কবিগুরুর স্বদেশভাবনা ও মানবতাবোধ

পিংকু দাশ | শুক্রবার , ৭ মে, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির কাছে বিশেষ একটি নাম। বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর বিশাল সাহিত্যকীর্তির জন্য বাঙালির রক্তস্রোতে তিনি চিরভাস্বর।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনার মূল সুরটি হল মানবতাবোধ। সংকীর্ণ দেশ কাল পাত্রের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে এর সুর বাঁধা। তিনি দেশকে অনেক ভালোবাসতেন। রবীন্দ্রকবিতায় দেশাত্মবোধ ও স্বদেশিকতা বিষয়ে যে পরিচয় পাওয়া যায় তা গভীর ব্যাপক এবং বিশ্বমৈত্রীর নামান্তর। তিনি বলেছেন, ‘দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানার ধৈর্য থাকে না। তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও ভালো করা যায় না’। রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধে সর্বজাতি এবং সর্বশ্রেণির মানুষ সমাদৃত হয়েছে। গীতাঞ্জলির ‘ভারততীর্থ’ কবিতাটি এ পর্যায়ের। ভারতভূমিকে কবি বলেছেন পুণ্যতীর্থ। কারণ এই ভূমিতে বহু জাতি এবং বহু মানুষের মিলনস্থল। কবির ধর্ম মানুষের ধর্ম, কবির ঈশ্বর নরদেবতা। সুতরাং সেই মানুষের আবাসভূমি পুণ্যতীর্থ হবেই। ‘ভারততীর্থ’ কবিতার শেষ স্তবকে এই উদাত্ত আহবান ধ্বনিত হয়েছে।
এসো হে আর্য, এসো অনার্য / হিন্দু মুসলমান। এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,/ এসো এসো খ্রিস্টান। এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন/ ধর হাত সবাকার/ এসো হে পতিত, করো অপনীত সব অপমান ভার।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কালে তাঁর স্বদেশ প্রেমের স্ফুরণ দেখা দেয়। তিনি আসমুদ্রহিমাচল বৃটিশ বিরোধিতা ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেসময় স্বদেশ প্রেমের গানগুলো দেশপ্রেমিকদের কণ্ঠে কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। যেমন – এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে। তাঁর গোরা, ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় ইত্যাদি উপন্যাসগুলিতে এবং অচলায়তন, রক্তকবরী প্রভৃতি রূপক নাটকগুলিতে দেশের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন এবং দেশপ্রেমের পরিচয় ফুটে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় রচনা করেন স্বদেশবন্দনা ও প্রতিবাদী চরিত্রের কবিতাগুচ্ছ। সেগুলোর অন্যতম ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘সার্থক জনম আমার’ ইত্যাদি। এ আন্দোলন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু মুসলমান বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন।
সামপ্রদায়িক ঐক্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল বলে তিনি সেই ঐক্য বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন জাতীয় জীবনের নানা খাতে। চেষ্টা ও কম করেননি তাঁর লেখা ও কাজে। তিনি আজীবন ধর্মীয় উন্মাদনার বিরোধিতা করে এসেছেন। যে ধর্ম মানুষে মানুষে ঘৃণার বীজ রোপন করে, যে ধর্ম সমপ্রদায়ে সমপ্রদায়ে সংঘাত প্রতিঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, যে ধর্ম আমাদের সামাজিক ঐক্যকে খণ্ড বিখণ্ড করে, রবীন্দ্রনাথ বরাবর সেই ধর্মের বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁর এই দর্শন অখণ্ড মানবতাবাদের নিদর্শন।
বৃটিশ সরকার ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘নাইট উপাধিতে’ ভূষিত করেন। কিন্তু পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজ সরকারের প্রবর্তিত এক বিল, যার আওতায় বিনা বিচারে কোন লোককে আটক রাখার বিধান পাশ করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী প্রায় দুহাজার নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল, বৃটিশ সরকারের নির্দেশে। ওই মর্মান্তিক গণহত্যার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ সরকারের দেয়া ‘নাইট উপাধি’ ত্যাগ করেছিলেন ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল।
১৯২১ সালে বোলপুরের অনতিদূরে তিনি স্থাপন করেন ‘পল্লী সংগঠন কেন্দ্র’। সংস্থাটির উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতি সাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এ সংস্থাটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘শ্রীনিকেতন’। শ্রীনিকেতন এ রবীন্দ্রনাথ বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করলেন।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বসে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা ও চৈতালীর অসংখ্য কবিতা। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের অনুবাদের কাজও তিনি শুরু করেছিলেন শিলাইদহে। তিনি ছিলেন প্রথম অ- ইউরোপীয়, যিনি সাহিত্যে ‘নোবেল পুরস্কার’ পেয়েছিলেন। ১৯১৩ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ (Song Offering) এর জন্য তাঁকে সুইডিশ একাডেমি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেন। ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সাম্মানিক ডি.লিট.প্রদান করেন। তাঁর রচিত গান ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের এবং ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ ভারতের জাতীয় সংগীত।

রবীন্দ্রনাথ স্বদেশকে ক্ষুদ্র ভূখন্ডের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে বিশ্বচেতনায় তাকে দেখেছেন। তিনি সবদিক থেকে দেশকে পরিপূর্ণ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয়, তবেই দেশ প্রকাশিত। তাই দেশের প্রতি প্রেম হল মানুষের বিকাশ, পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মানুষের ভাবনা চিন্তার উত্তরণ, শিক্ষা গবেষণা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, খাওয়া পরা এবং পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। তিনি শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন ও শিলাইদহে পল্লী উন্নয়নে অসংখ্য কাজ করে গেছেন। যার মধ্যে আধুনিক কৃষিবিদ্যা, শিল্প ও কুটিরশিল্প, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন, পল্লীর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, খাদ্যাভাব মোচন, শিশু ও নারী শিক্ষা অন্যতম।
তিনি এক আশ্চর্য মানবতাবাদী যার পক্ষে বলা সম্ভব, ‘মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মত সর্বনেশে অন্ধতা আর নেই। এই বন্ধন এই অন্ধতা নিয়ে কোন মুক্তিই আমরা পাব না’। প্রায় ৭০ বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেন। মৃত্যুর সাতদিন আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমরমীবাদের সহজতত্ত্ব ও রবীন্দ্রনাথের অরূপ সাধনা
পরবর্তী নিবন্ধরবীন্দ্রনাথ-আইনস্টাইনের কথোপকথন ও একটি ‘বিজ্ঞান-কবিতা’