মুখ্যমন্ত্রী থেকে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ

ইমরানের ছয় ঘনিষ্ঠ সহযোগীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

আজাদী ডেস্ক | মঙ্গলবার , ১২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ

অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের বিদায়ের পর পাকিস্তানের পার্লামেন্ট বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে। গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টায় পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভোটাভুটিতে শাহবাজ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এদিকে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ছয় ঘনিষ্ঠ সহযোগীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইমরানের ছয় ঘনিষ্ঠ সহযোগীর নাম ‘স্টপ-লিস্টে’ এনেছে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফআইএ)। এর মানে হলো, তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগ করতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী দৌড়ে শাহবাজের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ভাইস চেয়ারম্যান শাহ্‌ মাহমুদ কুরেশি। কিন্তু কুরেশিসহ পিটিআইয়ের সব সদস্য অধিবেশন বয়কট করায় কার্যত শাহবাজের জন্য মাঠ ফাঁকা হয়ে যায়। শাহবাজের পক্ষে পড়ে ১৭৪ ভোট। গতকাল পার্লামেন্টের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনই ছিল একমাত্র কর্মসূচি। ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ১৭২ সদস্যের সমর্থন লাগে, সেখানে ১৭৪ সদস্যের সমর্থন পেয়েছেন
শাহবাজ। পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) সভাপতি শাহবাজ শরিফ ও ইমরানের দল পিটিআইয়ের শাহ্‌ মাহমুদ কুরেশি রোববার প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছিলেন। ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পার্লামেন্টের যে বিরোধীদলীয় জোট কাজ করেছে তাদের নেতা শাহবাজ শরিফ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন পেয়ে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বলে আগেই ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছিল।
‘দ্য ডন’ পত্রিকা জানায়, সোমবার পার্লামেন্ট অধিবেশনে ভোটের পর পিএমএল-এন নেতা আয়াজ সাদিক নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শাহবাজ শরিফের নাম ঘোষণা করেন। এরপরই আইন প্রণেতারা তার সমর্থনে স্লোগান দিতে শুরু করে।
পার্লামেন্টে নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভাষণে শাহবাজ বলেন, পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে সফলতা এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অশুভর ঊর্ধ্বে শুভর জয় হয়েছে।
ইমরানের ছয় ঘনিষ্ঠ সহযোগীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : বিডিনিউজের খবর থেকে জানা যায়, ইমরানের ওই ছয় ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব আজম খান, রাজনৈতিক যোগাযোগ-বিষয়ক বিশেষ সহকারী শাহবাজ গিল, স্বরাষ্ট্র ও জবাবদিহি-বিষয়ক উপদেষ্টা শাহজাদ আকবর, পাঞ্জাবের দুর্নীতি দমন সংস্থার মহাপরিচালক গহর নাফিস, কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা পাঞ্জাবের (অঞ্চল-২) মহাপরিচালক মোহাম্মদ রিজওয়ান ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সোশ্যাল মিডিয়ার প্রধান আরসালান খালিদ। এফআইএ এর আগে পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে বিধিনিষেধ দেয়।
যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে শাহবাজ : ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দক্ষ প্রশাসক হিসেবে যার সুনাম রয়েছে। এছাড়া তিনি পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই। দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নওয়াজ লন্ডনে নির্বাসিত জীবন বেছে নেওয়ার পর শাহবাজই পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ)- পিএমএলের (এন) দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। শাহবাজের ভাই নওয়াজকে সরিয়েই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইমরান।
৭০ বছরের শাহবাজ পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী। তিনি এখন একটি নতুন সরকার গঠন করবেন। ২০২৩ সালের অগাস্টে পাকিস্তানে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এ সরকারই ক্ষমতায় থাকবে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
লেখাপড়া শেষ করে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন শাহবাজ। ১৯৮৫ সালে তিনি লাহোর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওই সময় তিনি ব্যবসার পাশাপাশি বড় ভাই নওয়াজ শরিফ এবং তার দলের রাজনীতির প্রচারেও কাজ করেছেন। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনে জিতে তিনি প্রথমবারের মত পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন। ১৯৯০ ও ৯৩ সালেও তিনি পুনঃনির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সালে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে শাহবাজ বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচিত হন।
১৯৯৭ সালে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল এবং প্রভাবশালী প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। ওই বছর বড় ভাই নওয়াজ শরিফ দ্বিতীয়বারের মত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পাঞ্জাবের উন্নয়নে শাহবাজ সেখানে বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে কাজও করছিলেন। কিন্তু ওই সময়ই তার সরকারের অকাল পতন ঘটে। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করেন জেনারেল পারভেজ মুশাররফ। ক্ষমতাচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। দুই ভাইকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযোগ আছে, ২০০০ সালে শরিফ পরিবার তৎকালীন সেনাশাসক পারভেজ মুশাররফের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছেন। যে চুক্তির খবর ফাঁস হওয়ার পর শরিফ পরিবার বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। যদি তারা বার বার মুশাররফের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তির বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। ফলে সৌদি আরবে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন শাহবাজ।
সাত বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ২০০৭ সালে শরিফ পরিবার পাকিস্তানে ফিরেতে সক্ষম হয়। তার পরের বছরই ছিল সাধারণ নির্বাচন। কিন্তু একটি বিচার বহির্ভূত হত্যা মামলা থাকায় শাহবাজ ওই সময় কোনো পর্যায়ের নির্বাচনেই অংশ নিতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে করা একটি এফআইআর এ বলা হয়, তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় পুলিশকে একটি এনকাউন্টারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তার অনুপস্থিতিতে ২০০৩ সালে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী আদালত তার বিরুদ্ধে নোটিস জারি করে। ওই নোটিসের জবাব দিতে শাহবাজ ২০০৪ সালে পাকিস্তানে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিমানবন্দর থেকেই তাকে ফেরত পাঠানো হয়।
২০০৭ সালে দেশে ফিরে নির্বাচনে অংশ নিতে ওই মামলায় জামিন পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন শাহবাজ। কিন্তু তাকে জামিন দেওয়া হয়নি। যদিও নির্বাচনের পর তিনি বিচারে খালাস পান এবং উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে জেতেন। আবারও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু সে বছরই সুপ্রিম কোর্ট তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেন। যার বিরুদ্ধে আপিল করে দুই মাস পর মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ফেরত পান শাহবাজ।
২০১৩ সালে ভোটে জিতে টানা দ্বিতীয়বারের মত পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ। ওই সময় তিনি ‘কঠোর প্রশাসক’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
রাজনীতিতে সবসময়ই বড় ভাই নওয়াজের ছায়াতলে দ্বিতীয় সারির নেতার ভূমিকায় থেকেছেন শাহবাজ শরিফ। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় ২০১৭ সালে, যখন পানামা পেপার্স ফাঁসের জের ধরে সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজকে আজীবনের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হবার অযোগ্য ঘোষণা করে। নওয়াজ নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার পর শাহবাজ দলীয় প্রধানের পদ পান ঠিকই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হন শহিদ খাকান আব্বাসি।
ওদিকে, কিছুদিন জেল খাটার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন চলে যান নওয়াজ। তারপর আর দেশে না ফেরায় তার শূন্যস্থান পূরণের জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাব থেকে বেরিয়ে এসে কেন্দ্রের রাজনীতিতে যোগ দেন শাহবাজ। সে বছর নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলের প্রধান হিসেবে বিরোধী দলের নেতা হন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপার্লামেন্টে এসে যা বললেন ইমরান
পরবর্তী নিবন্ধঈদে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু ২৩ এপ্রিল