কয়েকদিন ধরে কাজের খুব প্রেসার যাচ্ছে রুবা জামানের। সামনের সপ্তাহে স্কুলে পরিদর্শন আছে। সেজন্য স্কুলে সাজ সাজ রব। হেডস্যার সবাইকে দৌঁড়ের ওপর রেখেছেন। কত যে কাজ করতে হচ্ছে এই পরিদর্শন উপলক্ষে। পুরো স্কুলের আনাচেকানাচে পরিষ্কার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও চুনকামও করা হচ্ছে। ক্লাসরুমগুলো পরিষ্কার করে মোছা পর্যন্ত হচ্ছে। এদিকে আবার প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে বলে দেওয়া হয়েছে ওইদিন যেন সবাই পরিষ্কার ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসে। প্রত্যেক ক্লাসের ক্লাসটিচাররা নির্ধারিত পড়া দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রস্তুত করে নিচ্ছেন। রুবাও ক্লাস সেভেনের ক্লাসটিচার। তাই সেও তার ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সেদিনের জন্য নির্ধারিত পড়া দিয়ে খুব ভালো করে প্রস্তুত করে রেখেছে।
এদিকে স্কুলের চারপাশ এত পরিষ্কার করেও হেডস্যারকে সন্তুষ্ট করা যাচ্ছে না। তিনি শুধু খুঁত ধরেই বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে কিছুটা চাপা অসন্তোষও কাজ করছে। কমনরুমে এ নিয়ে কেউ কেউ গলা ফাটাচ্ছেন। রুবা অবশ্য এসবের মধ্যে নেই। সে চায় তার কাজে হেডস্যার সন্তুষ্ট হোক। এজন্য সে অনেক বাড়তি চাপ নিচ্ছে। এ নিয়ে বাসায় কিছুটা অশান্তিও হচ্ছে। কারণ স্কুলের কাজ সুচারুরূপে করতে গিয়ে বাসায় সে কিছুটা উদাসীন হয়ে গেছে।
যাই হোক,এরকম বাড়তি চাপ নিতে নিতেই চলে এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ।
আজ তাদের স্কুলে পরিদর্শন। ছাত্রছাত্রীরা আজ পরিষ্কার পোশাকে স্কুলে এসেছে। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও আজ বেশ পরিপাটি। সকাল থেকেই সবার বুক ঢিব ঢিব। ঠিক দশটায় তিনি এলেন,অর্থাৎ পরিদর্শক মহোদয়। হেডস্যার এগিয়ে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি হাসিমুখে সবার সাথে পরিচিত হয়ে ক্লাস পরিদর্শন শুরু করলেন। কিন্তু দুতিনটা ক্লাস ভিজিট করে তাঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো। হেডস্যারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন,পরিদর্শক মহোদয় ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছেন। কিন্তু কারণটা বুঝতে পারছেন না। হেডস্যার পরিদর্শনের সময় রুবাকে তাঁদের সাথে রেখেছিলেন। কারণ রুবা একজন চটপটে,চৌকষ শিক্ষক। এরকম একজন শিক্ষক পাশে থাকলে মনে জোর আসে। কিন্তু সেই চটপটে চৌকষ শিক্ষক রুবাও বুঝে উঠতে পারছে না পরিদর্শক মহোদয় এরকম অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন কেন? নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করলে সেটা বেয়াদবি হবে মনে করে সে কোনো প্রশ্নও করতে পারছে না। আর দুটো ক্লাস ভিজিট করে পরিদর্শক মহোদয় হেডস্যারের দিকে ফিরে বললেন,
-আমি আর ক্লাস ভিজিট করবো না। আমি শিক্ষকদের সাথে একটু কথা বলবো। আপনি ব্যবস্থা করেন।
হেডস্যার বিনয়ের সাথে “জি স্যার, জি স্যার” বলে
শিক্ষক মিলনায়তনের দিকে ছুটলেন। একটু পরই মিলনায়তনে ছোটখাটো একটা মিটিংয়ের আয়োজন করা হলো। পরিদর্শক মহোদয় কোনো ভণিতা না করেই বললেন,
-আজ আপনাদের স্কুল পরিদর্শন করে আমি খুব হতাশ হয়েছি। সত্যি, আমি ব্যথিতও হয়েছি।
সবাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে পরিদর্শক মহোদয়ের পরবর্তী বাণী শুনতে। পরিদর্শক মহোদয় একটু থামলেন,তারপর বললেন,
-সত্যি,আমি খুব গর্বিত আমার ছেলেকে নিয়ে। আমার ছেলের বয়স পাঁচ বছর। আপনারা শুনে অবাক হবেন,আমার ছেলে একটা বাংলা শব্দও বলতে পারে না। আমি শিখতে দেইনি তাকে। আমি খুব সচেতন ছিলাম এ ব্যাপারে। তাই তার মুখে বোল ফুটবার আগে থেকেই আমি আর আমার ওয়াইফ ওর সাথে ইংলিশে কথা বলতাম। আমার ছেলে আমার মান রেখেছে।
পুরো মিলনায়তন জুড়ে পিনপতন নীরবতা। একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার মুখে প্রকাশ্যে এভাবে বাংলার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখে শিক্ষকরা হতবাক। রুবার সারা শরীরের রক্ত যেন তীব্র বেগে মাথার দিকে ছুটছে। কোনো বাঙালি বাংলা বলতে পারে না এটা যে কখনো কারো কাছে গবের্র বিষয়বস্তু হতে পারে এটা যেন তার মাথায় ঢুকছে না। ততক্ষণে পরিদর্শক মহোদয় বলে চলেছেন,
– আপনাদের চারটা ক্লাসে আমি গেলাম। তাদের আমি নানা প্রশ্ন করলাম। তারা সঠিক উত্তর দিয়েছে,কিন্তু আমি তারপরও সন্তুষ্ট না। কারণ আমি তাদের প্রশ্নগুলো করেছি ইংরেজিতে। অথচ তারা উত্তর দিলো বাংলাতে। অর্থাৎ তারা ইংরেজি বলতে পারে না। এসব অর্ধশিক্ষিত মূর্খদের দিয়ে জাতির কী লাভ হবে? বাংলা ভাষা কি উচ্চশিক্ষায় চলে? হাইয়ার ক্লাসে উঠতে চাইলে তাদেরকে ইংরেজি চর্চা করতে হবে।এসব বাংলা ফাংলা দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
রুবার কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করতে থাকে। মনে হয় সে সব ভুল শুনছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা এভাবে বাংলার বিরোধিতা করতে পারেন না। কারণ এ দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আইন আছে,সরকারি সব কাগজপত্র বাংলায় করতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগের জন্য হয়তো ইংরেজি শিখতে হবে,জানতে হবে,কিন্তু কিছুতেই তা বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস।চোখ বন্ধ করলে সে যেন এখনই দেখতে পাবে সালাম,বরকত,রফিক,জব্বারের লাশ। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘোরে তার। তখনো পরিদর্শক মহোদয় কী যেন বলে যাচ্ছে। রুবা আর শুনতে পারে না। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়ায়,বলে,
-স্যার,আমি কি কিছু বলতে পারি?
পরিদর্শক মহোদয় খুব অবাক হন। তাঁর মূল্যবান কথা থামিয়ে দিয়ে এ শিক্ষক কী বলতে চায়! স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন,
-আপনি আবার কী বলতে চান? ঠিক আছে,বলেন,তবে অল্প কথায়।
রুবার মাথাটা তখনো ভোঁ ভোঁ করছে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-স্যার,মাফ করবেন। আপনার মতের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে আমি বলতে চাই, বাংলা ভাষায় কথা বললে কেউ অশিক্ষিত মূর্খ হয়ে যায় না। বাঙালির কাছে বাংলা ভাষা শুধু একটা ভাষা নয়।এটা একটা আবেগের নাম। আমরা সেই জাতি,যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলাম। এই ভাষাকে কেন্দ্র করে আমরা একটা জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এই ভাষায় লেখাপড়া করে ভালো রেজাল্ট করে আমাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সুতরাং বাংলায় সঠিক উত্তর দিয়ে আমাদের স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মূখের্র পরিচয় দেয়নি। শুদ্ধভাবে বাংলা বলতে এবং লিখতে পারাটাও প্রকৃত জ্ঞানের পরিচায়ক। আর বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করা মানে আমাদের জাতিসত্তাকে আঘাত করা। আমাদের রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভকে অস্বীকার করা।
পরিদর্শক মহোদয় হা করে তাকিয়ে আছেন রুবার দিকে। কিছুটা বিব্রত তিনি,তবে সেটা প্রকাশ করলেন না।
কে এই শিক্ষক? কী তার পরিচয়? প্রতিটি স্কুলে পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এমনভাবেই কথা বলেন। কিন্তু কোথাও তো তিনি কখনো এমনভাবে পাল্টা কথা শোনেননি। তিনি বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে প্রধানশিক্ষকের দিকে তাকালেন। প্রধান শিক্ষক বিব্রত। কী করবেন তিনি বুঝতে পারছেন না। অন্য কেউ হলে হয়তো তিনি থামিয়ে দিতেন,কিন্তু রুবা যে ভাষাশহিদের নাতনি। তাকে কী বলে থামাবেন তিনি? তিনি ফিসফিস করে পরিদর্শক মহোদয়কে বললেন,
-স্যার উনি ভাষাশহিদের নাতনি। তাই এভাবে কথা বলছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা আপনার কথার মর্ম বুঝতে পেরেছি। আমরা সেটাই মেনে চলবো।
হঠাৎ পরিদর্শক মহোদয় উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
– আমি যাচ্ছি। তবে আজ আমার একটা নতুন উপলব্ধি হলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে টিকে থাকার জন্য ইংরেজিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ভুলে গিয়েছিলাম। আজ উনার কথায় আমারও মনে হচ্ছে নিজের মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলতে লিখতে না পারাটা ইংরেজি না জানার চেয়েও লজ্জার। বাংলা ভাষা নিয়ে ওরকম একটি মন্তব্যের জন্য আমি দুঃখিত।
বলেই তিনি বেরিয়ে যান। তাঁর পিছু পিছু ছোটেন হেডস্যারও। ততক্ষণে সবাই ঘিরে ধরেছে রুবা জামানকে। কী সাহস রুবার! তাকে স্যালুট জানাতেই হয়। সহকর্মীবেষ্টিত রুবা জামানের চোখে তখন ঝিলিক দিচ্ছে আত্মপ্রত্যয়।।