রাঙ্গুনিয়ায় সার নিয়ে কারসাজি

প্রতি কেজিতে ৩-১০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে কৃষকদের

রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি | বুধবার , ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

রাঙ্গুনিয়ায় সার নিয়ে চলছে কারসাজি। প্রতি কেজি সার কিনতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ৩ থেকে ১০ টাকা বেশি গুণতে হচ্ছে কৃষকদের। বছরের পর বছর এভাবে চলে এলেও প্রতিকারের উদ্যোগ নেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রাঙ্গুনিয়ার ১৬ জন ডিলার ও ৬৪ জন খুচরা সার বিক্রেতা রয়েছেন। কিন্তু এর বাইরেও যত্রতত্র গড়ে উঠেছে সার বিক্রি প্রতিষ্ঠান। ডিলাররা তাদের কাছে বেশি দামে সার বিক্রি করেন। তারা আবার এসব বেশি দামে বিক্রি করেন কৃষকের কাছে। অন্যদিকে অনেক ডিলারের গুদাম নেই। তাদের অনেকে কাগজেকলমে সার উত্তোলন করে বিক্রি করছেন ডিও। ডিলারদের গুদামে সরেজমিনে না গিয়েও কৃষি অফিস থেকে দেওয়া হচ্ছে অ্যারাইভাল রিপোর্ট। এমন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে সার ডিলার ও কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে রাঙ্গুনিয়ার ৮ হাজার ৩৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ধান রোপণের ভরা মৌসুমে সারের চাহিদা কাজে লাগিয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন ডিলাররা। সরকার নির্ধারিত প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ইউরিয়া ও টিএসপি সারের খুচরা মূল্য ১১০০, এমওপি ৭৫০ টাকা ও ডিএপি ৮০০ টাকা। কিন্তু ইউরিয়া ১২০০, টিএসপি ১৩০০, এমওপি ১১০০ ও ডিএপি ৯০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন ডিলাররা। অনেকে এই দামের চেয়েও কমবেশি দামে সার বিক্রি করছেন। এক্ষেত্রে ক্রেতাদের ভাউচার দেওয়া হচ্ছে না। সরেজমিনে বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ডিলারের বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে এবং কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র দেখা গেছে। গুমাই বিলে কথা হয় বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। এদের একজন আবদুল জব্বার এবার ১০ কানি জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। রোপণ করার সময় তিনি প্রতি কানিতে (৪০ শতক) ২০ কেজি ইউরিয়া, টিএসপি ২০ কেজি, পটাস (লাল) ১০ কেজি করে প্রয়োগ করেছেন। গুমাই বিলে শুধুমাত্র তার ব্লকে ৮০ কানি জমিতে ৩৫ জন কৃষক এবার বোরো চাষাবাদ করেছেন।

মরিয়মনগর কর্ণফুলী পাড়ে ১০ শতক জমিতে ১১ বছর ধরে মিষ্টি পান চাষাবাদ করেছেন কৃষক বেলাল উদ্দিন। প্রতি বছর পানক্ষেতে তিনবার সার প্রয়োগ করতে হয়। সম্প্রতি তার পানক্ষেতে তিনি এমওপি ১০ কেজি, ইউরিয়া ১০ কেজি এবং একই পরিমাণ টিএসপি প্রয়োগ করেছেন। তার মতো কর্ণফুলী পাড়ে শুধুমাত্র তার ব্লকেই আরও অন্তত ১০ জন কৃষক পান চাষাবাদ করেছেন। এই দুজনসহ তাদের অধিকাংশ কৃষক মরিয়মনগর চৌমুহনী এলাকার পাইকারি সার ডিলার মেসার্স পাগলা মামা সার বিতান থেকে সার কিনেন। কেউ কেউ পাশের খুচরা সার বিক্রির প্রতিষ্ঠান করিম ব্রাদার্স থেকে, কেউ রোয়াজারহাট ও ঘাটচেক এলাকার খুচরা দোকান থেকে সার কিনেছেন। প্রত্যেক কৃষকই সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিতে ৩ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে সার কিনেছেন।

