ১৩৬ জন ছাত্রীর মধ্যে ৮৭ জন ছিল ব্রাহ্ম, ৪৪ জন হিন্দু, এবং ৫ জন ছিল খ্রিষ্টান।
১৯৪০ সালে কলকাতার বিভিন্ন কলেজের ফলাফলের বিবেচনায় বেথুন কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজের পরেই স্থান লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সাময়িকভাবে কলেজের অগ্রগতি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৪৯ সালের মধ্যে কলেজের ছাত্রীসংখ্যা পুনরায় বাড়তে শুরু করে। এখানে অনেক প্রথিতযশা শিক্ষকবৃন্দ যেমন কামিনী রায়, বিখ্যাত দার্শনিক চিত্তহরণ চক্রবর্তী, গোপীনাথ ভট্টাচার্য, কবি কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য ও সুশোভন চন্দ্র সরকার বিভিন্ন সময়ে এ-কলেজে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই খ্যাতনামা শিক্ষার্থী তৈরির ক্ষেত্রে বেথুন কলেজ সাফল্যের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে আসছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে বাংলায় নারীশিক্ষা বিরোধী ভ্রান্ত ধারণাগুলি এভাবে ধীরে ধীরে অপসারিত হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতিন দিনের ব্যবধানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফের আগুন
পরবর্তী নিবন্ধলাল টিপ