মিয়ানমারের পাতা ফাঁদ বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

প্রসূন তালুকদার | মঙ্গলবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের হাতে গোনা যে কয়জন লেখক বুদ্ধিজীবীকে বর্তমানে নির্মোহভাবে পত্রিকায় সাহসী কলাম লিখতে দেখা যায় তার মধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম অন্যতম। গত পহেলা সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে ‘মঈনুল ইসলামের কলাম’ তিনি কিছু তথ্য উপাত্ত দিয়ে যে কলামটি লিখেছেন সেটি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও পলিসি গ্রহণ নিয়ে। কিন্তু তার মধ্যে রয়ে গেছে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতির কিছু কার্যকারণ।
তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরকম বদ্বীপ অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন সাগর-উপসাগরের তলদেশগুলো সাধারণত সবচেয়ে বেশি হাইড্রোকার্বণ (তেল ও গ্যাস) খনির ভাণ্ডার হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের গাল্ফ ডেল্টা, ইন্দোনেশিয়ার মহাকাশ ডেল্টা এবং আফ্রিকার নাইজার ডেল্টা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্গোপসাগরের ভারত উপকূলের অদূরে গোদাবরী বেসিন এবং মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের অদূরে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অঞ্চলের অগভীর সাগরতলে প্রাপ্ত বিপুল গ্যাস-ভাণ্ডার এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে চলেছে। অথচ, বাংলাদেশ গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকৃত বা স্বল্প-পরীক্ষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে জরিপ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় অভিমত হলো এদেশের স্থলভাগ এবং সাগরতলে এখনো ৩২ টিসিএফ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের ভাণ্ডার বিদ্যমান রয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস জিউলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দু’বছরের একটি মূল্যায়ন প্রকল্পের অভিমত হলো, এদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস-সম্পদের পরিমাণ কমবেশি ৩২ টিসিএফ হতে পারে। নরওয়ে সরকারের অধীনস্ত নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরক্টেরেট বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাইড্রোকার্বণ ইউনিটের সাথে যৌথ জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত গ্যাস-সম্পদ ৩৮-৪২ টিসিএফ হতে পারে। এরপর র‌্যাম্বল নামের একটি ইউরোপীয়ান তেল ও গ্যাস কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য গ্যাসের পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ’।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত যে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার ছিল তখন দেখেছি চীন পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘বিশেষ নাটক’ দশ ট্রাক অস্ত্র যা চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত কাফকো জেটিতে ধরা পড়া। এই অস্ত্র যাচ্ছিল ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে, যাতে চীন ও পাকিস্তানের চিরশত্রু ভারত বিপর্যস্ত হয়। এই ফাঁকে চীন পাকিস্তানের প্রিয় বাংলাদেশের শাসকদলের ক্ষমতা আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাতে তাদের স্বার্থ কোথায় তা বুঝতে আবার ড. মঈনুল ইসলামের কলামে চোখ রাখি। তিনি লিখছেন, ‘প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল’স অব দি সি’স (ইটলস) এবং দি হ্যাগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ, যার পুরো কৃতিত্ব শেখ হাসিনার সরকারের।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার অদূরে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে বেশ কয়েক বছর পূর্বে প্রায় চার ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐ গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রফতানি করছে মিয়ানমার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঐ অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ার দাইউ কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্যে ইজারা দিয়েছিল। দাইউ যথাযথ প্রস্তুতি এবং সরঞ্জাম নিয়ে ঐ অঞ্চলে তেল-গ্যাস এক্সপ্লোরেশন চালাবার জন্যে কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদেরকে বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। ২০১২ সালের ইটলসের রায়ে ঐ বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা এখন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ, কিন্তু গত দশ বছরেও ওখানে এখনো কোনো নতুন এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ইজারাদার কোম্পানি। এই অক্ষম বিলম্বের কারণে মিয়ানমার যে এই সমুদ্রাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সে গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত! কারণ, সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুদ তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ওখানে গ্যাস পাওয়া যাবেই, এটা প্রায় নিশ্চিত মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। (২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাউথ-ইস্ট এশিয়া পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কোম্পানি বাংলাদেশের এসএস-১১ ব্লক সম্পর্কে এ-অভিমত তুলে ধরেছে)’।
তাহলে দেখছি কী? বাংলাদেশ-মিয়ানমার জুড়ে যে বিশাল বঙ্গপোসাগর এলাকা সেখানে তেল গ্যাসের যে বিশাল মজুদ প্রমাণিত হয়েছে এবং মিয়ানমার অনেক আগে থেকে তা উত্তোলন করছে আর পুরোটাই চীনে রপ্তানী করছে। একই তেল গ্যাস যে বাংলাদেশ সীমানাতেও থাকবে তা বুঝতে নিশ্চয় রকেট বিজ্ঞানী হবার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতের মামলায় জেতার পরেই সেই বৈধ এলাকায় বাংলাদেশ গ্যাস উত্তোলন করতে গেলেও যে মিয়ানমার অবৈধভাবে বাধাগ্রস্থ করবে তারই উদাহরণ হচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু ও বর্তমান উস্কানি। বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় সব হচ্ছে চীনের ইংগিতে। কারণ বাংলাদেশ যত দেরি করবে তত বাংলাদেশ অংশ হতেও সেই তেল গ্যাস মিয়ানমার (পক্ষান্তরে চীন) আহরণ করে নিয়ে যেতে পারবে।
সমপ্রতি মিয়ানমার থেকে পরপর কয়েকবার গোলা এসে পড়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে। যদিও মিয়ানমার তার ব্যাখ্যায় বলার চেষ্টা করছে যে তাদের আভ্যন্তরীণ যে সংঘাত তার জের ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মিয়ানমার কে বিব্রত করতে বাংলাদেশে ইচ্ছা করে গোলা ছুড়েছে। কিন্ত এই ব্যাখ্যা বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
মিয়ানমার যে উস্কানি দিচ্ছে আর বাংলাদেশকে যুদ্ধে জড়াতে ফাঁদ পাতছে তা তার বেশ কিছু কর্মকাণ্ড পাঠ করলে বুঝা যায়। মায়ানমার তার নিজস্ব স্বার্থে একটি যুদ্ধে জড়ানো এখন তাদের জন্য সব থেকে লাভজনক। আর এজন্য বাংলাদেশ ছাড়া তার আর কোনো বিকল্প নাই। মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও প্রায় শতাধিক জাতিগোষ্টীর দেশ। তার মধ্যে আবার দশটিরও অধিক জাতিগোষ্ঠীর সাথে সংঘাত রয়েছে ক্ষমতাসীন বর্মী নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা সরকারের। কারেন, রাখাইন, আরাকান আর্মি, বম,আরসা সহ বেশ কিছু আঞ্চলিক গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে দীর্ঘদিন থেকে যুদ্ধে লিপ্ত। অনেকেই ভারত থেকে সহানুভুতি পায়। গত একবছর ধরে মিয়ানমার জান্তা সরকার দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক ও সামরিক বেশ চাপে রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানা যায় জান্তা সরকার মাত্র ১৭ ভাগ ভূমিতে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম আছে। এনইউজি বা জাতীয় ঐক্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ ৫২ শতাংশ অঞ্চলে। বাকি অংশে চলছে তুমুল সংঘাত, যার জেরে সমপ্রতি গোলাবর্ষণ।
মিয়ানমার অনেক আগে থেকেই চীনের অঙ্গরাজ্য হিসেবে কাজ করছে। মিয়ানমারে সব থেকে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আছে চীনের। ভারত ও রাশিয়া নিজ নিজ স্বার্থগত কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে। গত ২০ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের প্রধান ইংরেজি দৈনিক ইরাবতীর প্রধান সংবাদ ছিল, ‘সমপ্রতি রাশিয়া থেকে মিয়ানমার ছয়টি যুদ্ধ বিমান কিনেছে যার মূল্য ২০৪ মিলিয়ন ডলার। ছয়টির মধ্যে দুইটি গত মার্চে সরবরাহ করা হয়েছে, বাকি চারটি শীঘ্রই করা হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া যে বেকায়দায় তার থেকে উত্তরণে এই অস্ত্র বিক্রির অর্থ তার দরকার, পাশাপাশি দরকার মিয়ানমার ও চীনকে পশ্চিমা জোট মোকাবেলায় পাশে পাওয়া। অন্যদিকে চীন একইভাবে তাইওয়ান ইস্যু নিয়ে বেকায়দায়। মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডে বেশি লাভবান চীন, যে কারণে গত বিশ সেপ্টেম্বর আসিয়ান জোট বহির্ভূত রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিবিদদের কাছে মায়ানমারের গোলাবর্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের ব্রিফিং এর আমন্ত্রণে রাশিয়া ও ভারতের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হলেও চীন অনুপস্থিত ছিল।
চীনের অর্থায়নে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বাঁশখালীতে এস আলম চায়না বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর আগামী ডিসেম্বরে উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে কর্ণফুলী টানেল। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র হয়েছে রাশিয়ান অর্থায়ন ও প্রযুক্তিতে। এরইমধ্যে রামপালে বাংলাদেশ-ভারত কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্রটি উদ্বোধনের প্রাক্কালে মিয়ানমারের এই উস্কানি বুঝিয়ে দেয় দিল্লীর সাথে যে নতুন সম্পর্ক হতে যাচ্ছে তা চীন ও রাশিয়া সহজভাবে নিচ্ছে না। এদিকে দিল্লী থেকে ফিরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৃটেন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌছেছেন যখন আমেরিকা আশা প্রকাশ করেছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে তারা বাংলাদেশকে ইউক্রেনের পাশে চায়।
বাংলাদেশ কোনো অবস্থাতেই মিয়ানমারের পাতা ফাঁদে পা দিবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সমপ্রতি আশিয়ানবহির্ভুত কূতনীতিবিদদের সাথে ব্রিফিং শেষে সাংবাদিকদের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব অব. রিয়াল এডমিরাল খুরশিদ আলম বলেছেন, ‘বাংলাদেশ পশ্চিমে, দক্ষিণে হলো মিয়ানমার আর্মি, উত্তরে আরাকান আর্মি। তাদের গোলা কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসার কথা না। জিওগ্রাফিক্যালি এটা হয় না, যদি না কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে না করে। কাজেই ইচ্ছাপূর্বক এ বিরোধে জড়ানোর যে প্রচেষ্টা, আমরা বলেছি আমরা এ প্রচেষ্টায় জড়িত হব না। সূত্র- বনিক বার্তা (২১-০৯-২০২২)।
তার মানে এই নয় বাংলাদেশ তার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রীয় এই ঘোষণায় কেবল পররাষ্ট্রনীতির আনুষ্ঠানিক প্রতিফলন (সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরীতা নয়) ঘটেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামপ্রতিক দিল্লী সফর, বৃটেন সফর ও বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র সফরে আমরা নিশ্চয় তাঁর স্বভাবসুলভ কূটনীতির প্রয়োগ দেখতে পাব যা সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায় না, বুঝা যায় কর্মকাণ্ডে কেবল।
লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধ৩৮নং ওয়ার্ডে নতুন জামে মসজিদ কবরস্থানের লাইটপোস্ট উদ্বোধন