মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে মার্চের অসহযোগ আন্দোলন

ড. মো. মোরশেদুল আলম | বৃহস্পতিবার , ১৬ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এক ঘোষণা জারির মাধ্যমে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ঘোষণাটির সাথে সাথে ঢাকাসহ সারা বাংলায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। এরপর পূর্ববাংলার শাসন মূলত চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় যেমন বাঙালিদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল, একইভাবে ১ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা বাঙালিদেরকে স্তম্ভিত করে দেয় এবং রাজনৈতিক অবিশ্বাসটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী লিখেছেন, ‘অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলা যেতে পারে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলো।’ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা রাজপথে নেমে আসে। বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতালের ডাক দেন। ২ মার্চ সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত সম্বলিত বাংলাদেশের মানচিত্র উত্তোলন করেন। ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে স্বাধীনতার ঘোষণা, ইশতেহার ও প্রস্তাব পাঠ করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ জনসভায় উপস্থিত ছিলেন। হরতাল ঘোষণার মধ্যে দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের শুরু হয়। হরতালটি এত স্বতঃস্ফুর্ত ছিল যে রাস্তায় কোনো যানবাহন পর্যন্ত চলেনি, এমনকি দেকানপাটও খুলেনি। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার প্রতি সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করে এবং আওয়ামী লীগের মিছিলে গুলি চালায়। ফলে ৩ মার্চকে শোক দিবস ঘোষণা করা হয়। হরতালে সব অচল হলেও বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশে ৪ মার্চ হতে সরকারী ও বেসরকারী অফিসের কর্মচারীদের বেতন নেয়ার সুবিধার্থে বেলা ২.৩০ থেকে ৪.৩০ টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা রাখা হয়। অর্থাৎ অফিসের স্বাভাবিক সময়ে নয় বরং বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সময়ই ব্যাংকের কার্যাবলী সম্পাদন করার জন্য নির্ধারণ করা হয়।

ইয়াহিয়া খান ইতোমধ্যে ৬ মার্চ রাতে দেশবাসীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫ মার্চ আহবানের ঘোষণা দেন। যদিও অধিবেশন আহ্বান নিয়ে বাঙালিরা যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। কারণ, ইয়াহিয়া খান পরিস্থিতির জন্য বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করে যেভাবে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে এটা স্পষ্ট ছিল যে, শান্তি নিশ্চিত করা নয় বরং আন্দোলন দমন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। মিলিটারি ব্যবস্থাকেই তিনি একমাত্র সমাধান হিসেবে ভেবেছিলেন। তাই তিনি বেলুচিস্তানের ‘কসাই’ হিসেবে পরিচিত টিক্কা খানকে নিয়োগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে যাতে কঠোর হস্তে দমন করা যায়। ৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ এবং ৭ মার্চ টিক্কা খানকে ঢাকায় প্রেরণ ছিল ইয়াহিয়া খানের দুরভিসন্ধির পরিচায়ক। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পূর্বঘোষিত ৭ মার্চের জনসভায় প্রভাব ফেলার বন্দোবস্ত করতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া। এরই অংশ হিসেবে ৬ মার্চ ঢাকা, টঙ্গী ও রাজশাহীতে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে প্রায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়; যা বাঙালিদের আরো ক্ষিপ্ত করে তোলে। এরূপ পরিস্থিতিতে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও দিকনির্দেশনার জন্য বাঙালিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কিছু ব্রিটিশ পত্রিকা পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণার সম্ভাবনার কথা বলে। আমেরিকান কূটনীতিবিদ ঠধহ ঐড়ষষবহ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ৩টি সম্ভাব্য বিকল্পের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধু হয়ত একতরফা স্বাধীনতা বা পূর্ণ স্বাধীনতার মতো কিছু প্রস্তাব অথবা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চের অধিবেশন আহ্বানের সাথে একমত হতে পারেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ প্রদত্ত ভাষণে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন-‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ বস্তুত বঙ্গবন্ধুর এ উচ্চারণ একতরফা স্বাধীনতার মতোও নয়, আবার পূর্ণ স্বাধীনতা থেকেও কোনো অংশে কম ছিল না। ঘোষণাটি দেশের স্বাধীনতার জন্য পরবর্তী করণীয় ঠিক করে দেয়।

মার্চের ৮ ও ৯ তারিখ বঙ্গবন্ধুর নিকট থেকে কিছু নির্দেশনা আসে। সরকারী ও বেসরকারী অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং কোর্টে হরতাল পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। বাঙালি ব্যাংক কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ মোতাবেক ৮ মার্চের নির্দেশনায় ব্যাংকের প্রতি আলাদা নির্দেশ জারি করা হয়। ১১ মার্চের দিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখার জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম ও কিছু ফার্মের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে প্রায় ১৬টির মতো নির্দেশনা প্রদান করা হয়। আন্দোলনের এ পর্যায়ে পূর্ববাংলার সম্পূর্ণ প্রশাসন অর্থাৎ অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, কলকারখানা, পরিবহন, সমুদ্র বন্দর, ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেতার, টেলিভিশন সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সব খুলেছে, তাঁর নির্দেশেই বন্ধ হয়েছে। তাইতো যুক্তরাজ্যের Evening Standard পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে Real boss of East Pakistan বলে অভিহিত করে।

১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর দেয়া কর্মসূচিতে বলেছিলেন, মুক্তির লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। ১৫ মার্চের নির্দেশানুযায়ী সরকারী ও বেসরকারী অফিসকে পূর্বের মতো হরতাল পালনের কথা বলা হয়। তবে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইপিআরটিসির বাস চালু এবং রেলওয়ে চালু থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যে, সৈন্য আনা নেয়া বা সমরাস্ত্র পরিবহনের কাজে বা মানুষের উপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে এগুলোকে ব্যবহার করা যাবেনা। নৌ পরিবহনের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশ দেয়া হয়। তাছাড়া সরকারী ও আধা সরকারী সংস্থার কর্মচারী ও প্রাইমারী শিক্ষকদের বেতন দেয়ার কথাও উক্ত নির্দেশে উল্লেখ ছিল। ১৫ মার্চ প্রদত্ত ওই ৩৫টি নির্দেশনা বিষয়ে বিদেশী কূটনীতিকরাও প্রশংসা করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সকে দেয়া চিঠিতে মার্কিন কূটনীতিক জোসেফ সিসকো নির্দেশনাগুলিকে ‘সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত’ পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন। সামরিক বাহিনীর নির্যাতন এবং ভীতি প্রদর্শনের মধ্যেও অসহযোগ আন্দোলনকারীরা কিন্তু তাদের লক্ষ্যে অটল ছিল।

জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চিত করার প্রতিবাদে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তঁর ‘হিলালে ইমতিয়াজ’ উপাধি ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীও তাঁকে দেওয়া ‘সিতারায়ে ইমতিয়াজ’ খেতাব বর্জন করেন। অন্যান্য শিল্পীসাহিত্যিকবুদ্ধিজীবী রাজনীতিকগণও পাকিস্তানের দেওয়া খেতাব বর্জন করেন। ১৫ মার্চে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ বায়তুল মোকাররমে এক মহিলা সমাবেশের আয়োজন করেন। সমাবেশে ‘স্বাধীনতার সংগ্রামে এবং শোষণমুক্ত বাংলা’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে মহিলারা একাত্মতা ঘোষণা করেন। চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দানে শিল্পীসাহিত্যিকদের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসভায় অধ্যাপক আবুল ফজল সভাপতিত্ব করেন এবং সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন, . আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব, জেলা ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মাহবুবুল হক এবং আরও অনেকে বক্তৃতা করেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যে কোনো মূল্যেই তাঁরা গণ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। সভা শেষে গণসঙ্গীতের আসর ও কবিগান অনু্‌িঠত হয়।

সংকট সমাধানের জন্য প্রেসিডেন্ট আন্তরিকএ ধরনের মনোবৃত্তি প্রদর্শনের উদ্দেশে ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে পৌঁছান। একই দিনে বঙ্গবন্ধুর ৩৫টি নির্দেশনা প্রদানও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে এর মাধ্যমে একটি পরিষ্কার বার্তা দেয়া হয়েছিল যে, অসহযোগ আন্দোলনের পরিস্থিতি যেন আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রেসিডেন্টের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী আলোচনার অন্তরালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার কাজও চালিয়ে যায়। আমেরিকান একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ৪ মার্চে পাকিস্তানি বাণিজ্যিক এয়ারলাইনস এবং জাহাজের মাধ্যমে অনেক সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ব্রিটিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, মধ্য মার্চ হতে ঢাকায় প্রায় ১৫,০০০ সৈন্য প্রেরিত হয়। সাগরপথে ‘Ocean Endurance’ জাহাজে করে সৈন্য, ট্যাংক এবং গোলাবারুদ আনার বিষয়েও রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়। ২ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার বাণিজ্যিক ফ্লাইট প্রায় ১২,০০০ সেনা বহন করে আনে বলে অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। জুলফিার আলী ভুট্টো ২১ মার্চ ঢাকায় এসে পোঁছান। কিন্তু সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। মার্চ মাসের শেষের দিকেও বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে আলোচনা অব্যাহত থাকে। ১৫২৫ মার্চে পর্যন্ত চলা এ আলোচনাকে ‘আধুনিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক হেঁয়ালির নাট্যমঞ্চ’ বলে অভিহিত করেছেন অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস। ২২ মার্চ পূর্ব ঘোষিত ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন পুনরায় স্থগিত করা হলে পূর্ববাংলার জনগণ ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে। ওইদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এম.ভি. সোয়াত জাহাজ থেকে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র্ত্র খালাস করার কথা ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ বন্দর এলাকা ঘেরাও করে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক নীল নকশা অনুযায়ী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণি পেশার ও বয়সের মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।

লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘পাঠক উৎসব’: বই হোক প্রিয় সঙ্গী
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম