লামার চাম্পাতলী মারমা পাড়ায় কিছুক্ষণ

ডেইজী মউদুদ | সোমবার , ৭ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

লামার শৈলশিখরে নির্মিত নয়নাভিরাম রেস্ট হাউস থেকে যখন নামছি তখন ধরতে গেলে ভরদুপুর। লাঞ্চ সেরে আমরা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর লামা পার্বত্য উপজেলার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে বের হই। আমাদের এই ভ্রমণে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো মায়ার চাদরে জড়িয়ে ছিল এলাকার দুজন সাংবাদিক । এদের সাথে পেয়ে ভ্রমণটি পূর্ণতা পায়। এই অঞ্চলটির পুরো এলাকায় যেন অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তদুপরি শ্রাবণের বারিপাতে বিস্তীর্ণ পাহাড়মালা আর বিশাল এলাকাজুড়ে যেন সবুজের মেলা। সবুজে সবুজ আর নীলিমায় নীল আকাশ। গহন বনপথে ঝিকঝাক সড়কে মিরিঞ্জি পাহাড় হয়ে মেঘ বৃষ্টি রোদ আর প্রচন্ড গরমে পড়ন্ত বিকালে যখন মাতামুহুরী ব্রিজে পৌঁছালাম, সূর্য তখন অস্ত যাবার অপেক্ষায়। মাতামুহুরী শুকিয়ে কাঠ! জল একবারেই তলানিতে। জায়গায় জায়গায় চর পড়েছে। মাতামুহুরী ব্রিজে দাঁড়ালে লামার প্রকৃতিক শোভা চোখে ভাসে কোন নিপুণ এক শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মতো। মাতামুহুরীর উৎসস্থল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে, মাতৃস্থানীয় এক দেবীর পর্বত থেকে এই নদীর জন্ম। আবার কেউবা বলেন, মুহুরী মানে অজস্র জলধারা। অজস্র জলপ্রবাহ থেকেই এই নদীর সূচনা। একদা এই পার্বত্য অঞ্চলে যোগাযোগের একমাত্র পথ ছিল মাতামুহুরী নদী। কালের পরিক্রমায় সড়ক ব্যবস্থার উন্নতিতে মাতামুহুরী তার জৌলুস কিছুটা হারিয়েছে বটে, তবে অস্তিত্ব হারায়নি, সে চলছে আপন গতিতে। অন্নপূর্ণা জননী এবং অন্নদাত্রী শস্যমাতা ভূষণা হিসেবে সে প্রবহমান তার স্বকীয়তা নিয়ে। এমন সুন্দর একটি ক্ষণে, দিবারাত্রির পালাবদলের মুহূর্তে তার শীর্ণকায়া দেখে মনটা ভারাক্রান্ত হলো। কখন ঘনঘোর বরিষণ হবে, কখন আমাদের হ্রদ আর নদীগুলো জলে টলটলে হয়ে উঠবে! নদীরা স্রোতের বেগে প্রমত্তা হয়ে ছুটবে আপন গতিতে, দ’ুপাড় ভাঙবে, আবার গড়বে, পলি দিয়ে ভূমিকে উর্বর করবে? সন্ধ্যাটা মাতামুহুরীর বুকে কাটিয়ে আমরা ছুটলাম চাম্পাতলী মারমা পাড়ার উদ্দেশ্যে। একবারেই কাছেই পাড়াটি। লামা পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে পাড়াটির অবস্থান। প্রায় দ’ুএকর জমিতে গড়ে ওঠা এই পাড়ায় আনুমানিক ৬২ টি পরিবার বাস করে। লোক সংখ্যা সর্বমোট ৩৮৫জন।

এই পাড়ায় রয়েছে একটি মাত্র স্কুল, নাম চাম্পাতলী সরকারি প্রাথমিক স্কুল। পাড়ার বেশিরভাগ মানুষ জুমচাষী। হাতে গোণা ৪০ জন সরকারি এবং ২৫ জন চাকরি করে এনজিওতে। সুখের খবর হলো, অবহেলিত এই পাড়ার বাসিন্দা মাধবীলতার ছেলে মিল্টন মারমা বুয়েট থেকে ইঞ্জনিয়ারিং পাস করেন, আবার মইয়েছা মারমার ছেলে বাপ্পী মারমা ডাক্তার হয়েছেন। তাদের অভিনন্দন জানাই। সাবেক লামা উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী এই পাড়ারই। অন্যদিকে মৃত উথুয়াই অং মারমা বান্দরবান পার্বত্য জেলা উন্নয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। পাড়া কারবারি ছাথোয়াই মারমা বলেন, এই পাড়ার দক্ষিণ পাশে রয়েছে ১২ আনসার ব্যটেলিয়নের সদর দপ্তর। দপ্তরে যাতায়াতের রাস্তাটি পাড়ার মাঝখান দিয়ে গেছে। এতে পাড়ার স্বকীয়তা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য বিঘ্নিত হচ্ছে। পাড়ার শিক্ষিতের হার থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ বেকার।

মারমা পাড়ার মূল সমস্যা খাবার জলের। পানীয় জল সংগ্রহ করতে তাদের ছুটতে হয় গিরিখাদে, ঝিরি আর ছড়ায়। বহু কষ্টে জল নিয়ে তারা বাড়ি ফেরে।

মারমা পাড়ায় কেবল মারমারাই থাকেন, তবে উত্তর ও পশ্চিমে বাঙালিদের আলাদা পাড়া রয়েছে। তাদের বাড়িগুলো কাঠ আর বাঁশের তৈরি দ্বিতল মাচা অথবা টিন আর শনের ছাউনি দিয়ে বানানো। সুশৃঙ্খল আর সারিবদ্ধ বাড়িগুলোতে সন্ধ্যা নেমেছে অদ্ভুত নীরবতায়। প্রায় বাড়িতেই ফুলের গাছ রয়েছে। নিজস্ব পোশাকে নারীরা এখানে ব্যস্ত যে যার যার মতো। কোন সোরগোল নেই, সাবলীল ও সহজ এক জীবনযাত্রা তাদের। পদ্মা নদীর মাঝিদের মতো, ‘জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব ও বিষন্ন’ এরপরেও তাদের যাপিত জীবনে নেই কোন বিলাসিতা, নেই অধিক চাওয়া পাওয়ার হাহুতাশ! জীবন এখানে যেন কবির বাণীর মতোই ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি, শুষ্ক হৃদয় লয়ে ,আছে দাঁড়ায়ে, ঊর্ধ্বমুখে নরনারী’ ।

প্রচণ্ড গরমে যখন আলোআঁধারি পরিবেশে পাড়ায় হাঁটছিলাম, একপশলা ঝিরঝির বৃষ্টি এলো। খানিকটা শীতলতার পরশ নিয়ে। প্রবেশমুখেই একটি বৌদ্ধমন্দির। সামান্য এগুতেই পেলাম ঝুপড়ি চায়ের দোকান, দোকানে চা, বিস্কুট, কলা, চিপস, কোমল পানীয় আর পান বিক্রি করছিল মারমা তরুণী এ থুই চিং। দোকানটি তার স্বামী মংমাচিং এর। সুঠাম গড়নের যুবক মংমাচিং ঢাকায় ব্যবসা করতো। করোনাকালে অন্য দশজনের মতো সব হারিয়ে সে নিজবাসভূমে ফিরে এসেছে, ছোট্ট এ দোকানটি করে কোনরকমে দিনাতিপাত করছে। তার কণ্ঠে হতাশার সুর পেলাম। নীরব নিস্তব্ধ কোলাহলমুক্ত আলোআঁধারি এই ঝুপড়িতে এ থুই চিং বিকিকিনি করছে, আর মংমাচিং তার খেদ আর অপ্রাপ্তির দহনে জ্বলছে, আর একের পর এক সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। আমরা কলা, বিস্কুট দিয়ে চা পান করে এ থুই চিং থেকে বিদায় নিয়ে আনসার ব্যাটেলিয়ন দপ্তর ঘুরে আসতেই এক পশলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আমাদের খানিকটা শীতল করলো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই বিদায় নিলাম এই পাড়া থেকে। সন্ধ্যা পেরিয়ে নিকষ কালো আঁধারে রাত নেমে এলো। বিজলিবাতির ক্ষীণ আলোরেখা যতই দূরে যাচ্ছি জোনাকি পোকার মতো জ্বলছিল মিটমিট করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিপ ফোকাস : মৃণাল সেন সংখ্যা
পরবর্তী নিবন্ধওয়ার্ল্ড সুন্নী মুভমেন্ট ডবলমুরিং শাখার সমাবেশ