রবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইনের কথোপকথন ও একটি ‘বিজ্ঞান-কবিতা’

ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | শুক্রবার , ৭ মে, ২০২১ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

আমাদের পৃথিবী গ্রহে শ্রেষ্ঠ দুইজন মহামানব আইনস্টাইন এবং রবীন্দ্রনাথ। স্বাভাবিকভাবে তাঁদের মধ্যকার কথোপকথন নিয়ে আমাদের প্রবল উৎসুক্য। এই দুই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব দুইবার পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে- প্রথমবার। দ্বিতীয়বার তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে, ১৪ জুলাই ১৯৩০ সালে, আইনস্টাইনের নিজ বাড়ি জার্মানির কাফু’তে। সঙ্গে থাকা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি অমিয় চক্রবর্তীর চমৎকার অনুবাদে, সেবারের কথোপকথন উদ্ধৃত করা যাক্‌-
আইনস্টাইন – বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রকৃতি নিয়ে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা রয়েছে। একটা ধারণা বলে- বিশ্ব হলো ঐক্যসঙ্গতি যা মনুষ্যত্বের উপর নির্ভর করে আছে। আর অন্য মতে- বিশ্ব হলো এমন এক বাস্তবতা যা মানব সম্পর্ক নিরপেক্ষ,স্বাধীন।
রবীন্দ্রনাথ- এ বিশ্ব তো মানুষেরই পৃথিবী। বিজ্ঞানদৃষ্টি দিয়ে যদি একে দেখতেই হয়, তো যিনি দেখবেন সেই মানুষটিকেও
তাহলে বিজ্ঞানচিন্তা সম্পন্ন হতে হবে। তার মানে আমাদের বাদ দিয়ে আলাদা কোন বিশ্বের অস্তিত্ব নেই। এ হলো আপেক্ষিক বিশ্ব, এ-যে কতখানি বাস্তব, তা নির্ভর করছে আমাদের চৈতন্যের উপর।
আইনস্টাইন- তাহলে বলুন সত্য বা সৌন্দর্য, এ-সবও মানব সম্পর্ক নিরপেক্ষ স্বাধীন নয় ?
রবীন্দ্রনাথ- নয়ই তো।
আইনস্টাইন – ধরা যাক, মানুষ বলে কোনো কিছুই আর নেই। তখনও কি এই সন্ধ্যা-তারা এমন সুন্দর দেখাবে না ?
রবীন্দ্রনাথ- না।
আইনস্টাইন- সৌন্দর্যের ধারণার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমি একমত। তবে সত্যের ক্ষেত্রে আপনার কথা আমি মানতে পারছি না।
রবীন্দ্রনাথ- কেন পারছেন না ? সত্যও তো মানুষের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হবে।
আইনস্টাইন- পিথাগোরাসের যুক্তি আমি মান্য করি। সত্যের অস্তিত্ব মানুষের সম্পর্ক-নিরপেক্ষ ব্যাপার।
রবীন্দ্রনাথ-পরম সত্য তো ব্যক্তি-মানুষের ধ্যানের বাইরে ধরা দেয় না, সে অনুভব তো ভাষায় অবর্ণনীয়।
আইনস্টাইন- বাস্তবতা তো যা অস্তি তাই, মনের মানা না মানার বাইরে তার অস্তিত্ব। ধরা যাক্‌ এই বাড়িতে জনপ্রাণী নেই, তারপরেও ঐ যে টেবিলটি সেটি একই রকম থাকছে। টেবিল হলো সেটাই, যা আমাদের চৈতন্যের কোথাও কোনোখানে তার অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ-হ্যাঁ, ব্যক্তিমনের স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির বাইরে স্বাধীনভাবে সে থাকছে ঠিকই, কিন্তু তা বলে সে বিশ্ব মানবের বাইরে থাকছে এমন নয়।
আইনস্টাইন- বাড়িতে কেউ না থাকলেও টেবিলটা থাকছে। কিন্তু আপনার দৃষ্টিতে এর কোনো বৈধতা নেই। কেননা আমাদের চৈতন্য বহির্ভুতভাবে ওই টেবিলের অস্তিত্বকে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আসলে সত্যের উপরে আমরা অতিমানবীয় অবজেকটিভিটি আরোপ করে থাকি। আমাদের অস্তিত্ব নিরপেক্ষভাবে এবং মানসসম্পর্ক রহিতভাবে এই যে স্বাধীন অস্তিত্ব রয়েছে বাস্তবের, এর যে ঠিক কী অর্থ আমরা বুঝিয়ে বলতে পারব না। অথচ আমাদের জন্য তা জরুরি, অপরিহার্য।
রবীন্দ্রনাথ- যেভাবে-ই বলুন না কেন, ব্যাপারটা আদতে হচ্ছে মনুষত্যবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণত সম্পর্কশূন্য কোনো সত্য যদি কোথাও থেকে থাকে, তো আমাদের কাছে তার কোনো অস্তিত্বই নেই।
পুরো আলোচনা জুড়ে যেন দার্শনিকতার বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানের দার্শনিকতা। বস্তুত দার্শনিক জিজ্ঞাসা থেকেই আবিষ্কারের সূচনা ঘটে। তাই স্টিফেন হকিং বিখ্যাত কয়েকজন দার্শনিকের নাম উল্লেখপূর্বক তাঁর এক লেখায় আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে-এই শতাব্দীতে উচ্চস্তরের দার্শনিক না থাকার কারণে বড় কোনো বিজ্ঞান সূত্রের দ্বার খোলা যাচ্ছে না। নিউটনের সেই ‘আপেল কেন নিচে পড়ে?’- এই দার্শনিক জিজ্ঞাসার সুবাদে ‘মাধ্যাকর্ষণ সূত্র’ আবিষ্কারের বিষয় মাথায় রাখলে অবশ্য হকিংএর কথার সারবত্তা বুঝা যায়।
বিবেকানন্দ এরকম মত প্রকাশ করেছিলেন, আসলে সব আবিষ্কার হলো ‘ডিসকভারি’ বা উদ্‌ঘাটন, কোনটাই ‘ইনভেনশান’নই। একার্থে কথাটা গ্রহণ করা যায়। তাঁর এধরনের আরেকটা ব্যাখ্যা ছিল এরকম- মহাবিশ্বে যা আমরা প্রত্যক্ষ করি তা কোন প্রাণীর কত ইন্দ্রিয়শক্তি তার উপর নির্ভরশীল। যেমন কেঁচো যদি দুই ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট হয়, আর মানুষের পাঁচ ইন্‌দ্িরয়ের, ফলে মানুষ সেসব ইন্দ্রিয়জাত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীর বুকে অন্যান্য জীবের তুলনায় অধিক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যেমন কেঁচো আমাদের দেখতে পারে না, কিন্তু আমরা তাদের দেখি। তেমনি আকাশ ও মৃত্তিকার মধ্যে যদি কোন প্রাণী থাকে, যাঁরা আরো বেশি ইন্দ্রিয়শক্তির অধিকারী, তবে তারা সেরকম উচ্চাবস্থায় বিরাজমান থাকবে। বলা যায় বিবেকানন্দের এই ধারণাও এক ধরনের দার্শকিতা। সুতরাং সত্য বা বাস্তবের অস্তিত্ব নিয়ে এই তিনজন বিশিষ্ট মানবের জিজ্ঞাসা অমূলক নই।
একথাটা হয়তো ভেবে দেখা যায় যে-বিশ্বব্রহ্মান্ডে যতো সৃষ্টি তা অনুধাবনে সুনির্দিষ্ট রিসেপটরও থাকা চাই। আমরা যখন আমের স্বাদ নিই, শুধু আমে সেই গুণ থাকলে হবে না, সেই গুণ উপলব্ধির স্বাদে অনুভব করতে জিহ্বায় দেওয়া আছে স্বাদ-রিসেপটর বা ট্যাস্ট-বাডস্‌। পরপর মিষ্ট, লবণ, তেতো সাজানো এইসব স্বাদ-কুঁড়ি দিয়ে আমরা খাবারের এইসব প্রিয়াম্বরী স্বাদ-গুণ আস্বাদন করতে সক্ষম হই।
সত্য অস্তিত্বের সঠিক উত্তরের খোঁজে এমনও জানা যায়, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নিজেই তাঁর বিখ্যাত আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে সরে এসে চলার পথে যাঁকে পাচ্ছেন, তাঁকে-ই আকুলভাবে জিজ্ঞেস করছেন যে- কেউ যদি চাঁদ দর্শনে অসমর্থ থাকেন, তখন চাঁদের অস্তিত্ব তাতে লোপ পায় কি পায় না। যে কারণে সেই সময়কার ধীমান বিজ্ঞানীদের অনেকের কাছে তিনি প্রায় ব্রাত্য হয়ে পড়েছিলেন।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ পরম সত্য অনুধাবনে ধ্যানের প্রসঙ্গ টেনেছেন, যা ঋষিসুলভ সাধনালব্ধ উপলব্ধির ব্যক্তি অনুভবে কেবল ধরা দেয়। ১৯৩৬ সালে শান্তিনিকেতনে বিষয়টা উপস্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ লিখেন তাঁর বিখ্যাত ‘আমি’ কবিতা। ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/ আমি চোখ মেললুম আকাশে-/ জ্বলে উঠল আলো।/ পূবে পশ্চিমে।/ গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম‘সুন্দর’-/ সুন্দর হলো সে’। স্তবকে স্তবকে সাজানো এই কবিতায় তিনি তাঁর পূর্বেকার বক্তব্যে অটল থেকে সত্যের অন্বেষণে উচ্চারণ করলেন- ‘সেদিন কবিত্বহীন বিধাতা একা রবেন বসে/ নীলিমাহীন আকাশে/ ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গণিততত্ত্ব নিয়ে’। বুঝতে অসুবিধা হয় না কথোপকথনের ছয় বছর পরে এসেও রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের ওই জিজ্ঞাসা বিস্মৃত হননি।
তাতে করে পৃথিবীর ইতিহাসে ‘সত্য-কে’ জ্ঞাত হওয়ার মহত্তম ভাবনায় মোড়ানো শ্রেষ্ঠ দুই মহামানবের এই যুগলবন্দি উচ্চারণের সঙ্গে আমরা যেন পেয়ে গেলাম রবীন্দ্রনাথের একটি ‘বিজ্ঞান-কবিতা’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিগুরুর স্বদেশভাবনা ও মানবতাবোধ
পরবর্তী নিবন্ধরাতে আম গাছ থেকে পড়ে যুবকের মৃত্যু