যেভাবে সন্ধ্যা নামে

আরিফুল হাসান | শুক্রবার , ২৬ মে, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

বৃষ্টির পর বৃষ্টি নামতে থাকলে আমরা আরও অসহায় হয়ে পড়ি। ঘন জঙ্গলে আমাদের থাকার মতো আশ্রয়ের গাছের অভাব নেই। যে কোনো একটির ছায়াঘেরা নিচে আমরা বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে পারি কিন্তু আমরা তা করবো না। সাপের মাথায় পাড়া দিয়ে, বাঘের থাবার ভেতর চমকে গিয়ে আমাদের পথ চলতে হবে। এ অদৃষ্টের লিখন; আমরা খণ্ডাতে পারি না।

আমাদের সুপেয় জলের অভাব ছিলো কেনো না এখানে বৃষ্টির সাথে পড়ে এসিড আর আমরা ঝলসে যাই ঝলকেঝলকে।

গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে বুনো ভল্লুক চোখ তুলে চায়, তারপর নীরবে কেটে পড়ে। আমরা সবাই তাজ্জব হয়ে দেখি আমাদের মৃত্যু কতো অস্বাভাবিক, কতো কঠিন!

এসিড রেইনের উপচে পড়া জলধারা আমাদের শরীরকে ঠাণ্ডা করে না বরং বরফআগুন এক মিশেলে আমরা আরও কয়লা হতে থাকি আর আমাদের নিঃশ্বাসের ভেতর দিয়ে বের হয় বিক্ষিপ্ত আগুন।

পশুপাখির মাংস আমাদের প্রিয় খাদ্য আর আমরা ভক্ষণ করি নিজেদেরকেই কেনো না যাত্রাবিরতিতে আমাদের রক্তপানের তৃষ্ণা জাগে। আমরা সে তৃষ্ণা হতে নিবৃত্তির জন্য নিজ নিজ গলার নিচে ছুরি চালাই আর তারপর একের রক্তে অপরের তৃষ্ণা নিবারণের মহৎ কর্মটি হয়ে গেলে আমরা আবার পন্থে মেলা দেই।

আমাদের এপথ ফুরায় না। উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে আমরা এখন এসে পড়েছি ঘন সবুজের বৃষ্টিময় অঞ্চলে। মাইলের পর মাইল আমরা হাঁটছি আর আমাদের পায়ের নিচে হাঁটছে পথ ঠিক যেনো কোনো সরিসৃপ ছুটে যাচ্ছে আঁকাবাঁকা।

এখানে গহীন বনে কোনো মানুষ নেই। আমরাও মানুষ কিনা এই মুহুর্তে সন্দেহ হচ্ছে। তবু আমরা মানুষের মতোই হাঁটছি আর আমরা যখন সর্বশেষ মানুষ দেখেছিলাম সে তারিখটি এখন মনে নেই। আমরা যখন জনপদটির কাছে যাচ্ছিলাম আমাদের মনে হয়েছিলো কোনো স্বর্গে যাচ্ছি আর আমরা যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলাম ততই আমাদের কাছে ধেয়ে আসছিলো মরণ।

আমরা দেখলামএকপাল মানুষ কি অন্য কোনো প্রাণী ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমরা হকচকিয়ে দৌড়াতেও ভুলে গিয়েছিলাম, মূলত ভুলে গিয়েছিলাম আরেকটি কারণে যে আমরা তো আসলে মরতেই চাই আর মৃত্যু যেহেতু অবধারিত তাহলে এর থেকে পালিয়ে লাভ কী? তবু সেদিন যখন আমরা মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলাম তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছিলো মৃত্যু থেকে ক্রমাগত পলায়নপরতাই জীবন।

সেদিন সেই নামহীন মেয়েটি যদি আমাদের ছাড়িয়ে না দিতো তাহলে আমরা নিশ্চিত মারা পড়তাম আর নামহীন, ভাষাহীন একজন অথবা বনপদের ভেতর আমাদের দেহগুলো ভিজতে থাকতো অম্লবৃষ্টিতে। এখনও আমরা ভিজি, তবে দেহেতে যে প্রাণ আছে তা নিজেও টের পাই।

সেদিন, সেই নাম না জানা মেয়েটি আমাদের কাছে আসলো এবং তার পিছু পিছু আরও দশআটজন যুবক ও দুই জন যুবতী আসলো। দলের অগ্রভাগের মেয়েটি আমাদের সবার মুখের দিকে চেয়ে থাকলো দীর্ঘক্ষণ ধরে। চেয়ে থাকলো চোখের দিকে। কী জানি কী হলো, সে আমার দিকে চোখ ফেরাতে না ফেরাতেই আমি তার চোখের ভেতর ডুব দিলাম। এই বৃষ্টিবিধৌত সবুজ বনের ভেতর আমি এক অন্যচিত্র দেখতে পেলাম, যাতে ছিলো মায়া অথবা কোনো ভাষা। সে চোখ নাচালো, আমারও দু’চোখ যেনো কেঁপে উঠলো কেনো। একমুহুর্ত মৃত্যুকে দূরে ঠেলে তাকে দেখতে থাকলাম। উন্মুক্ত বক্ষযুগলে দুটো বুনোফুল ফুটে আছে। নাভীর নিচে সবচেয়ে সুন্দর গিরিখাত। সবচেয়ে সুন্দর তার আশ্চর্য দুটো চোখ।

আমি সে চোখের নেশায় কতক্ষণ তাকিয়ে আছি জানি না। মেয়েটি আমার হাত টেনে তার বাহুর বন্ধনে জড়ালো আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেঁটে গেলাম তার সাথে। আমার বন্ধুরা কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো হয়তো আমার স্বার্থপর চলে যাওয়ার দিকে, হয়তো তাকায়নি। তারা হেসেছিলো হয়তো অথবা তারা হাসেওনি, কাঁদেওনি একদম। হয়তো তারা দেখেনি এসব।

মেয়েটি আমাকে একটি সহস্রবর্ষী গাছের নিচে নিয়ে গিয়েছিলো যার গোড়ার ব্যাস ছিলো একটি হাঁটাচলা মাঠের সমান। যার নীচে, আকাশ থেকে নেমে আসা ঝুলের ফাঁকে ফাঁকে আমরা লুকোচুরি খেলেছি আর খেলেছে সময়। কতক্ষণ ছিলাম জানি না। সে যখন আমায় খুঁজে পেলো তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই আর আমি যখন তাকে খুঁজে পেলাম তখন রাত নেমে আসছে।

আমি তাকে তাড়া দিলাম, আর সে তখন চাঁদের আলোয় আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো সেখানে যেখানে আমার সব বন্ধুরা বন্দী হয়ে আছে। সে তাদের হাতের বাঁধন খুলে দিলো। চোখের ইশারায় আমাকেও বললো যেতে। আমি যেতে চাইলাম না। তার হয়ে থেকে যেতে চাইলাম। সে তখন জ্যোৎস্নারাতের উদ্ভাস মেখে একমুখ হেসে আমার চোখের দিকে চাইলো। এবার আমি তার হাতটাকে নিজের বাহুতে বন্দী করলাম। তাকে নিয়ে চললাম উন্মুক্ত কোনো প্রান্তরে। সেখানে চাঁদের আলোতে তার মুখ তুলে ধরলাম করপুটে। দেখলাম চাঁদ নয়, এ যুবতী সহস্রচাঁদের চেয়ে সুন্দর।

মেয়েটি আমাকে বিদায় করে দিলো। দেবার সময় চোখের ভাষায় বললো, আমাদের পোশাক নেই, সম্ভ্রম কী আমরা বুঝি না; পারো তো তোমার সম্ভ্রমটা আমাকে দিয়ে যেও। আমি বললাম (অবশ্যই চোখের ভাষায়), তোমার নগ্নতাই সবচেয়ে সুন্দর। ফুল যেমন জামাকাপড় পড়ে না, উলঙ্গ অসভ্য ফুটে থাকে, তুমিও তেমনি ফুটে আছো সভ্যতার পোশকী নগ্নতার বিপরীতে। সে আমার চোখে চোখ রেখে হাসলো। আমি সে হাসির জবাব দিলাম।

আমরা হাঁটছি। বন থেকে বনের অভ্যন্তরে, আরো অভ্যন্তরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে সবুজ হয়ে গেলাম। আমাদের ছায়াগুলো সবুজ, আমাদের মাটির দিকে তাকিয়ে দেখা দৃষ্টিও সবুজ। আমরা দেখলাম, মেঘ ঝরে পড়ছে বৃষ্টি হয়ে, তাও সবুজ।

এতোসব সবুজের ভেতর আমাদের চোখের জ্বালা কমে না। আমরা বনের পরে বন অতিক্রম করে যাই আর বেঁচে থাকা নামক প্রহসনে অংশগ্রহণ করি।

আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে এবনটি পেরুতে না পেরুতেই মৃত্যু এসে আমাদেরকে হামলে নেবে। কিন্তু আমরা নিশ্চিত নই, তাই যতটা সম্ভব কম বিশ্রাম নিয়ে, কম খেয়ে আমরা পথ চলতে থাকি। তবু আমাদের হাঁটা পথে ফলের গাছগুলো উজার হতে থাকে, বন্য প্রাণিগুলো নিশ্চিহ্ন হতে থাকে আর শুকিয়ে যায় ঝর্ণাধারা আমাদের তৃষ্ণার কাছে।

তৃষ্ণা বেড়ে গেলে আমরা নিজেদের রক্ত পান করি। গরম গরম বুদ্বুদ উঠা রক্তের চেয়ে আর সুপেয় কী হতে পারে?

রক্তের নেশায় আমরা যখন আমাদের নিজেদের গলাগুলো কাটি আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে তখন সেটি দেখার মতো একটি ব্যাপার হয়। আমরা একেকজন তখন ভাইপার হয়ে অন্যের টুঁটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি আর মরুভূমির তৃষ্ণার মতো আমাদের তৃষ্ণা তখন শতগুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এসিড বৃষ্টি আমাদের জবেহ করা গলার উপর পড়ে। জ্বালা করে উঠে ক্ষতস্থানে।

আমরা আবার উঠে দাঁড়াই। পরস্পরের উষ্ণতা পানে আমাদের দেহগুলো আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলে আমাদের যাত্রা আবার শুরু হয়। সবুজ বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে, গাছপালা পাখিদের ভাষার অভ্যন্তর দিয়ে, অরণ্যের নির্জন নিবিড়তার ভেতর দিয়ে আমরা চলতে থাকি। আমাদের চলার ছন্দে বৃষ্টিরা পতিত হয়, আমাদের গতির গমকে শ্বাপদেরা পথ ছেড়ে দূরে পালায়। থাবাগুলো আমরা ছিঁড়ে ফেলি পথ চলতেচলতে।

তবু জানি, মৃত্যুই আমাদের গতিপথ ঠিক করে, মৃত্যুর দিকেই আমরা ক্রমধাবমান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে বাকবিশিসের স্মারকলিপি প্রদান
পরবর্তী নিবন্ধলেখককে শেষ শব্দটি লিখে ফেলবার সঠিক মুহূর্তটি খুঁজে পেতেই হবে এবং নিজেকে থামাতে হবে