রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা এবং অতঃপর

বাংলা ভাষা প্রচলন

ড. ইলু ইলিয়াস | রবিবার , ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১২:০৭ অপরাহ্ণ


বাঙালির আত্মপরিচয় বাংলা ভাষা। তাইতো এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার দুর্বার সংগ্রামে অকাতরে আত্মদান করে বাঙালি- সৃষ্টি হয় বৈশ্বিক ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়, অমর একুশে; অমর একুশের এই রক্ত-উজ্জ্বল দ্রোহের ধারাবাহিকতায় বাঙালি যখন পৌছে যায় স্বাধীন ভাষিক স্বদেশ নির্মাণের দোর গোড়ায় ১৯৭১ – এ, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলা একাডেমীর এক সভায় ঘোষণা দেন, রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই অফিস-আদালত ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চালু করে দেবেন । বছরের বৃত্ত স্পর্শ করার পূর্বেই বীরের রক্তস্রোত আর মায়ের অশ্রুধারা বেয়ে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতা, বিশ্ব মানচিত্রে উদ্ভাসিত হয় বাংলা ভাষার স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ-আত্মপরিচয়ের অপার গৌরবে অভিষিক্ত হয় বাঙালি, বাংলা ভাষা অধিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
উনিশশো বাহাত্তর খ্রিষ্টাব্দের ষোলই ডিসেম্বর প্রকৃত অর্থেই বাঙালির মহা ভাষা উৎসবের দিন; এই দিন প্রবর্তিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান-যা রচিত হয় বাংলা ভাষায় এবং এতে ঘোষণা করা হয় ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ বস্তুত এই দিনেই অবসান ঘটে বাংলা ভাষার ব্রাত্য জীবনের, এই দিনেই উদ্ভাসন ঘটে বাংলা ভাষার প্রদীপ্ত অহংকারের অপার গৌরবের । কিন্তু জনম দুঃখিনী বাংলা ভাষার দুঃখ কি এত সহজে ফুরায় ! ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদানে-বিশ্ব সভায় স্বগৌরবে সম্মানিত হওয়ার পরও যখন তিনি দেখতে পেলেন সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং সেই সাথে তাঁর আকাঙ্ক্ষা ও নির্দেশনা বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে কোনটাই যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে না অর্থাৎ বাংলাদেশে বাংলা ভাষা যথোচিত মর্যাদায় ব্যবহৃত হচ্ছে না, তখন প্রবল ক্রোধে যেন হুঙ্কার ছেড়ে ১২ই মার্চ, ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জারি করেন এক অনন্য পরিপত্র / নির্দেশনা, যাতে উল্লেখিত হয়,“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, স্বাধীনতার তিন বৎসর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে । মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথিতে লিখবেন সেটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেয়া যেতে পারে না।
এ আদেশ জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা সরকারি অফিসসমূহে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোন অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তা ব্যক্তিগণ সতর্কতার সাথে এ আদেশ কার্যকরী করবেন এবং আদেশ লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির বিধান ব্যবস্থা করবেন। তবে কোন বিদেশী সংস্থা বা সরকারের সাথে পত্র-যোগাযোগ করার সময় বাংলার সাথে সাথে ইংরেজি অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষার একটি প্রতিলিপি পাঠানো প্রয়োজন । তেমনিভাবে বিদেশের কোন সরকার বা সংস্থার সাথে চুক্তি-সম্পাদনের সময়ও বাংলার সাথে অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিলিপি ব্যবহার করা চলবে ।
এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকরী হবে ।”
এই কাঠোর নির্দেশনার পর বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে, ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ভাষায় “অধিকাংশ অফিস আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার অনিবার্য হয়ে ওঠে।” কিন্তু সেই সাথে বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে পুনরায় ব্রাত্য জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার যে সংগোপনে ষড়যন্ত্র চলছে তা কি কেউ জানতো! বঙ্গবন্ধুর ঐ ঘোষণার মাত্র পাঁচ মাস তিন দিনের মধ্যেই বদলে গেল বাংলাদেশটাই; পরিবার পরিজনের বহু সদস্যসহ ঘাতকদলের বুলেটবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন জাতির পিতা- বাংলাদেশ অধিকৃত হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী অপশক্তির আগ্রাসনে । এরূপ পরিস্থিতিতে ঘাতক রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ কর্তৃক ২৩শে অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জারি করা হয় বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত এক পরিপত্র, এতে বলা হয় “বাংলা রাষ্ট্রভাষা। পূর্বেই আদেশ দেওয়া হইয়াছে যে সরকারি নথি এবং চিঠিপত্র বাংলায় লেখা হইবে। এই আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্য করা যাইতেছে যে কোন সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধা-সরকারি দফতরসমূহে এখন পর্যন্ত ইংরেজিতে নথি এবং চিঠিপত্র লেখা হইতেছে। ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের এই প্রবণতা একান্তই অনভিপ্রে
অতএব পুনরায় এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে যে, সকল সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধা-সরকারি দফতরসমূহে বাংলায় নথি ও চিঠিপত্র লেখা হইবে। বিদেশের কোন সরকার বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বাংলার সহিত অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিলিপি ব্যবহার করা চলিবে। তবে কোন বিদেশী সরকার বা সংস্থার সহিত পত্র যোগাযোগ ইংরেজি করা হইবে।
এই আদেশ অভিলম্বে কার্যকরী হইবে।” এখানে লক্ষণীয় পরিপত্রের শেষ বাক্যটি-“কোন বিদেশী সরকার বা সংস্থার সহিত পত্র যোগাযোগ ইংরেজিতে করা হইবে।”
বস্তুত এভাবে এই পরিপত্র সাতমাস এগারদিন পূর্বে বঙ্গবন্ধুর জারি করা পরিপত্রের বিপরীত ভাষ্যই/ঘোষণাই প্রদান করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় নভেম্বরে গঠিত হয় ইংরেজি ভাষা শিক্ষা সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সও। অতঃপর ২৮শে ডিসেম্বর ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে জেনারেল রাষ্ট্রপ্রধানের মন্ত্রিপরিষদ মিটিং-এ বাংলা ভাষা প্রচলন সংক্রান্ত গৃহীত সিদ্ধান্তটাই লিখিত হয় ইংরেজি ভাষায়। এবং তা এ রকম-
“(a) The Bengali Language is an integral part of our nationalism and was key element in our struggle for independence. The failure to use and apply the language at all levels of national life is a sad commentary on our declared intentions and sincerity. All work and files concerning the cabinet and the Ministries may be conducted in Bengali from now onwards. Report on command over the mother tongue should be made a part of the ACR of each officer.
Ò(b) Stress should be laid on preparing the coming generation from the very elementary school-level for application and use of Bengali in all activities of life and living. A responsible committee may be formed to ensure preparation of textbooks in simple and lucid Bengali, rather than the difficult language in which many school textbooks have been written. Imposing the use of the language from the top will not bear fruit unless adequate preparation is made at the base level.
Ò(c) The report of the National Education Committee is being awaited pending receipt of which no further committee should be set up. A number of steps have been taken to expand the use of Bengali in practical life. Instructions at College and University level are being given usually in Bengali and the students have an option to appear in the Examination in English also. In the armed services and the police, the world of command has been changed into Bengali. The PSC may conduct the examinations in Bengali which will influence the University and the officers to adopt wider training programmes of Govt. employees may also be conducted in Bengali. With sincerity of purpose, it will not be difficult to use Bengali at all official levels. The language itself will develop and grow in quality with practice. The language must rid itself of the grip of the ‘pundits’ and must reach for the people. That is the way it can be made simple effective and progressive.
Ò(d) We must take lead and sincerely play our role to the best of our ability. Others will follow us. There is no need to fix a target date for the eventual switch-over to Bengali. The work may start now and instead of going for publicity, necessary executive orders may be issued.
(Meeting NO SCM – 48 / 78. Extract from the minutes and decisions of the meeting of the council of Ministers held on December 28, 1978.)
এক জেনারেল যায়, আরেক জেনারেল আসে; গঠিত হয় সচিব কমিটি- বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন সেল; বাংলা ভাষা কমিটি। এই বাংলা ভাষা কমিটি ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে এখানে কিছু বলা বাঞ্ছনীয়।
বাংলা ভাষা কমিটি গঠিত হয় ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে ডিসেম্বর “বাংলাদেশে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিদেশী ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান পরীক্ষা করে রিপোর্ট প্রণয়নের জন্যে।” এবং সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩১শে জানুয়ারি ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত-পরবর্তীতে কমিটির মেয়াদ ৩০শে জানুয়ারি ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন প্রফেসর ডক্টর মনিরুজ্জামান, সদস্য প্রফেসর ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, প্রফসর ড. রফিকুল ইসলাম, ডক্টর আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন এবং সদস্য সচিব ছিলেন প্রফেসর মমতাজ উদ্দীন আহমদ। পাঁচ জনই ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে বিশেষ সম্পর্কে আবদ্ধ-ভাষিক চেতনার তাৎপর্য ও ক্রিয়াশীলতার তথা সৃজন-মননের গুরুত্ব সম্পর্কেও সবিশেষ বিশেষজ্ঞ তাঁদের মধ্যে এখন সশরীরে বর্তমান আছেন কেবল ড. রফিকুল ইসলাম-অধিষ্ঠিত আছেন জাতীয় অধ্যাপকের দায়িত্বে; অন্য চার জন বাঙালি জাতির জন্যে রেখে গেছেন অনুসরণযোগ্য দেশাত্মবোধক স্পন্দিত অসাধারণ সব সৃজনকর্ম । সুতরাং চেতনার অভিন্ন বিন্দুতে স্থিত এই মহৎ জনদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলা ভাষা কমিটির রিপোর্টে যে সমগ্র জাতির হৃদস্পন্দন অনুভূত হবে, এটা ছিল প্রত্যাশিত এবং হয়েছেও তাই ।
রিপোর্ট- এর সুপারিশসমূহের সংক্ষিপ্তসার -এ বলা হয়েছে- “বাংলাদেশের জনসাধারণের জাতীয় চেতনায় বাংলা ভাষার জন্য গভীর অনুরাগ ও আবেগ সংযুক্ত। সেই অনুরাগ ও আবেগকে জাতীয় বিকাশ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকায় দাঁড় করাতে হলে শিক্ষার মাধ্যম, পরীক্ষার মাধ্যম, চাকুরীর মাধ্যম-এক কথায় বাংলাদেশের সর্ব পর্যায়ের জীবনধারণের অবিকল্প মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে সকল দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে, সার্বিক আন্তরিকতার সঙ্গে এবং আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
ভূমিকায় বলা হয়েছে-“বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভিত্তিভূমিতে আছে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। তাই স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছেঃ ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ সুতরাং বাংলাদেশে সর্বস্তরের বাংলা ভাষার ব্যবহার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।”
এবং পরবর্তী অংশে আরও বলা হয়েছে-“বাংলাদেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পরিপূরণের জন্যই বাংলাদেশের প্রশাসন, আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনের সর্বপর্যায়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার দ্বিধাহীনভাবে কার্যকর করতে হবে। প্রশাসন, আইন আদালত ও ব্যবসা বাণিজ্যে আভ্যন্তরীণ সর্বপর্যায়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার সরকারি আইনের দ্বারা বাধ্যতামূলক করা হলে বাংলাদেশের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার ব্যবহারে সুনিশ্চিত সাফল্য অর্জনের প্রকৃত ভিত্তি হবে।”
“দেশের প্রশিক্ষিত জনশক্তি নিয়োগের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হল দেশের শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। দেশের বণিক সমপ্রদায় ও শিল্পপতিবৃন্দ তাদের প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কাজের বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত না করলে দেশের বাণিজ্য ও সেক্রেটারিয়েল শিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার গুরুত্ব পাবে না। এবং তা না হলে ঐ শিক্ষায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের দক্ষতার মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক যোগাযোগ ব্যতীত আভ্যন্তরীণ সকলক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাংলাদেশের বণিক সমপ্রদায় ও শিল্পপতিদের জন্য বাধ্যতামূলক করা জাতীয় সংহতির স্বার্থে অত্যাবশ্যক। সরকারি যে সব বিভাগ বণিক ও শিল্পপতিদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত তাদের তরফ থেকে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য সুষ্পষ্ট নির্দেশ থাকতে হবে। আয়কর রিটার্ন, অডিট রিপোর্ট, বাংলায় উপস্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
“বাংলাদেশে কার্যরত দেশী বিদেশী সকল ব্যাংকে ও বীমা প্রতিষ্ঠানের সকল কাজে বাংলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। স্বাধীনতার পর ব্যাংক ও বীমার প্রায় সব ফর্ম বাংলায় চালু করা হয়েছিল এবং লেজার ইত্যাদিও বাংলায় লেখা শুরু হয়েছিল, কিন্তু প্রশাসনিক দৃঢ়তার অভাবে ক্রমে এ- ক্ষেত্রে শৈথিল্য এসেছে; সেহেতু সরকারি নির্দেশের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয়।”
“পূর্ববর্তীকাল থেকে প্রচলিত বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত আইন ইংরেজি ভাষায় প্রণীত। বাংলাদেশের আইনসমূহ উপযুক্ত কর্তৃত্বাধীনে বাংলা ভাষায় অনুবাদের এবং সরকার কর্তৃক প্রমিতকরণের ব্যবস্থা অদ্যবধি গৃহীত হয়নি । সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন । বাংলাদেশে নতুন সর্বপ্রকার আইন বাংলা ভাষায় প্রবর্তন করতে হবে।”
আর এসব কাজ কার্যকরভাবে সম্পাদনের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকরূপে যে বিষয় সর্বাগ্রে সবার সামনে চলে আসে তা হলো বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত গ্রন্থের অভাব। সুনিশ্চিতভাবে এই অভাব যথোপযুক্তভাবে দূরীকরণের লক্ষ্যে, এই রিপোর্টে সুপারিশ করা হয় একটি কার্যকর উচ্চতর পাঠ্যপুস্তক ও অনুবাদ বোর্ড গঠনের এবং উপস্থাপন করেন সর্বোচ্চ দায়িত্বশীল পরিচালনা পর্ষদের একটি পরিকাঠামো ও কার্যপ্রণালীও ।
এমন পরিপাটি ও পরিপূর্ণ একটি রিপোর্ট-যাতে উল্লেখিত সুপারিশ সমূহ সর্ব মহলে অভিনন্দিতও হয়েছে, যা বাস্তবায়ন উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হতে পারতো বাঙালির বিপুল ত্যাগ-উজ্জ্বল স্বপ্নপূরণের অসাধারণ অভিযাত্রা, কিন্তু শেষ অবধি জান্তা কুটিরেই ঘটলো সেই মূল্যবান রিপোর্টের অগস্ত্যযাত্রা-তিন বছর পর ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক সংবাদের শিরোনাম হয় “বাংলা ভাষা কমিটির রিপোর্ট হিমাগারে।” অতঃপর জনরোষকে বিভ্রান্ত ও প্রশমিত করার লক্ষ্যে জেনারেল সরকার ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই মার্চ সংসদে পাস করে নেয়- সরকারিভাবে নয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে পেশ করা, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের ভাষায় ‘সছিদ্র’ পূর্ণ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-যার ৩নং ধারায় বলা হয়েছে “(১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইননুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিত হইবে । (২) ৩ (১) উপ ধারায় উল্লেখিত কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহা হইলে উহা বে আইনী ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। (৩) যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।” ৪নং ধারায় এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকারকে গেজেট বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সরকার কি সেই বিধি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল? জেনারেল এরশাদ, আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ দুটোর কোনটারই কোন রূপ স্মৃতি ও শ্রুতির সাথেও যার কোন সম্পর্ক নেই তার কাছে কি এসবের কোন গুরুত্ব থাকে? তাই এ সবকে সুচতুরভাবে আড়ালে নিয়ে যেতে বাংলাদেশে আকস্মিক সৃষ্টি করে রাষ্ট্রধর্মের ধারণা ও বাস্তবতা । অতঃপর নব্বই দশকের শুরুতে খালেদা জিয়া সরকার তো জন স্বীকৃত ও নন্দিত গণ আদালত প্রদত্ত অবৈধভাবে দেশে অবস্থানকারী প্রধান যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমের দণ্ড প্রতিরোধ কল্পে দেশের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের ও ঐ গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকেই নিয়ে যায় বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পূর্ববর্তী পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় ভাবাবহে। অতঃপর ও লেভেল, এ লেভেল এবং এ জাতীয় অন্যান্য লেভেলের ক্রম সমপ্রসারণশীল অবাধ কার্যক্রম সত্ত্বেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাঙালি যে এক সময় একটা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিল, সে কথাও ভুলিয়ে দেওয়ার মহা আয়োজন শুরু হয়ে গেল-যেখানে দেখা যাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির আবেদন ফরম থেকে শুরু করে নিবন্ধনপত্র, প্রবেশ পত্র, নম্বরপত্র ও সনদপত্র সবই সম্পাদিত হয় শতভাগ ইংরেজি ভাষায়, এমম কি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থী-পরীক্ষার্থীদের বাংলা বিষয় নামও বাংলা ভাষাতে আর লেখা যায় না । এই যখন অবস্থা-রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র অভ্যন্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় ও চাকুরি-বাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা অবিবেচ্য হয়ে ওঠে, তখন আর পররাষ্ট্র ক্যাডারে কেনই বা দরকার বাংলা ভাষার ! সরকারি বিবেচনায় এই বাংলা ভাষাই নাকি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ফরেন এফেয়ার্স) ক্যাডারে’ ‘যোগ্য’ ও ‘চৌকষ’ কর্মকর্তা নিয়োগে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় । আর এই অন্তরায় দূরীকরণের লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার বি এন পি সরকার দলীয় সাংসদ শিল্পপতি তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মঞ্জুর মোরশেদ খানের নেতৃত্বে কতিপয় আমলার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ১৯৯৪/৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বিসিএস পরীক্ষা থেকে আবশ্যিক বাংলা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে প্রস্তাব পাঠায় সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে-আজকের কাগজ পত্রিকায় যার শিরোনাম হয় “বাংলা ভাষা বর্জনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ।” চেতনার কী অদ্ভূত মিল পরিলক্ষিত হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই প্রস্তাবনা ও সুপারিশমালায় এর ঠিক সাতচল্লিশ বছর পূর্বে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাদপ্তর থেকে প্রেরিত পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষা সংক্রান্ত সার্কুলারের সাথে -যেখানে মৃত সংস্কৃত, ল্যাটিনকেও বহাল রেখে বাদ দেয়া হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সজীব, সপ্রাণ, গতিময় শিল্পোজ্জ্বল, পৃথিবীর সপ্তম শ্রেষ্ঠ বাংলা ভাষাকে ।
অতঃপর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি পুনর্বার জেগে উঠার প্রাক্কালে দীর্ঘ দু-দশকেরও অধিক সময়ের এই দুঃশাসন ও বাংলা বিনাশন প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সচেষ্ট হলেন এক প্রকার মানবিক জাগরণ সৃষ্টির ধৈর্যশীল কর্ম প্রক্রিয়ায়-এবং এ ব্যাপারে প্রথমে তিনি দৃষ্টি দিলেন আইন আদালতের আঙ্গিনায়; ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ ঢাকায় বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের পবিত্র সংবিধানে আছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ আর প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সকল আদালতই এই প্রজাতন্ত্রের আদালত…সম্মানিত বিচারকগণ ও বিজ্ঞ আইনজীবীগণ বাঙালি এবং বিচার প্রার্থীগণও ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে সবাই বাঙালি। সকল আদালত কর্তৃক ঘোষিত রায় বাংলা ভাষায় হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। মুষ্টিমেয় লোকের জন্য এই বিচার ব্যবস্থা নয়। এই বিচার ব্যবস্থা দেশের সব মানুষের। সর্বস্তরের আদালতের সম্মানিত বিচারকগণ নিজের মাতৃভাষায় যেন নিপুণভাবে রায় লিখতে পারেন, এই বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এ ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করবে বলে জনগণ আশা করে ।”
না, এ যাবৎ এ ব্যাপারে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করে নি ঐ বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, এবং সংশ্লিষ্ট আদালত-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই প্রত্যাশা এখনো অপূর্ণতার বেদনায় ম্লান ।
আমাদের উচ্চ আদালতের কয়েকজন বিচারক বাংলা ভাষায় রায় লিখছেন-সেটা তাঁদের ব্যক্তিক ভালোবাসা, ব্যক্তিক উচ্চ অভিরুচি; তাঁদের জন্য আমাদের অবিরত শুভকামনা-কিন্তু এ ব্যাপারে আদালত অর্থাৎ আইনজীবী ও বিচারকরা কোন দায়বোধ কি করছেন? কই এ যাবৎ তো কোন আইনজীবী সংক্ষুদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রচলনের নির্দেশনা চেয়ে আদালতে কোন মামলা বা রিট করেন নি, কিংবা আদালতও তো স্বত:প্রণোদিত হয়ে কোন নির্দেশনা প্রদান করেন নি। উপরন্তু কোন কোন বাণিজিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ইত্যাদি আদালতের আশ্রয়েই বাংলা ভাষা প্রচলনের বিরুদ্ধে নিয়েছে শক্ত অবস্থান। এছাড়াও সমপ্রতি তো প্রযুক্তির অযুহাতে প্রতিদিন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের নতুন নতুন কার্যক্রম থেকেও অবিরত বিতাড়িত হচ্ছে বাংলা ভাষা। অপরিমেয় ত্যাগের এমন মূল্যবান অর্জনের এতটা হেলায় বিসর্জনে বাঙালির জন্যে ইতিহাসের কোন আস্তাকুঁড় অপেক্ষা করছে / নির্মিত হচ্ছে তা ভাবতেই হিম হয়ে আসে শরীর ।
না, এক্ষেত্রে আইনজীবী বিচারকরা একা নন; আমাদের শিক্ষক- শিক্ষাবিদরাও কম কিসে; জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তো বলেছি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কী ই বা প্রত্যাশা করার আছে? এধরনের বিশ্ববিদ্যালয় তো এদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা নয়-একথা ভুলে যাওয়া কি ঠিক হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বদ্ধকুঠুরিতে নিয়ত অট্টহাসি হাসছে মজিদ খানের প্রেতাত্মা, যে মজিদ খানের শিক্ষা পরিকল্পনাকে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে প্রতিরোধ করেছিলেন এদেশের ছাত্রসমাজ; আমাদের আজকের ছাত্র-যুবসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একথা মনে পড়বে-কি, ছাত্রসমাজের মজিদখানের সেই শিক্ষা-পরিকল্পনা প্রতিরোধ সংগ্রামকে ভুলিয়ে দেয়ার জন্য নব্বই দশকের শুরুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর প্রাক্কালে বিশেষ শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশে ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রচলন করে ভালোবাসা দিবস, যেদিন পালিত হতো স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস-সেখানে তো বাংলা প্রচলনের কথা দূরে থাক, সমপ্রতি সময়ের দু’চারটি ব্যতিক্রম ব্যতীত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়টিও পঠন অযোগ্য বিবেচিত । কিন্তু গভীর গভীরতর অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হতে এখনও যে দিকে তাকিয়ে আমরা বাঙালি ও বাংলার আলোকোজ্জ্বল ভবিষতের স্বপ্ন বুনি সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কি এ ব্যাপারে কোন সচেতনতা অবশিষ্ট আছে? ২১শে জানুয়ারি ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উদযাপন কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখা গেল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনি, একজন উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপচার্য ড. মোঃ আখতারুজ্জামান, উপ-উপাচার্য ড. মাসুদ কামাল ও অন্যান্যরা এমন কি সঞ্চালক প্রফেসর ড. ইমতিয়াজও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হলেন ইংরেজি ভাষার বনেদিয়ানায়; আমরা সাধারণত দেখি আমাদের কোন অনুষ্ঠানে যদি ইংরেজি ভাষায় সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় তবে তা সংস্থাপিত হয় মূল বাংলা ভাষায় সঞ্চালনের পর অনেকটাই ভাষান্তরের আঙ্গিকে । কিন্তু সঞ্চালক প্রফেসর ইমতিয়াজ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক কি না মূল বাংলা সঞ্চালনই বাতিল হয়ে গেল ঐ অনুষ্ঠান থেকে। অন্যদের কথা আর কী বলবো-কোন সচেতন বাঙালি যদি জানতে চায় তাঁরা নিজেদের এখন আর বাঙালি ভাবেন কি না, তাহলে তাঁরা কি আদৌ কোন অভিমান কিংবা রাগ করবেন! বাঙালির প্রদীপ্ত অহংকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি এভাবে তাঁর আত্মপরিচয় ভুলে যাওয়ার প্রয়াসে লিপ্ত হয়, তাহলে বাঙালির প্রত্যাশার স্থান আর থাকলো কোথায়?
‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই,’ ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর, করতে হবে’-এ শ্লোগান দুটি তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেই উৎসারিত এবং দেশব্যাপী প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। প্রথমটির পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটে সাংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ এই কথা সংযুক্তির মধ্য দিয়ে; আর দ্বিতীয়টির বাস্তবায়নে তো ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণে মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব প্রদানের কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই; কিন্তু বিগত পঞ্চাশটি বছরে এ ব্যাপারে সেখানে কি হয়েছে না হয়েছে তা নিয়ে ঐ প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বা সংশ্লিষ্টদের কোন অনুধ্যান আছে কি? ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রণীত শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছিল, “বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুষ্পষ্ট বোধ শিক্ষার্থীর চিত্তে জাগ্রত করে তাকে সুনাগরিক রূপে গড়ে তোলাই হবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য।”এবং এ লক্ষ্য সাধনে বলা হয়েছিল “উচ্চতর পর্যায়ে ব্যাপক হারে বাংলা ভাষায় মৌলিক পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং বিদেশী ভাষা থেকে বাংলায় পাঠ্যপুস্তকের অনুবাদের জন্য অধিকতর আন্তরিকতার সঙ্গে সুপরিকল্পিত সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে । এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমী এবং দেশের উচ্চমানের কলেজগুলি ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান সমূহ কি আজও কোন দায় অনুভব করে। তাহলে সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ এ কথা উল্লেখের তাৎপর্য কী?
এখানে আমাদের মনে তৈরি হয় কিছু প্রশ্ন
১) “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ একথা সংবিধানে উল্লেখ থাকার পরও আদালতের কাজ কর্ম বাংলা ভাষায় না হওয়া কি সংবিধান পরিপন্থী নয়?
২) কিংবা সংবিধানে ঐ উল্লেখ সত্ত্বেও তা কার্যকর করার জন্য সংসদে কোন আইন তৈরির প্রয়োজন আছে কি?
৩) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে-আদালতে, প্রশাসনে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা বাণিজ্যে, রাষ্ট্রভাষার প্রয়োগে বা ব্যবহারে সরকারি কঠোর নির্দেশনা কি জরুরী নয়?
এ সব প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর প্রাক্কালেও তা হচ্ছে না কেন? মুজিবীয় সাহসে সমুদ্ভাসিত হতে আমাদের আর কত পথ পাড়ি দিতে হবে? ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত পরিপত্রটির / নির্দেশনার পুনরুজ্জীবনের জন্যে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? না, বাঙালির দূর-ব্যঞ্জনাশ্রয়ী সমুন্নত আত্মবিকাশের প্রয়োজনে ২০০০ ও ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের প্রণীত শিক্ষা নীতিও মোটেই যথার্থ নয়-তাতে অবশ্যই ভাষিক ও জাতিক চেতনাকে প্রয়োজনীয় শক্তিময়তা ও গতিশীলতা দানে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতির-যা ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট পরবর্তী সকল সরকারই জনদৃষ্টি থেকে সংগোপনে সরিয়ে রেখেছেন- অনিবার্য ধারাসমূহ প্রতিস্থাপন বা সংযোজন করতে হবে, যাতে চলমান শিক্ষানীতির অনভিপ্রেত ভূক্তি গুলিও বিদূরিত হয়ে যাবে অনায়াসে।
বাঙালি জাতির ও ভাষিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের কল্যাণে এর কোনও বিকল্প নেই। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় সচেতনতায় উদীপ্ত হয়ে আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। আসুন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ লক্ষ্যে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের কবিগান
পরবর্তী নিবন্ধআজাদী : সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি