রাবেয়া খাতুন

পঞ্চাশের নক্ষত্র

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ১৬ জানুয়ারি, ২০২১ at ৭:১৬ পূর্বাহ্ণ

ছন্দোবদ্ধ বিশ বিশ পার করেছি অনেকটা রুদ্ধশ্বাসে। বাঁচব কি মরব এই দোলাচলে দুলতে-দুলতে নিজে বেঁচে গেলেও হারিয়ে ফেলেছি অনেক প্রিয় মুখ। অনেক প্রিয় ব্যক্তিত্ব। হারিয়েছি বিভিন্ন অঙ্গনের অনেক কীর্তিমান ব্যক্তিত্বকে। করোনাকালে তাঁদের স্বাভাবিক বিদায়ও হয়ে ওঠেনি। ২০২১ প্রবেশ করতে না করতেই হারানোর তালিকায় যুক্ত হলেন আরও দুই কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব, দুই মহিয়সী নারী। বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র রাবেয়া খাতুন ও নারী আন্দোলনের নেত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিলা পরিষদের সভানেত্রী আয়শা খানম। ৫০ কিংবা ষাটের দশকের একজন রাবেয়া খাতুন কিংবা একজন আয়শা খানম হয়ে উঠা কোন সহজ ব্যাপার ছিল না। নানারকম নিষেধের বেড়াজালে আটকে রাখা হতো নারীদের। বিশেষ করে মুসলিম নারীদের রাবেয়া খাতুন যখন লেখালিখি শুরু করেন পত্রিকায় তখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় আত্মীয়দের পক্ষ থেকে যে, পরপুরুষ ‘বাবুর’ লেখা পড়ছে! সে সময়ে নারী লেখকদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া এবং সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। সেই প্রতিবন্ধক পরিবেশ থেকে মেধা, সাহস ও সংগ্রামকে পুঁজি করে কিছু নারী লেখক আত্মবিশ্বাসের সাথে উঠে এসেছিলেন তাদের মধ্যে রাবেয়া খাতুন অন্যতম। তাদের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাদের জন্য তৈরি হয়েছে মসৃণ পথ। শুধু তাই নয়, নারী লেখকের সকল সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে তারা পরিপূর্ণ লেখক হয়ে উঠতে পেরেছেন।
এক সময় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোলকাতা। দেশ ভাগের পর ৫০ এর দশক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় আস্তে-আস্তে অল্প সংখ্যক লেখক সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটা ভিত্তি তৈরি করে তুলেছিলেন। ৫০ এর দশকে পুরান ঢাকায় মাসিক সওগাত ও সাপ্তাহিক বেগমের অফিসে পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সংসদের উদ্যোগে প্রতি মাসে সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে থাকতেন আলাউদ্দিন আল আজাদ, আব্দুল গাফ্‌্‌ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক,শামসুর রাহমান,আহসান হাবীব প্রমুখ। সেই আড্ডায় যোগ দিতেন রাবেয়া খাতুনও। প্রখ্যাত লেখক সাংবাদিক আব্দুল গাফ্‌্‌ফার চৌধুরী তাঁর স্মৃতি কথায় লেখেন, “পঞ্চাশের দশকের শেষ নক্ষত্রটিও হারিয়ে ফেললাম।” তিনি আরও বলেন, “রাবেয়া খাতুন আমাদের সাহিত্য জগতের প্রভাতী দেবী স্বরস্বতী। আর সেলিনা হোসেন হচ্ছেন আশাপূর্ণা দেবী”।
রাবেয়া খাতুনকে দুটো সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে একসঙ্গে। একদিকে সাহিত্য সংগ্রাম, অন্যদিকে নারী হিসেবে ব্যক্তিসত্তার লড়াই। তাঁর কথাসাহিত্যে নারীর জীবন, প্রকৃতি ও সংগ্রাম একটা বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে। তিনি নিজেও বলেছেন, তখন লেখা প্রকাশ এত সোজা ছিল না। পত্রিকা ছিল কম। তখন সামাজিক দিকগুলো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো,সমাজের প্রভাব পরিবারের উপর প্রবল ছিল। কিছু লেখার আগে ভাবা হতো সমাজ কি বলবে বা পরিবার কীভাবে নেবে? তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘মধুমতী’ তাঁতী সম্প্রদায়ের মানুষদের দুঃখগাথা নিয়ে রচিত। পরবর্তীতে এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। তাঁর স্বামী সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ ছিলেন বলেই বরাবরই তাঁকে উৎসাহিত করেছেন এবং পাশে থেকেছেন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি শিক্ষকতা করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অনেক উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে সাহেব বাজার, অনন্ত অন্বেষা, মন এক শ্বেত কপোতী, ফেরারী সূর্য, রাজারবাগ, শালিমার বাগ, মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র। তাঁর ছোটগল্প রচনার সংখ্যা হাজারের উপর। ‘বাগানের নাম মালনী ছড়া’ ‘ঘাতক রাত্রি’, ‘মেঘের পরে মেঘ’ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিকদের একজন তিনি। তাঁর মৃত্যু আমাদের সাহিত্য জগতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। এই মহিয়সী নারীর জন্ম ২৭ শে ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে। ঢাকার বিক্রমপুরে তাঁর মামার বাড়িতে তার জন্ম। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ছিল মুন্িসগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায়। বাবা ছিলেন মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ এবং মা হামিদা খাতুন। আরমানিটোলা বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রবেশিকা পাস করেন ১৯৪৮ সালে।
১৯৫২ সালে সম্পাদক ও চিত্র পরিচালক এটিএম ফজলুল হকের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তিনি বাংলা একাডেমিসহ বহু মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার অর্জন করেন।
লেখালেখি ছাড়া তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমির কাউন্সিল মেম্বার, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের বিচারক। যুক্ত ছিলেন বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, বাংলাদেশ লেখক শিবির ও মহিলা সমিতির সঙ্গে। তিনি অসাধারণ ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি সাহিত্যের সব অঙ্গনের কুশলী শিল্পী। তিনি আধুনিক ও প্রগতিশীল যেমন ছিলেন তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ছিলেন দৃঢ়নিষ্ঠ। আবারও আব্দুল গাফ্‌্‌ফার চৌধুরীর ভাষায় বলতে হয় পঞ্চাশের শেষ নক্ষত্রটিও নিভে গেল। তাঁর অমর সৃষ্টিগুলো আমাদের বাতিঘর হয়ে থাকবে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি রাবেয়া খাতুনসহ আরো যাদেরকে আমরা হারিয়েছি। এই অপূরণীয় ক্ষতি কখনও পূরণ হবার নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকজন বেগম ফাহ্‌মিদা আমিন
পরবর্তী নিবন্ধবান্দরবানের লামা পৌরসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু