ম্যালেরিয়া : পাহাড়ে মৃত্যু কমলেও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সীমান্ত

প্রান্ত রনি, রাঙামাটি | বৃহস্পতিবার , ২৫ এপ্রিল, ২০২৪ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

ম্যালেরিয়ার ‘হট স্পট’ পার্বত্য চট্টগ্রামে মৃত্যুহার কমে আসলেও শূন্যের কোটা থেকে তা বেশ দূরেই। এর প্রধান কারণ সীমান্ত অঞ্চল। আক্রান্ত রোগীর মধ্যে সীমান্ত এলাকার মানুষই বেশি। বিশেষত রাঙামাটির চারটি সীমান্তবর্তী উপজেলায় আগে ৭৫ শতাংশ আক্রান্ত থাকলেও এখন সেটি দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশে। ২০১৭ সালের পর রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় মৃত্যু শূন্য হলেও খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে মশাবাহিত এই রোগে মৃত্যু থামছেই না। ২০১৭ সালের পর খাগড়াছড়িতে তিন ও বান্দরবানে ১১ জনের মৃত্যু হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, পার্বত্য জেলা তিনটি দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার সঙ্গে। ভারতমিয়ানমারে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ বেশি থাকায় এর প্রভাব ফেলছে পার্বত্য চট্টগ্রামেও। এতে করে শহরাঞ্চলে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত কমে আসলেও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সীমান্ত।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ১৫৮ জন ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেছে। সংখ্যাগত দিক দিয়ে ৫০৩ জন রোগী পাওয়া গেছে রাঙামাটিতে; বান্দরবানে ৪৬০, খাগড়াছড়িতে ৪০, কক্সবাজারে ১৩৮ ও চট্টগ্রামে পাওয়া গেছে ১৩ জন। পার্বত্য জেলায় কোনো মৃত্যু না হলেও চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে দুজন মারা গেছেন। ২০১৭ সালের পর রাঙামাটিতে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু শূন্য হলেও ২০১৯, ২০২১, ২০২৩ সালে খাগড়াছড়িতে তিনজন; বান্দরবানে ২০১৭ সালে একজন, ২০১৯ সালে দুজন, ২০২০ সালে দুজন, ২০২১ সালে চারজন ও ২০২৩ সালে দুজন মারা গেছেন।

রাঙামাটি সিএস অফিসের ম্যালেরিয়া বিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০২ সালে রাঙামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর পাহাড়ি এ জেলায় ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে মৃত্যুহার। সর্বশেষ ২০১৬ সালে রাঙামাটিতে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে, ২০০২ সালে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০০৩ সালে ১১৯, ২০০৪ সালে ১০৪, ২০০৫ সালে ৯৬, ২০০৬ সালে ৭৫, ২০০৭ সালে ৫২, ২০০৮ সালে ২৪, ২০০৯ সালে ১২, ২০১০ সালে ১০, ২০১১ সালে ৫, ২০১২ সালে ১, ২০১৩ সালে দুজনের মৃত্যু হয়।

সিএস অফিসের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে রাঙামাটির ১০ উপজেলায় মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী ছিল ৮ হাজার ২৮৭ জন। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী চার উপজেলা বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল ও বাঘাইছড়িতেই ছিল ৬ হাজার ১৮৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৭৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ৭১৩ জন। সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ২৪১ জন; যা মোট আক্রান্তের ৯০ শতাংশ। ২০১৭ সালপরবর্তী রাঙামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া আক্রান্তের হার ওঠানামা করলেও সীমান্তবর্তী চার উপজেলায় এ হার ঊর্ধ্বমুখী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে হলে ম্যালেরিয়া ছড়ানোর জীবাণু ও বাহক ধ্বংস করতে হয়। জীবাণু ধ্বংস করা সম্ভব হলে মশা কামড়ালেও ম্যালেরিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। আবার জীবাণু ধ্বংস না হলেও যদি মশার বিস্তার ধ্বংস করা যায় সেক্ষেত্রে বাহকের অভাবে ম্যালেরিয়া ছড়ানোর সুযোগ থাকবে না। তবে মশা নির্মূল করা না গেলেও শহুরাঞ্চলে মশার জীবাণু ধ্বংস কার্যক্রম অনেকটা এগিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ অনেকটা কমে এসেছে শহুরাঞ্চলে। তবে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজলভ্য হওয়ায় জেলা সদরের কাছাকাছি উপজেলাগুলোয় ম্যালেরিয়া আক্রান্তের হার কমলেও দুর্গম ও সীমান্তবর্তী এলাকায় ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির রাঙামাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার ডা. এন্ড্রু বিশ্বাস আজাদীকে বলেন, রাঙামাটির ১০টি ইউনিয়নে ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেলেও বিলাইছড়ির বড়থলি ও ফারুয়া, বরকলের আইমাছড়া ও বড় হরিণা এবং জুরাজড়ির মৈদং ইউনিয়নের রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। রাঙামাটির সীমান্তবর্তী এই চারটি উপজেলাতে মোট আক্রান্তের ৯০ শতাংশ রোগী পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৭ সালে আক্রান্ত ৭৫ শতাংশ থাকলেও এখন ৯০ শতাংশ হয়েছে। সীমান্তের ওপাড়ের ভারতমিয়ানমারে ম্যালেরিয়া নির্মূলে কার্যকর কর্মসূচি না থাকায় ওইদেশের প্রভাব ফেলছে বাংলাদেশেও। গত বছরও রাঙামাটির সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে প্রায় ৬০০ রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন; যারা অন্যদেশের বাসিন্দা। চিকিৎসার জন্যই তারা বাংলাদেশে এসেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, সীমান্তবর্তী ওইসব এলাকার মশাও এপারে আসে। সীমান্ত খোলা হওয়ার কারণে অনেক সময় মানুষ যাতায়াত করে। সীমান্তবর্তী এসব এলাকা ঘন বন, গহিন জঙ্গল ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে মশার বিস্তার বাড়ছে।

দুর্গম এলাকার মানুষেরা অনেক অসচেতন বলে মনে করেন বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমানও। সিএস মাহবুবুর আজাদীকে বলেন, ২০২৩ সালেও বান্দরবানে দুজন ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। জেলার লামা, আলীকদমে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কিছুটা বেশি। পার্বত্য এলাকা এমনিতেই ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকায়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই চাইলেই ম্যালেরিয়া নির্মূল করা যাবে না। আক্রান্ত ওইসব এলাকার মানুষ কিছুটা অসচেতন ও গহীন জঙ্গল এলাকা হওয়ায় সেখানে ম্যালেরিয়া ঝুঁকি বেশি।

রাঙামাটির সিভিল সার্জন (সিএস) ডা. নূয়েন খীসা আজাদীকে বলেন, আমাদের তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশের চিকিৎসাসেবা অনেকটা অপ্রতুল। এদেশে মেডিকেল ক্যাম্প হলে অনেক সময় তাদের অনেকে এখানে এসে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন। তবে বিগত কয়েকবছর ধরে সীমান্ত সড়কের কাজ নির্মাণকাজে জড়িত শ্রমিকরাও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন; যাদের বেশিরভাগই বাঙালি শ্রমিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস
পরবর্তী নিবন্ধতীব্র গরমে তাপের সাথে সাপও বাড়ে যে কারণে