মরিয়মনগর চৌমুহনী এলাকার খুচরা সার বিক্রেতা রেজাউল করিম জানান, তিনি প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ইউরিয়া সার ১১৫০, টিএসপি১২০০, এমওপি ১১০০ এবং ডিএপি ৮৫০ টাকা হারে বিক্রি করছেন। কম দাম চাইলে তিনি ডিলারের দোকানের দিকে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দেন। সেখানে গেলে কথা হয় মেসার্স পাগলা মামা সার বিতানের স্বত্বাধিকারী মো. ইদ্রিসের সঙ্গে। তিনি জানান, ইউরিয়া ১১০০, টিএসপি ১১৫০, এমওপি ১০০০ এবং ডিএপি ৮০০ টাকা হারে বিক্রি করছেন। এক পর্যায়ে গুদামে নিয়ে গিয়ে এমওপি ইমপোর্ট করা সার চাইলে দিতে পারবেন বলে জানান। কিছুক্ষণ পর সাংবাদিক পরিচয়ে গেলে তার সুর পালটে যায়। ভবিষ্যতে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করবেন জানিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন এবং নিজেকে হার্টের রোগী উল্লেখ করে এবারের মতো ক্ষমা করে দিতে বলেন। রোয়াজারহাট ও ঘাটচেক ঘুরেও এসব এলাকার দোকানদার সারভেদে বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দাম নিতে দেখা গেছে।

গুমাই বিলের কাটাখালী এলাকায় খুচরা সার বিক্রেতা মো. নাজিম বলেন, আমি নিজেও চাষাবাদ করি। খুচরা পর্যায়ে পাইকারদের কারসাজির কারণে সরকার নির্ধারিত কেজিপ্রতি ২২ টাকার ইউরিয়া ২৫ টাকা, ২২ টাকার টিএসপি ২৫২৬ টাকা, ১৫ টাকার এমওপি ২৪ টাকা এবং ১৬ টাকার ডিএপি ১৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

একটি বস্তার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি দেখান, সাদা সারের বস্তাটির গায়ে মূল্য লেখা রয়েছে ৭০০ টাকা। এটি বছরখানেক আগের দাম। বর্তমান এই বস্তার বাজার মূল্য এক হাজার টাকা। ডিলাররা বেশি দামের আশায় এসব বস্তা স্টক করেন। এখন দাম বাড়ার পর বাজারে ছেড়েছেন।

তিনি অভিযোগ করেন, গুমাই বিলসহ এ অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক কাপ্তাই সড়ককেন্দ্রিক এই কয়েকজন সার বিক্রেতার কাছে জিম্মি। তার সাথে উপস্থিত বেশ কয়েকজন কৃষক একমত পোষণ করেন। শুধু গুমাই বিলের কৃষক নন, বাড়তি দামে সার নিতে দেখা গেছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদেরকেও। অননুমোদিত সার বিক্রির প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার কিনে নিয়ে গাড়ি ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ যোগ করে বাড়তি দামে বিক্রি করতে দেখা গেছে।

এদিকে, কৃষকদের এসব অভিযোগের তদন্তের এক পর্যায়ে এই প্রতিবেদকের হাতে একটি মুঠোফোন রেকর্ড আসে। এতে রাঙ্গুনিয়ার ডিলারদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের সভাপতি দিলীপ বড়ুয়াকে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা তাদেরকে টাকা দিই। বেশি দামে বিক্রি করব এবং বরাদ্দ বাড়িয়ে আনব।’

এই ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং কোনো টাকা তুলেন না এবং কাউকে টাকা দেন নাএই মর্মে প্রয়োজনে লিখিত দেবেন বলে জানান তিনি।

সার নিয়ে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কারিমা আক্তার বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সরেজমিনে গিয়ে অ্যারাইভাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। শুধু রাঙ্গুনিয়া নয়, চট্টগ্রামের সব উপজেলায় একই চিত্র। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি, যাতে কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে সার পায়। যেসব অভিযোগ উঠেছে এসব নিয়ে তদারকি করে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

উপজেলা চেয়ারম্যান স্বজন কুমার তালুকদার বলেন, সারের ব্যাপারে কোনো অনিয়ম হলে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমডেল মসজিদের জন্য আনা বিটুমিন চুরি, গ্রেপ্তার ৩
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীর ১০ অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা আজ হাতে পাচ্ছেন বীর নিবাস