লেখককে শেষ শব্দটি লিখে ফেলবার সঠিক মুহূর্তটি খুঁজে পেতেই হবে এবং নিজেকে থামাতে হবে

ভাষান্তর: এমদাদ রহমান

পাত্রিক মদিয়ানো | শুক্রবার , ২৬ মে, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

পারি’র মেট্রো লাইন ৪ থেকে সেবাস্তোপল নামতেই মুরাকামির উপন্যাসের প্রবেশপথের পাথরের কথা মনে পড়ল। পাথরটি কি এখানেই আছে? এখানেই কোথাও? সিঁড়ির ধাপে, অলক্ষ্যে? একটু যেন গোলকধাঁধায় পড়ে গেলাম। কেউ একজন অতলে ডুবে আছেনের মতো পাশ দিয়ে চলে গেলেন। হোসিনোসানের মতো তাকে বলতে ইচ্ছে করলোকাকু, আপনিই কি পাত্রিক মদিয়ানো? যদি সত্যিই মদিয়ানো হয়ে থাকেন, তো চলুন একসঙ্গে কফি খাওয়া যাক তিনি আমার কথা বুঝতে পারলেন না, না কি শুনতেই পেলেন না কে জানে!

আহ, এখন যদি মুরাকামির ‘সমুদ্রতটে কাফকা’ উপন্যাসের নাকাতাসানকে পাওয়া যেত! যাক, গোলকধাঁধা পেরিয়ে ভূতলস্টেশন থেকে উপরে উঠে এলাম। এপ্রিলের সূর্য কফির তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিল। পাশেই রেস্তোরাঁ। ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ (চিন্ময় গুহ) রেস্তোরাঁয় (ক্যাপিতাল ক্যাফে, সেবাস্তোপল) ঢুকে পড়লাম, মদিয়ানো কাকু তখন চুমু খাচ্ছেন ঠোঁটে নয়, কফির কাপে। একটু যেন ঘোরগ্রস্ত। কী যেন খুঁজে চলেছেন আমি হোসিনোসানের মতো, তাকে বলিকাকু কি পেছনের ডাক কখনও শুনতে পান না? আমার কথায় তিনি যেন আরও কিছুটা ঘোরগ্রস্ত হলেন; তাকে দেখাচ্ছিল বিষণ্ন, একাকী; তারপর, জরুরি কিছু হারিয়ে ফেলেছেনএমন ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেলেন। পরিচারিকা সাকুরাসান বলল তিনি এমনই। হয়ত সন্ধ্যেয় এসে পয়সা দিয়ে যাবেন। এখন নিজেকে খুঁজতে গেছেন। চিন্ময় গুহ মদিয়ানো সম্পর্কে বলছেন

মদিয়ানো মানে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি, কথা, নাকথা। ফিসফিসানি। তাঁর উপন্যাসের নাম যাতে তুমি এপাড়ায় না হারিয়ে যাও, অন্ধকার দোকানের পথ, বিষণ্ন ভিলা, রাত্রির ঘাস, দিগন্ত, অচেনারা। শেষ না হওয়া ঘটনা, নামহীন মানুষ, ভেঙে যাওয়া হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়ানো। নিঃশব্দ, শব্দ সেখানে পা টিপে টিপে হাঁটে। যেন জেরার দ্য নেরভালএর রচনা পড়ছি। অশরীরীরা ঘোরে, টেবিলের ওপর, বাথরুমে, রাস্তায়। ছায়াকে তুমি বলে সম্বোধন করেন। স্মৃতির পাতালজলে দাঁড়িয়ে মানুষের রহস্যমেদুর ভবিতব্যকে বুঝতে চান। আমাদের বিরাট বিস্মৃতি, আমাদের ছোট ছোট আশা। কোনও মঞ্চে মদিয়ানোকে দেখা যায়নি। কোনও স্বীকৃতি তাঁর অভিপ্রায় নয়। তাঁর শুধু প্রয়োজন পাঠকের ‘ডিসক্রিট অ্যাডিকশন’।

গভীর, কিন্তু হালকা। যেন একটি ডানাভাঙা পাখির বুকের ধুকপুকুনিকে হাত দিয়ে অনুভব করছি। অতীতচারী দুঃখবিলাস নয়, এই লিখনের পিছনে কাজ করছে সুশিক্ষিত ফরাসি মনের অপূর্ব নিয়ন্ত্রণ। সুইডিশ অ্যাকাডেমি যে মার্সেল প্রুস্তের কথা বলেছে, তা অসত্য নয়। ষোলো বছর বয়সে পড়তে শুরু করে প্রুস্তের হারিয়ে যাওয়া সময়ের সন্ধানে নামক মহাউপন্যাস কুড়ি বছর বয়সে শেষ করেন মদিয়ানো। কিন্তু তাঁর স্মৃতি অন্য রকম স্মৃতি।

মদিয়ানোর জন্ম ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে প্যারিসের পশ্চিম প্রান্তে বুলনবিয়াঁকুরে। মা ফ্লেমিশভাষী বেলজিয়ান অভিনেত্রী। বাবা ইতালীয়। ফ্রান্সে নাৎসি অবস্থানের সময় তাঁদের দেখা হয়েছিল। মা পাত্রিককে দেখেননি। আত্মকথা য়্যঁ পেদিগ্রেতে মদিয়ানো লিখেছেন, তাঁর মাকে একটি কুকুরছানা উপহার দিয়েছিলেন তাঁর প্রেমিক। মা সেটিকে দেখেননি, সে জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। মা পাত্রিককেও দেখেননি। কোথায় যেন হারিয়ে যান। আর বাবা? পাত্রিক আবিষ্কার করেন, ফ্রান্সে নাৎসি অবস্থানের সময় তাঁর বাবা ছিলেন ‘কোলাবো’, অর্থাৎ কোলাবোরেটর।

ফরাসি দেশে কোনও বড় শিল্পীসাহিত্যিক ‘কোলাবো’ হবেন না, এমনই আশা করা হয়। সরকারের দালাল শিল্পী হবেন কী করে? কিংবা শিল্পী কী করে দালাল হবে? যে নগণ্য লেখকরা নাৎসি অবস্থানের সময় ‘কোলাবো’ হয়েছিলেন (যেমন দ্রিয় লা রশেল ও সেলিন) তাঁদের জন্ম ছাপ আজও ঘোচেনি।

মদিয়ানোর অতীত এক সামগ্রিক সমাজেতিহাসের অতীত। অতীত যা আঠার মতো সারা শরীরে, স্নায়ুর নীচে, হাড়ের কোটরে, পায়ুদ্বারে লুকিয়ে রয়েছে, যাকে ছাড়ালেও ছাড়ে না।

মদিয়ানো যেন এক গোয়েন্দা, যিনি বিস্মৃতির আয়নার ঘরে একটি মোমবাতি নিয়ে খোঁজেন। কী খোঁজেন? নিজেকে, ইতিহাসকে, মানুষকে? কথাকে, যা নতুন করে জেগে উঠবে আবার নাকথার হারানো সুতো ধরে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (যা জন্ম দিয়েছিল কাম্য আর সার্ত্রএর) এক বছর পর মদিয়ানোর জন্ম, অথচ তাঁর সারা গায়ে ক্ষতচিহ্ন। কোথাও কোনও জ্ঞানদান করেন না। সাধারণ পাঠক থেকে বিশেষজ্ঞ সকলকে এক ছায়া, আলো, শূন্যতার বলয়ে ডেকে নেন তিনি।

(বিষণ্ন, একাকী এক কণ্ঠস্বর/চিন্ময় গুহ)

অনূদিত এই সাক্ষাৎকারটি মূলত দুটি আলাপের সমন্বয়, একটি নিউইয়র্ক টাইমসের সানডে বুক রিভিউ বিভাগে ছাপা হয় ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে, দ্বিতীয়টি নোবেল কমিটির পক্ষে প্যারিসে জেসিকা গাদোঁ’র নেওয়া সাক্ষাৎকার, ২০১৪ সালের।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: খাটের পাশের টেবিলে কোন বইগুলো এনে রেখেছেন?

পাত্রিক মদিয়ানো: প্রায়ই যেবইগুলো পড়ি, খুব পড়তে হয় যাদেরএমন বইয়ে গাদাগাদি হয়ে আছে, আর কিছু ক্ল্যাসিক আছে এরকম অনেক, আমাকে ক্ষমা করতে হবে; এসব নিয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, এখন একটা উপন্যাস লেখার মাঝে আছি, একটানা লিখছি; ক্ষমা করবেন আপনাকে টেবিলের বইপত্র নিয়ে খুব সংক্ষেপে কিছু বলতে পারি

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: মহৎসাহিত্য কি খারাপভাবে লেখা যায় বা যাবে? কীভাবে বাজে গদ্যকে লেখক এড়িয়ে যাবেন? কোনওভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায়?

মদিয়ানো: কোনোভাবেই নয়। একটি মহৎ বইয়ের থাকবে এক অবিস্মরণীয় শৈলী (স্টাইল), যার ভেতর নিঃশব্দে বইবে এমন এক সঙ্গীত যা কোনও দিনও বিস্মরণের নয়।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: কোন বইগুলো আপনাকে পাঠের শ্রেষ্ঠতম অভিজ্ঞতা দিয়েছে বলে মনে করেন?

মদিয়ানো: এমন বইয়ের সংখ্যা এক দু’টি তো নয়, অসংখ্য। স্তাঁদাল, ডিকেন্স, বালজাক, তল্‌স্তোয়, চেখভ, মেলভিলসহ ঊনিশ শতকের সমস্ত মহান লেখক; তাঁদের সঙ্গে আঠার শতকের কয়েকজনকে যুক্ত করে নেব: এবে প্রিভো, রেতিফ দ্য লা ব্রেতোঁ, এবং দুক দ্য স্যাঁসিমনের স্মৃতিকথা ইত্যাদি।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: বিশ শতকের লেখকদের ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সমালোচক, সাংবাদিক, কবিমধ্যে সবচেয়ে বেশি কার মুগ্ধ অনুরাগী আপনি?

মদিয়ানো: একদম শুরু থেকেইসেই ষোলসতের বছর বয়স থেকে হেমিংওয়ে, কারসন ম্যাককুলার্স, চিজার পাভেসে, ম্যালকম লোরি, এবং একজন কবিডব্লিউ. বি. ইয়েটস; এবং অবশ্যই টমাস মানের ‘দ্য ম্যাজিক মাউন্টেন’।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: ফ্রান্স সম্পর্কে বিশদে জানতে চান এমন কাউকে কোন বইটি পড়তে বলবেন?

মদিয়ানো: ফ্রান্স সম্পর্কে? আমার সত্যিই জানা নেই। কিন্তু কেউ যদি প্যারিস সম্পর্কে পড়তে চান, তাহলে আমি তাকে একটি মার্কিন বই পড়তে বলব, আর সে বইটি অবশ্যই হেমিংওয়ের চলমান ভোজের শহর।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: একটি সাহিত্যকর্মের কোন দিকটি আপনাকে বেশি নাড়া দেয়?

মদিয়ানো: অবশ্যই, লেখার শৈলী (স্টাইল), এবং সঙ্গীত। একটি বইয়ের যে দিকটি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় তা হলএকদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই কণ্ঠস্বর যখন আমার সঙ্গে কথা বলে।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনাকে আবেগতাড়িত করবে কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আলোড়িত করবেকোনটি আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?

মদিয়ানো: যে বই আমাকে অনুভবের তীব্রতা দেয়, আবেগতাড়িত করে।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: সংগ্রহের বইগুলো কীভাবে সাজিয়ে রাখেন?

মদিয়ানো: বই গোছানো ব্যাপারটা আমার জন্য বেশ জটিলই বলা যায়। সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখতে অনেক লোক লাগবে, দুচারজনে কিছুতেই হবে না। একজন কার্ডফাইলিং সিস্টেম তৈরি করবেন, যেখানে লেখকদের নাম, এবং তাদের বইয়ের নাম বর্ণানুক্রমিকভাবে লিখিত হবে। এটি মূলত প্রতিটি বইয়ের সঠিক অবস্থান নির্দেশ করবে, কারণআমি প্রায়শই ঘণ্টা, এমনকি পুরো একটি দিন, কয়েক সপ্তাহ, কখনও এমন হয়েছে যে পুরো এক মাস ধরে কোনও একটি বই খুঁজি এবং অনেক সময় হয় কীবইটি কোথাও খুঁজে পাই না। বইটি লুকিয়ে থাকে। রাখার জায়গা ছিল না বলে কোনও এক সময় আমাকে প্রায় পাঁচ হাজার বই দিয়ে দিতে হয়েছিল। এখন মনে হয় ওই পাঁচ হাজার বইয়ের তালিকা তৈরি করে ফেলা দরকার ছিল, কারণ বইয়ের নাম আমার খুব একটা মনে থাকে না। ভুলে যাই। মাঝে মাঝে হয় কী, বইটি কোথায় আছে বুঝতে না পেরে বইয়ের স্তূপে অনবরত তাকে খুঁজতে থাকি। খুঁজতেই থাকি।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনার সংগ্রহের কোন বইগুলো দেখে যে কেউ বিস্মিত হবে?

মদিয়ানো: শেলফে থাকা অসংখ্য টেলিফোন ডাইরেক্টরি, সমস্ত ধরণের: ১৮৩৫ থেকে ১৯৭০ সালের সবগুলো প্যারিস ডাইরেক্টরি, লন্ডন এবং বার্লিনের টেলিফোন ডাইরেক্টরি, তিরিশের দশকের সবগুলো বাণিজ্যিক ডাইরেক্টরি, ইউরোপের শহরগুলোর টেলিফোন ডাইরেক্টরি, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রকাশিত টেলিফোন ডাইরেক্টরি, সমস্ত সোশ্যাল রেজিস্ট্রার, মুভি থিয়েটার, রঙ্গমঞ্চ (প্লেহাউস), ড্যান্স এবং মিউজিক হলগুলোর ডাইরেক্টরি যেখানে হাজার হাজার হারিয়ে যাওয়া কিংবা নিখোঁজ মানুষের ঠিকানা লিপিবদ্ধ আছে।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: ছেলেবেলায় কেমন পাঠক ছিলেন? সে সময়ের কোন কোন বই এবং লেখক এখনও আপনাকে তাড়িত করেন?

মদিয়ানো: আমরা যে প্রজন্মের, তাঁরা কিন্তু প্রচুর পড়ার সুযোগ পেয়েছি। ছোটবেলায়। হ্যাঁ। আমাদের সময় এতো টিভি ছিল না। ইন্টারনেট ছিল না। প্রচুর পড়ার সুযোগ পেয়েছি। আমি স্টিভেনসনের ট্রেজার আইল্যান্ড, মার্ক টোয়েন আর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারস্যনের লেখগুলো, অ্যান্থনি হোপের ‘দ্য প্রিজনার অফ জেন্ডা’, ব্যারোনেস ওর্কজি’র ‘দ্য স্কারলেট পিম্পারনেল’, মার্সেল এইমে’র ‘লে কন্তে দ্যু শা পর্শে’ এবং আলেকজান্দ্র দ্যুম্য’র ‘দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্সএই বইগুলো বারবার পড়তে পছন্দ করতাম।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: বই কি পাঠককে তাঁর নীতিবোধের জায়গা বদলাতে সাহায্য করে? কী মনে হয় আপনার?

মদিয়ানো: একটি বই আপনাকে যখন রোমাঞ্চিত করে, একদম ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেয়, তখন বুঝতে হবে বইটি কাজ করতে শুরু করেছে। সে তার পাঠককে আরও বেশি সংবেদনশীল ব্যক্তি করে তোলে। আপনি একেবারেই বদলে যান। ব্যাপারটা বিস্ময়কর। পাঠকের সঙ্গে বইয়ের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া এমনই।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: লেখক হলেন কীভাবে?

মদিয়ানো: আর কিছু জানতাম না বলেই লেখক হয়েছি, হয়তো ছেলেবেলার কোনও ঘটনা আমাকে প্রভাবিত করেছে। হ্যাঁ, এমন তো হতেই পারে। ফেনিমোর কুপারের ‘দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস’ পড়েছিলাম ছ’বছর বয়সে, তখন বইটির অনেক কিছুই ধরতে পারিনি; না পারলেও পড়ে শেষ করেছি। সম্ভবত সেই পড়ার আবেশ আমাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে পরবর্তী জীবনে লেখক হতে পেরেছিলাম। ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম কিন্তু বিজ্ঞান পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। একসময় লিখতে শুরু করেছি। লেখাই একমাত্র জিনিস যা আমি জানতাম, এভাবেই জীবন এখন চলছে অনেকটাই স্নোবলএফেক্টের মতো।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: আপনি কীভাবে কাজ করেন? কীভাবে একটি উপন্যাস শুরু হয়?

মদিয়ানো: উপন্যাস শুরু করাটাই কঠিন। আপনি যা লিখতে চান তা কিন্তু স্বপ্নের মতো আপনার ভেতরেই আছে, এখন শুধু জলে নেমে যেতে হবে কিন্তু জল তো বরফশীতল একবার শুরু করলে আপনাকে প্রতিদিন লিখতে হবে, অন্যথায় আপনি গতি হারাবেন। আগে সারাদিন লিখতাম আর এখন প্রতিদিন ভোরে লিখি, লেখা দ্রুত শেষ করার জন্য ভোর খুবই জরুরি আমার জন্য, তাও মাত্র কয়েক ঘন্টা লিখতে পারি, তারপর ধীরে ধীরে আমার মনোযোগ অন্যখানে চলে যায়, লেখা জিনিসটিকে তখন খুব ঝাপসা লাগে।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: উপন্যাসের শেষটা জেনে তারপরই কি লিখতে শুরু করেন?

মদিয়ানো: উপন্যাস কোথায় শেষ হবেএটা জানা লেখকের জন্য কঠিন। একারণে সবসময়ই আমি কয়েকজন ‘ক্রাইমফিকশন’ লেখককে হিংসা করেছি যারা শেষের পূর্বাভাস আগে দিতে পারতেন। শেষ না জানাটা আসলে কঠিন পরিসি’তি তৈরি করে। ঠিক কোথায় যাচ্ছেন তা না জেনে অবিরাম লেখাটা চালিয়ে যাচ্ছেন, যেতে বাধ্য হচ্ছেন, যদিও শেষের দিকে আপনি কিছু একটা অনুভব করবেনই, মানে শেষটার আভাস লেখক তখন পেয়ে গেছেন। কখন এবং কোথায় লেখাটি সমাপ্ত হবে তা জানাটা খুবই সূক্ষ্ম একটি বিষয়লেখককে শেষ শব্দটি লিখে ফেলবার সঠিক মুহূর্তটি খুঁজে পেতেই হবে এবং নিজেকে থামাতে হবে

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: কীভাবে শুরু হয়

মদিয়ানো: আমাকে একটা বাস্তবের জীবন দেখতে হবে, একদম চোখের সামনে; একটা জায়গাকে দেখতে হবে, যেজায়গাটির বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে; একটি রাস্তা কিংবা একটি বাড়ি, যেবাড়িতে ঘটনাগুলো ঘটছে, সবকিছু, এবং যেখান থেকে আমি আমার স্বপ্নদেখা চালিয়ে যেতে পারি। আমার একটি বই পাতালট্রেন থেকেই শুরু হয়ে যায়, যেখানে আছে একটি মেয়ে, যে বিশ্বাস করে যে সে তার মাকে দেখছে যাকে সে দীর্ঘদিন ধরে দেখেনি, এবং মেয়েটি তাকে অনুসরণ করতে শুরু করে, এভাবেই

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: যখন শুনলেন যে আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তখন কী করছিলেন?

মদিয়ানো: কিছুটা অদ্ভুত, হঠাৎ চমকে উঠার মতো; তখন হাঁটছিলামপ্যারিসে, লুঙ্মেবার্গ গার্ডেনের খুব কাছের র‌্য দি’আসাজ ধরে, তখন আমার কন্যা ফোন করে খবরটা জানায়। আমি তখন র‌্য দি’আসাজের ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে এক সময় আগস্ট স্ট্রিন্ডবার্গ (১৮৪৯১৯১২, সুইডিশ লেখক) থাকতেন; হ্যাঁ, প্যারিসের এই জায়গাটিতেই থাকতেন তিনি; আর আমি আসলে জানি না, ব্যাপারটি কী!, তবে স্ট্রিন্ডবার্গ, সুইডিশ নোবেল সংযোগটি এক অদ্ভুত কাকতালীয় ঘটনা।

সাক্ষাৎকারগ্রহণকারী: শুধু লেখালেখির জগতের মানুষরাই থাকবেন, ধরুন এমন একটি নৈশভোজের আয়োজন করছেন, সেই ভোজে (জীবিত কিংবা এখন আর বেঁচে নেই) কোন তিনজন লেখককে আমন্ত্রণ জানাবেন?

মদিয়ানো: আমি সত্যিই জানি না লেখকদের নিয়ে এমন কিছু করা কতোটাএরকম আয়োজনে কিছুটা জটিলতা আছেই। লেখকরা যদি ইতোমধ্যেই পরস্পরের বন্ধু না হোন, পূর্বপরিচয় না থাকে, তাহলে একে অপরকে বলার মতো কোনও কথাই হয়ত তাঁদের থাকবে না। এসব ব্যাপার আমি ভয় পাই। একবার, প্রুস্তের সঙ্গে জয়েসের দেখা হলো, এই প্যারিসেই, এক সভায়। দু’জনই আমন্ত্রিত ছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে তাঁদের একমাত্র কথা বিনিময় ছিল:

বৃষ্টি হচ্ছে।’

আপনার কি ছাতা আছে?’

না।’

আমারও নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযেভাবে সন্ধ্যা নামে
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে ইয়াবাসহ আটক ২