রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় কমছে ডলারের দাম

রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও আমদানি ব্যয় কমানোসহ প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাতে দূতাবাসগুলোতে নানা উদ্যোগ

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ১৯ আগস্ট, ২০২২ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। বেড়েছে রেমিটেন্স প্রবাহ। গত ১৫ মাসের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে দেশে। অপরদিকে আমদানি হ্রাস এবং রপ্তানি বৃদ্ধিও দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে। বাড়তে শুরু করেছে রিজার্ভের পরিমাণ। রিজার্ভ বাড়ায় খোলাবাজারে ডলারের দাম কমে আসছে। বৈশ্বিক সার্বিক নাজুক পরিস্থিতিতে রেমিটেন্স প্রবাহ এবং রিজার্ভ বৃদ্ধি দেশীয় অর্থনীতির জন্য শুভলক্ষণ বলেও সূত্র মন্তব্য করেছে। সূত্র জানায়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। বাংলাদেশেও দফায় দফায় অবমূল্যায়ন করতে হয় টাকার মান। রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এত কিছুর পরও ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল সরকার। কমে যাচ্ছিল রিজার্ভ। উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা দেখা দেয় সাধারণ মানুষের মাঝে।
ডলার নিয়ে সংকটের সূচনাতেই সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়। এর মধ্যে শুরুতে বিশ্বের ৮৮টি দূতাবাসে বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহ দেয়ার জন্য পত্র দেয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। উক্ত চিঠির প্রেক্ষিতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের উদ্বুদ্ধকরণ, বিদেশে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সৃষ্টির উদ্যোগসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের দূতাবাসগুলো আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠানের। এ ছাড়া বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠানোর প্রমাণ সাথে নিয়ে দূতাবাসে পাসপোর্ট নবায়নসহ নানা কাজে গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা পাওয়ার একটি সার্কুলার জারি করা হয়। বৈধ পথে টাকা পাঠানোর প্রণোদনা আগে থেকেই কার্যকর ছিল। এতে করে প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে বড় ধরণের প্রভাব পড়ে।
গত জুলাই মাসের পর চলতি আগস্টেও প্রবাসীরা প্রচুর রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন। চলতি মাসের ১৮ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১২১ কোটি ৭২ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১১ হাজার ৫৬৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা (প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হিসেবে)। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৭ কোটি ৩১ লাখ ডলার বা ৬৯৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা রেমিট্যান্স আসছে। পুরোটাই বৈধ চ্যানেলে আসা এই রেমিটেন্স বিগত বছরের আগস্ট মাসের প্রথম ১৮ দিনের তুলনায় ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি, যা গত ১৫ মাসের একই সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। ২০২১ আগস্টের প্রথম ১৮ দিনে দেশে ১১৩ কোটি ২৮ লাখ ৭৫ হাজার ডলার রেমিটেন্স এসেছিল বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান। সূত্র জানায়, বিগত বছরের তুলনায় এমনকি চলতি বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। সচরাচর প্রতি মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো রেমিটেন্স আসলেও বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগস্টে রেমিটেন্সের পরিমাণ আড়াই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে বড় ভূূমিকা রাখবে বলে মন্তব্য করে সূত্রটি বলেছে, সাধারণত প্রতিমাসে গড়ে দুই বিলিয়ন ডলারের কম রেমিটেন্স আসে। ঈদের আগে কোনও
কোনও মাসে দুই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু আড়াই বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসা অনেক বড় ব্যাপার। যদি এ ভাবে রেমিটেন্স আসতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে রিজার্ভ নিয়ে কোনো শংকা থাকবে না বলেও সূত্র উল্লেখ করেছে। দেশের রিজার্ভ অচিরেই ৩৭ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এ ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। সরকার বিভিন্ন ধরনের বিলাসদ্রব্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় আমদানি ব্যয় কমেছে। চলতি আগস্টের প্রথম ১১ দিনে দেশে এলসি খোলা হয়েছে ১৬১ কোটি ডলারের। জুলাইয়ের প্রথম ১১ দিনে এলসি খোলা হয়েছিল ২৫৫ কোটি ডলারের। জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টের প্রথম ১১ দিনে এলসি খোলা কমেছে ৯৪ কোটি ডলার। অপরদিকে গত জুলাই মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের। ওই সময়ে রফতানি ও রেমিটেন্স খাতে আয় হয়েছে ৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। সাশ্রয় হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার।
ডলার সাশ্রয়ের পরিমাণ বেড়েছে বলে মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, বেপরোয়া পণ্য আমদানি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি অস্থির করে তুলেছিল। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আমদানি ব্যয় হয় সদ্যসমাপ্ত গত অর্থবছরে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধাক্কা দেয়।
সূত্র বলেছে, দেশে প্রতিমাসে গড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। সরকার রপ্তানি আয় বাড়ানোর নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে বিদেশে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সৃষ্টির মাধ্যমে রপ্তানি আয় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার নানামুখী উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
রপ্তানি আয় বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমানোর ব্যাপারটি দৃশ্যমান। সরকার বিলাসদ্রব্য আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে করে আমদানি ব্যয়ও কমতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ প্রতিমাসে গড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে আসছিল। সরকারি বিধিনিষেধে গত মাসে আমদানি ব্যয় কমে ৫ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ আমদানি ব্যয় ৪ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হবে। চলতি অর্থবছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় সাশ্রয় করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে।
সূত্র বলেছে, সরকারি পদক্ষেপে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় কমে আসতে শুরু করায় রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। কমছে ডলারের দাম। এই দাম আরো কমে টাকার মান বাড়বে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। গতকাল খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১১০ টাকা দরে বিনিময় হয়েছে। এই দর আরো কমে আসবে বলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, সবগুলো সূচকই সন্তোষজনক। রেমিটেন্স বাড়ছে, আমদানি ব্যয় কমেছে, বাড়ছে রপ্তানি আয়। এতে করে ডলারের অস্থিরতা
অচিরেই কমে আসবে। রিজার্ভও সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হবে বলেও মন্তব্য করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধওঝার কাছে নিয়ে ঝাড়ফুঁক, প্রাণ গেলো সাপে কাটা কিশোরীর
পরবর্তী নিবন্ধসেই ৬ ব্যাংকের ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক