যৌনকর্মীর পেশাগত অধিকারের লড়াই

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ১৬ জুলাই, ২০২২ at ৭:২১ পূর্বাহ্ণ

‘বেশ্যার চেয়েও খারাপ’- কারো চরিত্রের নেতিবাচকতা বোঝাতে এই কথার ব্যবহার আমাদের কাছে খুব পরিচিত। ছেলেদের ক্ষেত্রেও এই গালি ব্যাবহার হতে দেখেছি। মূলত দু-মুখী চরিত্র কিংবা নিজের স্বার্থে অন্যকে ভাঙিয়ে চলা এইসব বোঝাতে উল্লেখিত বাক্যের ব্যবহার হতে দেখেছি। আর নারীর চরিত্র খারাপ বোঝাতে ‘বেশ্যা’ শব্দ বহুল ব্যবহৃত। এখন এই ‘বেশ্যা’ মানে কি? ‘বেশ্যা’ হল সেই নারী যে অর্থের বিনিময়ে যৌন কাজে যুক্ত হয়। সোজা কথায় অর্থেও বিনিময়ে নারীর যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া সমাজের মূলধারার মানুষের দৃষ্টিতে খারাপ কাজ এবং অপরাধ। এইসব মানুষ ‘যৌন কর্মে’র ‘কর্ম’ মানে এটাও যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক বা অফিসের সাহেবদের মত একটা কাজ, এই বিষয়টা তারা হয় সচেতনভাবে এড়িয়ে যান, অথবা চিন্তা-ভাবনার সীমাবদ্ধতা এবং গোঁড়ামির জন্য স্বীকার করেন না, নয়ত অজ্ঞতাও একটি কারণ হতে পারে। আমাদের সমাজে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ‘দেবদাস’ এর পতিতালয়ে মদের নেশায় পড়ে থাকাকে খুব আবেগ এবং প্রেমময় ব্যাপার হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু যে যৌনকর্মী তাকে আশ্রয় দিল তাকে আবার ঠিকই গালি দেয়া হয় ‘বেশ্যা’ বা ‘পতিতা’ বলে।
এত কথা অবতারণা করতে হল আমাদের ‘ক্যান ডু বার’ এ যাওয়ার ঘটনার কথা বলবার জন্য। চ্যাং মাই শহরে ‘বার্মিজ ভাষা কেন্দ্র’ পরিদর্শনের পর, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ‘ক্যান ডু বার’ পরিদর্শন। এটি একটি বার মানে শুঁড়িখানা যেটি ‘এমপাওয়ারড ফাউন্ডেশন’ এর যৌন কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত। ‘এমপাওয়ারড ফাউন্ডেশান’ থাইল্যান্ডের যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, যৌনকর্মীর আবার অধিকার কি? এখানেই তখন পেশার বিষয়টা আসে। অন্য সকল পেশার মত এটাও যে একটা পেশা এর আইনগত স্বীকৃতি হল প্রথম এবং প্রধান অধিকার। পেশার স্বীকৃতির পাশাপাশি আসে এই পেশায় যারা যুক্ত আছে তাদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়। পেশাগত নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার পাশাপাশি আসে পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার বিষয়। সবকিছুর উপরে এই পেশার কর্মীদের সম্মান প্রদান।
যৌনকর্মীদের অধিকারের এই নানান বিষয়গুলো জেনেছি ‘ক্যান ডু বার’ এর কর্মীদের সাথে আলাপ করে। যৌনকর্মীদের পেশাগত এইসব লড়াইয়ের বিষয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না। অধিকাংশ মানুষের মত আমার ভাবনাতেও ছিল যৌন কর্মকে যারা পেশা হিসেবে নেয়, তারা খুব বিপদে পড়েই নেয়। স্বইচ্ছায় কেউ একে পেশা হিসেবে নেয় এই কথা কখনো মাথায় আসেনি। আসলে মাথায় আসেনি বললে ভুল বলা হবে, স্বীকার করা ভালো স্ব-ইচ্ছায় যারা এই পেশায় যুক্ত হয় তাদের ‘খারাপ’ মেয়ে হিসেবেই দেখাতাম। কেবল মেয়েদের কথা বললাম, কারণ এই পেশায় যুক্ত পুরুষকর্মীদের কথা খুব একটা আলোচনায় আসে না। আমরা যা জেনে বা শিখে বড় হই, তা থেকে বের হয়ে একেবারে বিপরীত ভাবনাকে জানা এবং গ্রহণ করা সহজসাধ্য নয়। স্পাইসি রোডের সদস্যদের সাথে ভ্রমণ শুরু করার আগে আমি থাইল্যান্ডে ভলান্টারি কাজ খুঁজছিলাম। এরমধ্যে ‘নাইটলাইট ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটা সংস্থাকে খুঁজে পেলাম যারা ব্যাংকক এবং চ্যাংমাই এর যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনে কাজ করে। আমি ওদের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম কাজ করার ব্যাপারে, ওরাও আগ্রহী ছিল। কিন্তু, এর জন্য আবার আলাদা ভিসা লাগবে। শেষ পর্যন্ত কথা হল আমি যদি ভলান্টিয়ারের ভিসা ম্যানেজ করতে পারি তাহলে কাজ শুরু করতে পারব। কিন্তু, শর্ত হল আমার সব খরচ আমাকেই বহন করতে হবে। আমি আনন্দিত মনে রাজি হয়ে গিয়েছিইলাম কারণ আমার তখন মনে হয়েছিল যৌন কর্মীদের পুনর্বাসনে কাজ করব, এ তো বিশাল মহান এবং মহৎ কাজ! এই মানসিকতার আমি যখন ‘ক্যান ডু বার’ এর কর্মীদের সাথে আলাপ করি, এই পেশা নিয়ে আমার ভেতরের গ্রথিত ভাবনায় রীতিমত ঘূর্ণিঝড় লেগে গেল। একজন বলছিল সে গ্রাম থেকে এসেছে, সেখানে তার ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ে, বৃদ্ধ বাবা-মা আছে। তার কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই যে সে ভালো বেতনের কোন কাজ পাবে। আর কম বেতনের কাজে তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হবে, কিন্তু বেতনও বাড়বে না আবার কোন সঞ্চয়ও হবে না। কোন দিক থেকেই কোন লাভ হবে না। কিন্তু, একজন যৌনকর্মী হিসেবে যে যা আয় করে, তা দিয়ে তার পরিবারের মানুষকে সে ভালোভাবে রাখতে পারে, তার সন্তানেরা ভালো স্কুলে যেতে পারছে। সে আমাদের প্রশ্ন করল, তাহলে কেন সে এই কাজ ছেড়ে দেবে? সে আমাদের বলল, আমরা আমাদের মেধা বিক্রি করছি শ্রমিক কিন্তু তার শ্রম বিক্রি করছে, তাহলে একজন যৌনকর্মী তার শরীরকে ব্যাবহার করে আয় করলে তাতে মানুষের এত আপত্তি কেন? সে বলল, ‘আমার শরীর আমার অধিকার।’ সাথে আরেকজন যুক্ত করল, তারা চায় তাদের পেশার নিরাপত্তা এবং যথাযথ সুরক্ষা। আমাদের সাথে আলোচনায় যোগ দেয় ‘এমপাওয়ারড ফাউন্ডেশানের’ একজন। তিনি বলেন, তারা দেশব্যাপি সকল যৌনকর্মীদের সুরক্ষার জন্য কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে অন্যতম হল, নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা, ক্লায়েন্ট কী কী করতে পারবে তা কাজের আগে ঠিক করে নেয়া, টাকার আদায় নিশ্চিত করা, কোন বিষয়ে জোর করা যাবে না, নির্যাতন বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না, সকল ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সুরক্ষা মেনে চলা যেমন বাধ্যতামূলক কনডম ব্যাবহার করা, উভয়পক্ষের বয়স আঠারোর উপরে হবে- এমন আরও অনেক কিছু। ওরা জানালো, সারা বিশ্বের যৌন কর্মীদের নেটওয়ার্ক আছে, যারা একসাথে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে।
