ঈদের হৈ হৈ-তে ধোঁয়ায় উড়া নারীর শ্রম

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ১৬ জুলাই, ২০২২ at ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

ঈদ বয়ে আনে উৎসবের সাত রঙ। ঈদের আমেজে যেন ভেসে বেড়ায় নির্ভেজাল পরম আনন্দ। মানুষের বিকাশ ও বিবর্তন জটিল, তাই বাতাসে ভেসে বেড়ানো জর্দা সেমাইর গন্ধ থেকে নাক উঁচিয়ে, ধোঁয়ায় উড়া নারীর মনের খবর নিতে একটু মনকে বিকশিত করতেই হয়। মৌ মৌ করা গন্ধে অন্য দশজন সৌরভের ঘ্রাণ পেলেও নারীর ঘামের গন্ধ পান কিনা জানা নেই। হ্যাঁ, এ ঘামের গন্ধও নির্ভেজাল।
বাংলার মায়েরা সবসময় নিজেকে বিসর্জন দিয়ে ছেলেমেয়েকে সাত-সকালে পোলাও খাওয়াতে ভালোবাসলেও আমার মাকে দেখেছি সকালে পরিপূর্ণ সেজেগুজে জর্দা-সেমাই রাঁধতে। প্রায় প্রতি ঈদে দেখতাম, কিছু সময় পর আম্মা ঘেমে যাচ্ছেন। আমরা যে-যার মত করে খেয়ে, সেজে, বেড়িয়ে কাহিল। কিন্তু আম্মা দুপুর হতে না হতেই ঘামের গোসল দিয়ে ফেলেন। একদম সন্ধ্যায় গিয়ে ক্ষান্ত হন।
এ গল্প নিশ্চয় বাংলার প্রত্যেক ঘরে। কিন্তু ভাবুন তো, ঈদের দিনই কেবল মায়েরা ঘেমে যান? সারাবছর যে মায়েরা চুল থেকে চুন অবধি মেজে যান? আর যে মায়েরা কর্মক্ষেত্রে সমান দাপিয়ে বাসায় এসেও নিঃশ্বাস নেন না? ঈদের আমেজে কি কেবল মা জাতি নাকি বাইরে যে-সকল নারী শ্রমের ধোঁয়া উড়ান তারাও শ্রমকাতুরে দীর্ঘনিঃশ্বাসী।
ঈদের সারাদিন-সারাবেলা রান্না করা, সকলকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে বাসন মাজা। এতসব কাজকে আপনারা যারা নিত্যদিনের হিসাবের খাতায় ফেলেন তাদের উচিত অন্তত ৫ মিনিট জ্বলন্ত মোমবাতির উপর মুখ ধরে রাখা। আমরা অনেকে ঘরের কাজকে ছোট করে দেখি, যারা ঘরের কাজ করে সাহায্য করছে তাদেরকে ছোট করে দেখি। এর কারণ আদিকাল থেকে আমরা দেখে আসছি এসব নারীদের কাজ। গরম ধোঁয়ায় মুখ লাল করেও নারীরা ঠিকই লবণ পরখ করেন। অতীতে আমার নানীকে দেখতাম প্রায় ১৬ ঘণ্টার উপরে তিনি কেবল রেঁধেই চলেছেন। নানার ব্যবসায়িক মানুষের সমাগম সারাদিন চলত, একটু বড় হয়ে খালাদের মুখে শুনেছি গৌরবের কথা, রাত বা দিন আমাদের বাড়িতে কেউ এলে ভাত না খেয়ে যান না। এখন ভাবতে খারাপ লাগে, সারাদিন চুলাতে ভাত চড়িয়ে রাখতো কে? কেনো বা রাখতেন?
মানুষের করা শ্রমের পরিবেশ যে-কোনো ক্ষেত্র হতে পারে। তা বাসা হোক বা বাহিরে। নারীরাই কেবল ঘরে রাঁধবেন তা যেমন ঠিক না তেমনই পুরুষেরাও কাজ করেই যাবেন তাও নয়। নিজের ব্যক্তি জীবনে প্রত্যেকের উচিত মিনিমালিস্ট হয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্যে যতদূর করে- খেতে হয় তা করা। এখন যদি বলে বসেন, পুরুষেরা সারাদিন বাহিরে কাজ করেন, ঈদের দিনও প্রায় বাহিরের সব কাজই তারা করেন। তাহলে হাস্যরসেই বলে বসতে হয়, কে বলেছে আপনাকে সব করতে? নিজের অধিকার নিয়ে কেনো আপনি সচেতন নন? কেন শ্রমের মূল্য দিতে শিখেননি? কেন কাজ ভাগাভাগি করে নিতে শিখছেন না এখনো?
আমাদের নানী-দাদীদের এত সব বিসর্জনের কথা সগৌরবে মনে রাখার চেয়ে কিছুসংখ্যক মানুষেরা শিখেছেন শ্রমকে শ্রম বলতে। টানা ১৬ ঘণ্টা কাজ করে যাওয়ার পরেও তরকারির নুন নিয়ে যে জাতি প্রশ্ন তুলে তাদের জন্যে মায়া হয়। হ্যাঁ, বলতে পারেন শ্রমের আওতায় যদি ফেলি তবে শ্রমের প্রতি আন্তরিক হতে হয়। তাহলে বলতেই হয়, ১৬ ঘণ্টার বিনিময়ে কি দিচ্ছি আমরা? যেখানে শ্রমের পারিশ্রমিক নিয়ে আমরা কথা বলতে নারাজ তাদের উচিত বাদাম খেয়ে বুদ্ধির দরজা খোলা। বর্তমান সময়তে এসব কথা ক্লিশে কেননা এখন আমরা সবাই জানি আত্মনির্ভরশীল হওয়া, নারী ও পুরুষের জন্যে কতটা জরুরি। নারীরা যেমন সকল কাজে এগিয়ে এসেছেন তেমন পুরুষদেরও উচিত মানসিকভাবে নিজেকে বিকশিত করা।
ঈদের আনন্দে আমরা মেতে উঠব। স্বাভাবিকভাবে এটা অন্যায়ের নয়। কিন্তু ঐ যে বললাম গোড়া থেকে পরনির্ভরশীল জাতি আমরা, ভুলে যাই রান্নাঘরে ধোঁয়ায় উড়া সুঘ্রাণ নারীর শ্রমের অশ্রুবিন্দু। গ্রামাঞ্চলে অনেক নারীকে এখনো দেখা যায় সারাদিন প্রচুর কাজের চাপে এতটা বেশি কাহিল হয়ে পড়ে, নিজের স্বাদমতো খেতেও পারে না। আত্মমগ্নতাকে খারাপ বলছি না, কিন্তু অন্যের উপর অত্যাচার করে না। আদর করে যদি মা মাছের মাথা তুলে দেন, তাহলে সে-জাতি মায়ের মাথা খেতেও দ্বিধা করে না। পরনির্ভরশীলতা কাটানোর চর্চা এ-ঈদের আমাজের ভেতর সেরে ফেলা যায়। কেননা আমরা মানুষ হিসেবে কতটা স্বার্থপর হয়ে উঠছি তার পরিণাম ঈদেই দেখা মেলে।
ঈদের আমেজে শ্রমজীবী নারীদের কথা ভাবতেই দুঃখ হয়। যে-সহযোগী বাসায় কাজে সাহায্য করে, তাকেও আমরা ছেড়ে দিইনি। ঈদের দিন যেখানে আমরা নিজেদের পরিবারের সাথে চরম আনন্দে মেতে উঠি কিন্তু সেখানে সহযোগীকে বাধ্য করি ঘরে এসে নিজেদের থালাবাসন মেজে দিতে। কেবল কি সহযোগীতে থেমে যায় এ জাতি? যেসব নারীরা বাইরে কর্ম করছেন তারা হয়তো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চান ছুটিতে। দেখা যাচ্ছে, সেও কাজ করে ঘাম ঝরাচ্ছেন বাকিদিনের মতই। অবশ্য কেবল ঈদে নয় সারাবছর দেখা যাবে এমন দৃশ্য।
সারাবছরের দুঃখ ভুলে ঈদের আমেজে আমরা নিজেকে রাঙ্গিয়ে তুলি। কিন্তু কতটা নিজেকে পরিশুদ্ধ করি? ঈদ মানে কেবলই উৎসব, পেট ভোজন তা নয়। ঈদ মানে নতুন দিনেরও শুরু। নতুন আনন্দের আমেজ। তবে সে আমেজে যদি অন্যকে কষ্ট দিয়ে নিজে সুখী হই তাহলে তা আর আনন্দ থাকে না। পৈশাচিক আনন্দে রূপ নেয়। প্রত্যেকের ভেতর পশুর ভালো গুণকে বাঁচিয়ে রাখুন আর বিসর্জন দিয়ে দিন নরপশুকে। ঈদের হৈ হৈ-তে ধোঁয়ায় উড়া নারীর শ্রমকে অসম্মান না করে নিজেরা আত্মনির্ভরশীল হোন, সহযোগী মনোভাব গড়ে তুলুন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌনকর্মীর পেশাগত অধিকারের লড়াই
পরবর্তী নিবন্ধকাঞ্চনা উন্মুক্ত পাঠাগারে কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা