রমা ও একটি আমগাছ

বিএম বরকতউল্লাহ | বুধবার , ১৬ জুন, ২০২১ at ৬:২৪ পূর্বাহ্ণ

রমার যেদিন জন্ম হলো সেদিন ছিল জষ্টি মাসের দ্বিতীয় সোমবার।
রমার বাবা আমাকে রোপণ করেছিল ওদের বারবাড়ি উঠোনের পূব কোণে। তিনি আগে থেকেই গর্ত করে শক্ত মাটিগুলো গুঁড়ো করে রেখে দিয়েছিলেন। আর গর্তের মাটিগুলো ছিল গোবর আর ছাই মেশানো। প্রায় দেড়ফুট গর্তের ভেতরে আমাকে রোপণ করা হলো। তারপর রমার বাবা গর্তের পাড়ের মাটি দিয়ে গর্তটি ভরাট করে দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিল। অতপর আমার সমান এক টুকরো বাঁশ কোপে দিয়ে এমন ভাবে বেঁধে দিল যাতে আমি বাতাসে হেলেদুলে পড়ে না যাই। তখন অবশ্য আমার বোনদের কথাই বেশি করে মনে পড়ছিল। আমরা একই নার্সারিতে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। রমার বাবা যখন আমাকে দর করে কিনে নিয়ে আসে তখন আরেক জন নিয়ে যাচ্ছিল আমার অন্য বোনদের। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কষ্টে মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। কেননা আমরা জানতাম না কে-কেমন মালিকের হাতে গিয়ে পড়ি। মালিক যদি বেখেয়ালি ধরনের হয় তবে কষ্টের সীমা থাকবে না। আমরা বিদায় নিয়ে যে-যার মালিকের বাড়ি চলে গেলাম।
দুই.
আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাকে যেদিন রোপণ করা হয় সেদিন রাতেই রমার জন্ম হয়। আমিই প্রথমে নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। ওর কাঁপা কাঁপা চিৎকারের ভেতরে এক ধরনের আনন্দ মিশে ছিল। ওর কান্না শুনে প্রতিবেশিরা দৌড়ে এসে ঘরের সামনে ভিড় করে জানতে চেয়েছিল ছেলে হয়েছে, না মেয়ে। তখন কেওরের একটি ডালা ফাঁক করে এক মহিলা ফিসফিস করে বলল, মেয়ে হয়েছে গো মেয়ে। চান্দের লাহান! তখন সকলের সঙ্গে আমিও আনন্দে নেচে উঠেছিলাম। নাচের তোড়ে আমার শরীর থেকে দুটো পাতা ঝরে পড়ে গিয়েছিল। আহ নতুনেরা কত আনন্দবার্তা নিয়ে আসে পৃথিবীতে!
আদরের রমা এর ওর কোল থেকে এক সময় ভেতরবাড়ির উঠোন পেরোলো। তারপর একদিন কচি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে আমাকে স্পর্শ করে বলেছিল, ‘এতা আমাল আমগাথ’, আর সেদিন আমার পুরো শরীর আনন্দে ভরে গিয়েছিল।
আমার সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রং ধরা আম ঠিকই রমার চোখে পড়ত। সে তখন তার মা ও বাবাকে আঙুলে দেখিয়ে বলতো, ্‌ওই যে পাকা আম, ওটা পেড়ে দাও। ওর আবদার রক্ষা না করে স্বস্তি পেত না কেউ। রমা মনের সুখে আম খেতো। আমের রস কব্জি বেয়ে নিচে পড়ে যেতে চাইলে সে জিহ্বাটা লম্বা করে সুরুত করে একটা টান দিয়ে রসটুকু খেয়ে ফেলতো। এই দেখে আমি ভারি মজা পেতাম। রমা আমার ছায়ায় বসে ছোট ছোট মাটির পাতিলে বহুবার ভাত তরকারি পাক করেছে। সে মায়ের মতো বসে খাবার রান্না করে খেয়েছে ও অন্যদের বিলিয়ে দিয়েছে। আমাকেও খাইয়ে দিয়েছে। সে আমার সঙ্গে কথা বলতো। কখনো বা মায়ের মতো শাসন করতো। সে মাঝে মধ্যে আমাকে তার অবাধ্য ছাত্রী মনে করে বেদম পিটুনি দিত। তারপর সে শাসনের ভঙ্গিতে বলতো আরো দুষ্টুমি করবি? যা মন দিয়ে বই পড় গে। তখন খুব গর্ব হতো আমার। আমি রমাকে কতটা পছন্দ করি রমা মনে হয় সেটা ভাল করেই বুঝতে পারতো। এমনই শতো ঘটনার ভেতর দিয়ে রমা যে কখন বড় হয়ে গেল টের পাই নি।
তিন.