ভারতীয় লেখক এবং যৌনকর্মী নলিনী জামেলার বই ‘রোমান্টিক এনকাউন্টার অফ আ সেঙ ওয়ার্কার’ পড়তে গিয়ে যৌনকর্মীদের এই নেটওয়ার্কের কথা আরও ভালো করে জানতে পারি। বাংলাদেশেও এই নেটওয়ার্ক কাজ করে যাচ্ছে। এশিয়ার এই অঞ্চলে সেঙ ওয়ার্কার নেটওয়ার্কারের সম্মেলন হয় নিয়মিত যেখানে তারা তাদের অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে আলচনা করে এবং যৌথ কর্মপপদ্ধতি নির্ধারণ করে। এদের একটি বড় অর্জন হল ‘বেশ্যা’ ‘পতিতা’ ‘প্রস্টিটিউট’ এইসব অবমাননাকর শব্দের পরিবর্তে ‘যৌনকর্ম’ শব্দের ব্যাবহার আন্তর্জাতিকভাবে নিশ্চিত করা। নলিনী জামেলা পেশায় একজন শমিক ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি যৌনকর্মীর পেশা গ্রহণ করেন। নলিনী মুলত মুখে মুখে তার কথাগুলো বলে যেতেন আর গবেষক রেশমা ভরদ্বাজ সেগুলো লিখে নিতেন। নলিনীর সাথে কাজ করতে গিয়ে রেশমার এই পেশা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। তখন তার নির্দিষ্ট কোন চাকরি ছিল না, টাকার দরকার ছিল, তিনি যৌনকর্মী হিসেবে পেশা শুরু করার কথা ভাবলেন। কিন্তু, নিজের পরিবার, সমাজ এর কথা ভেবে দ্বিধায় ছিলেন। তারপর দুইবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানসিক বাধা উৎরে এই পেশায় যুক্ত হতে আর পারলেন না। আমি দু-একজনের কথা জানি, যারা জীবনের দুর্দিনে অনেকবার ভেবেছিলেন যৌনকর্মীর পেশায় যুক্ত হবার কথা। বাংলাদেশের আইনে যৌনকর্ম বেশ গোঁজামিল করে রেখেছে। এখানে যৌনকর্ম বেআইনি না, ২০০০ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে এটি বলা হয়েছে। আবার একে উৎসাহিত করাও হয় না। আবার কেউ যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে নিলে তাকে সরকারিভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। বাংলাদেশের ভোটার নিবন্ধনে পেশার ঘরে যৌনকর্ম পেশা হিসেবে উল্লেখ আছে। তবে, আবার মূল্যবোধ সংক্রান্ত আইনে, এই কাজে সংযুক্তিকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশে বৈধ-অবৈধ দুই ধরনেরই পতিতালয় আছে। প্রায় ১৮-২০ টি বৈধ পতিতালয় আছে যার মধ্যে ফরিদপুরের দৌলতদিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পতিতালয়ের একটি। ১৯৯০ সালে ঢাকার এবং ১৯৯৯ সালে নারায়নগঞ্জের পতিতালয় সরকার তুলে দেয়। এতে রাতারাতি কয়েক হাজার যৌনকর্মী পরিবার পরিজন নিয়ে গৃহহীন হয়ে যায়। ফলে তারা অনিশ্চিত জীবনে পড়ে যায়। আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে, নিয়মিত পুলিশের হয়রানির শিকার হয় যৌনকর্মীরা। নিয়মিত পুলিশ এবং প্রশাসনকে ঘুষ দিতে হয় এই পেশার মানুষদের। ‘ক্যান ডু বার’ এরর কর্মীরাও এই পুলিশি হয়রানির কথা বলে। যদিও থাইল্যান্ডে যৌনকর্ম পেশা হিসেবে স্বীকৃত, তথাপি আরও বিভিন্ন আইনি ফাঁকফোঁকর বের করে পুলিশ হয়রানির চেষ্টা করে ঘুষ আদায়ের জন্য, কিংবা বিনে পয়সায় সার্ভিস নেবার জন্য।
এই পেশায় সবচেয়ে বড় যে শংকা তা হল, নারী পাচারের সাথে এর সরাসরি সংযুক্তি। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার নারী ভারতে পাচার হয়ে যায় যারা পরবর্তীতে যৌনকর্ম পেশায় যুক্ত হয়। আবার গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যারা লেবানন বা জর্ডানে বা মধ্যপ্রাচ্যে যায়, তাদের একটা অংশের নারীদের জোর করে এই পেশায় নিযুক্ত করা হয়। বিশ্বব্যাপী নারী পাচারের প্রধান কারণ যৌনকর্মে নিযুক্তকরণ। এতে করে বোঝা যায় এই পেশায় নারীদের চাহিদা দিন দিন কত বাড়ছে। তাই নারী পাচার রোধে বা নিরাপত্তার স্বার্থে যৌনকর্মকে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে এক দলের মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আবার আরেক দলের মানুষ চেষ্টা করছে একে অপরাধমূলককাজের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, আইনি বৈধতা দিতে, যাদের মধ্যে রয়েছে যৌনকর্মী নেটওয়ার্ক এবং এমপাওয়ারড ফাউন্ডেশন । তাদের মতে, এই পেশা নিয়ে এত লুকোচুরির ফলে এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নেতিবাচক মানসিকতার কারণে এর সাথে নারী পাচারের মত অপরাধ যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু, যদি অন্যান্য পেশার মত এটিকে গ্রহণ করা হত, তাহলে এই পেশার কর্মীদের তালিকা থাকত ফলে নতুন করে যুক্ত হওয়া কর্মীরা কি পাচারের শিকার নাকি তাদের বাধ্য করা হয়েছে, তারা কি পুনর্বাসন চায় কিনা এই বিষয়গুলো মনিটরিং করা সহজ হত এবং সমাজে এই পেশাকে কেন্দ্র করে যেসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, তার হার কমে যেত। অনেকে এই পেশার সাথে এইডস এর বিস্তারকে দায়ী করে। কিন্তু, বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মাধ্যমে এইচআইভি বা এইডস এর বিস্তার হয়েছে সবচেয়ে কম। বরং জনমানুষের অনিরাপদ যৌনজীবন যাপন যৌন রোগের প্রধান কারণ।
নলিনীর লেখায় উনি বলেছেন কোন এলাকার মানুষের আচরণ কেমন যৌনকর্মীদের সাথে। আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশে যৌনকর্মীরা নিয়মিত ধর্ষণের শিকার হয় এবং এর জন্য তারা কোথায় বিচার চাইতে পারে না। বাংলাদেশে যৌনকর্মীরা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয় নিয়মিত, যার কোন মামলা হয় না, বিচার হয় না।
আমাদের আশেপাশের পুরুষেরাই দিনশেষে যায় নারী যৌনকর্মীর কাছে, তাদের যৌন চাহিদা এবং বিকৃতির শিকার হচ্ছে যৌনকর্মীরা। কিন্তু, অপরাধী হয়ে যায় সেই নারী যে একে পেশা হিসেবে নিয়েছে। সত্যি সেকুলাস, কি বিচিত্র এই দুনিয়া!

পূর্ববর্তী নিবন্ধপটিয়ায় দুই হাজার দরিদ্র পরিবারের মাঝে হুইপের মাংস বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধঈদের হৈ হৈ-তে ধোঁয়ায় উড়া নারীর শ্রম