আজ রমার বিয়ে। একমাত্র আদরের মেয়ের বিয়েতে খরচও হবে মেলা। অনেক টাকা যোগাড়-যন্তের ব্যাপার। তাই রমার বাবা আমাকে বিক্রি করে দিলেন। ব্যাপারীরা এসে রেৎ দিয়ে করাতের দাঁতে শান দিচ্ছে। রেতের কর্কশ শব্দের ভেতরে আমি রমার বিয়ের সানাইয়ের সুর শুনতে পেলাম। রমার বাবা ছুটে এসে বলল, আমি এক দিনে দুজনকে বিদেয় করতে চাই না। তোমরা বরং কাল এসো, তিনি একথা বলে ব্যাপারীদের বিদায় করে দিলেন। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
বাড়ি ভর্তি মানুষ-বাড়ি ভর্তি আনন্দ। আমি পষ্ট দেখতে পেলাম রমা কারূকাজ করা রঙ্গিন কাপড়ে ঘোমটা টেনে বসে আছে। সবার মুখে হাসি। শিশুরা আনন্দে ছোটাছুটি করছে। সাজানো বাড়ির ভেতরে ও বাইরে হাসিমুখে মানুষের ব্যস্ত আনাগোনা। এরই মাঝে ধমক খেয়ে কয়েকটা কুকুর ছুটে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল আবার একটু পরেই দেখি ইনিয়ে বিনিয়ে চলে যায় সামিয়ানার পাশে যেখানে অতিথিদের আদর-আপ্যায়ন চলছে। কয়েকজন অতিথি আমার ছায়ায় দাঁড়িয়ে খোশগল্প শুরু করে দিল। কেউ কেউ পান খেয়ে মুখ লাল করে এসে আমার গোড়াতে পিক ফেলল। কেউবা আঙুলের অবশিষ্ট চুন মুছে-পুছে রেখে গেল আমার শরীরে। সাদা চুনগুলো আমার গায়ে বেলি ফুলের মতো ফুটে রইল। তাতে আমি বেশ আনন্দই পেলাম।
চার.
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। রমার বিদায়ের পালা। এরই মাঝে রমা একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। সে সবার মাঝ থেকে ছুটে এসে আমাকে পেঁচিয়ে ধরে চিঁ চিঁ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। বরপক্ষের লোকেরা অপ্রস্তুত ভাবে তাকিয়ে রইল। আর রমার বাড়ির লোকজনেরা মুখ ঢেকে চোখের জল ফেলল। রমা কিছু না বলেও তার চোখের জলধারায় আমাকে অজস্র কথা বলে গেল। অতপর একজন মহিলা রমার হাত ধরে ধীরপায়ে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দিল। গাড়িটি চলতে চলতে চোখের আড়াল হয়ে গেল।
পাঁচ.
রাত পোহাতেই চলে এলো ব্যাপারীরা।
তারা আমাকে ঠেলাগড়িতে তুলে যখন রওনা দিল তখন রমাদের বাড়ির লোকেরা আমার দিকে করুণ ভাবে তাকিয়ে ছিল। রমার বাবা আমার জায়গার ঠিক পাশেই একটি চারা রোপণ করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। রমা গতকাল যে পথ ধরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল সে পথ ধরে ঠেলাগাড়িটি করাতকলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তখনও আমার সামনে রমার বিয়ের আনন্দ-হাসি আলো-ছায়ার মতো খেলা করছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত প্রাণি ‘ ব্লবফিশ’
পরবর্তী নিবন্ধমন দিয়ে পড়ি