ভূগোলের গোল

ডা: কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

মোবাইল অপব্যবহার : দিক ভ্রান্ত জীবন

এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় থাকতে হয়। এই প্লেন এর অপেক্ষার সময় একজন যাত্রী কি করবে? আগের জমানায় বই, পত্র-পত্রিকা পড়ত। এখন মোবাইল টিপা টিপি; লেপটপে টাংগুল চালনা এ ইত্যাদি করে। অতি সমপ্রতি নিজে নিজে একটা সমীক্ষা চালালাম ভারতের দুটি বিমান বন্দরে। ঘড়িতে ১০ মিনিটে কতজন কথা বলে মোবাইলে ? আর একজন যাত্রী কতক্ষণ একটি কল করে- তা জানার চেষ্টা করলাম। ১০ মিনিটে আমি মাত্র চারজন যাত্রীকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেখেছি। ভারতের দুটো বিমান বন্দরে আর এই চারজনের কথা বলার সময় তিন মিনিটের কম। খুব আশ্চর্য হলাম। এবং আগে বাংলাদেশের বিমান বন্দরে দশ মিনিটে ৯ জনকে কথা বলতে দেখি আর প্রত্যেকে তিন মিনিটের বেশি কথা বলতে দেখলাম ।
এই ঘটনা অলস যাত্রীর রোজনামচা ছাড়া আর কিছুই মনে করিনি। কিন্তু সমপ্রতি বিলাত অবস্থান কালে ঐ দেশের শিক্ষিত মানুষেরও তাদের পরিবারের মাঝে ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে সচেতনতা, তার প্রচার ও প্রসার দেখে ভাবলাম ‘বাংগাল’ আর অন্য প্রজাতির মাঝে চিন্তার ও মননের বহু পার্থক্য। বিলাতে অবস্থান কালে একটা বই পড়লাম পুরোটা সময়ে। বইয়ের নাম Digital minimalism, লেখক কাল নিউপেটি। বাংলা তরজমা করলে বইটার নামের অর্থ দাঁড়ায় প্রযুক্তি বিশেষ করে “মোবাইল প্রযুক্তির ন্যূনতম ব্যবহার। “বইয়ের লেখক কাল নিউপেটির পো বর্তমানে অক্সফোর্ডের কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষক। তিনি ম্যাসাচুয়েটসের থেকে পি এইচ ডি করেন ও জর্জ ওয়াশিংটন ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
মোবাইল সামগ্রীর অপব্যবহারের উপর তিনি গবেষণারত। ২০১৭ সাল থেকে তিনি প্রযুক্তির ন্যূনতম ব্যবহার বিষয়ে প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত।
মারে কাল নিউপোর্টের মতে আদৌ আমাদের জীবনে এত ব্যাপক টেকনোলজি দরকার আছে কিনা, এতসব ডিজিটাল টেকনোলজি সত্যিই কি মানব কল্যাণে? কাল নিউপোর্টের মতে এত সর্বব্যাপী টেকনোলজি কখনো মানুষের সর্বব্যাপী কল্যাণের জন্য নয়। সমস্ত মোবাইল অ্যাপস ই পুঁজি বিনিয়োগকারীদের অতিরিক্ত মুনাফা লাভের প্রত্যাশায়।
২০২০ সালে ফেসবুক প্রতিজন ব্যবহারকারী থেকে বার্ষিক ৩২ ডলার আয় করেছে। ৮৪ বিলিয়ন ডলার এডভারটাইজিং রেভিনিও ও ২ বিলিয়ন ডলার নন এডভারটাহজিং রেভিনিও আয় করেছে। দুই বৎসরে করোনাকালীন সময়ে মানুষ অত্যাধিক ফেসবুক ব্যবহার করেছে। স্বাভাবিকভাবে অধিকাংশ ব্যবসায় মন্দা দেখা গেলেও ফেসবুক, জুম ব্যবহারকারী কোম্পানির ব্যবসা বাড়িয়ে দিয়েছে। মোবাইলে, ল্যাপটপে বিরতিহীনভাবে এড আসতেই থাকে। প্রতি এক হাজার ফেসবুক এড দর্শনকারী কোম্পানির মুনাফায় ৯ ডলার লাভ যোগ করে।
২০০৪ সাল ক্লাসে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যুক্ত থাকার (Connected) জন্য, ক্লাসের পড়ালেখা শেয়ার করার জন্য মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুক প্রচলন করে। মাত্র তিন বছর পর ২০০৭ সালে এক বক্তব্যে মার্ক জাকারবার্গ বলেন যে, ফেসবুক যে মানবজীবনে এত বাপকভাবে সম্পৃক্ত হবে তা তিনি কল্পনাই করতে পারেননি।
২০০৪ সালে মানুষ দৈনিক ২ঘন্টা সোশাল মিডিয়ায় কাটাত, ২০০৭ সালে দৈনিক ৮৫ বার মোবাইলে চেক করে। ২০২১ সালে মানুষ দৈনিক ১৬ ঘন্টা সোশ্যাল মিডিয়াতে কাটাচ্ছে। টেকনো এক্সপার্টরা ভাবছেন সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বগ্রাসী রূপ মানুষের উপকারিতা-উপযোগিতার জন্য কখনো নয়। বরং বড় বড় কোম্পনীর মুনাফা লাভের প্রতিযোগীতাই এই অবস্থার (Situatio) সৃষ্টি করেছে।
মার্কিন টিভি উপস্থাপক বিল মাহের (Real time with Bill Maher) সোশাল কোম্পানীগুলো Better world তৈরির জন্য নয়,মুনাফার জন্যই বাচ্চাদের জন্য আসক্তিমূলক প্রোগ্রাম (addictive) বিক্রি করছে। বিভিন্ন ধরনের এসব বাচ্চাদের যে পরিমাণ আসক্ত করছে- তা কয়েকটি দেশে একটি পারমাণবিক বোমা ফেলার ক্ষতি থেকেও বেশী।
মোবাইল ফোন কেন আসক্তি জমায়? মানুষ বারেবারে এই ফোন ফেসবুক, মেসেজ ইতাদিতে সময় কাটায়? পৃথিবীর সব বৈজ্ঞানিক সমীক্ষাতেই জানা গিয়েছে যে, মোবাইল ফোনের ব্যবহার মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, মোবাইলের টেকনোলজি এমনভাবে সেট করা যে এটা মানুষকে আসক্তিমূলক আচরণ (addictive behaviour) ববহারিক আসক্তি (Compulsive use) সৃষ্টি করে। তাই আমরা হাজার মারপিট বকা দিয়ে ও তরুণ, বাচ্চা, বয়স্ক কাউকে এই আসক্তি থেকে বাচাতে পারি না। কোকেন বা গাজা জাতীয় আসক্তি যে রকম ভোপামিন নিঃসরণ করে মোবাইল ব্যবহার তার থেকেও পাঁচ গুণ বেশি ক্ষতি করে মানুষের ব্রেইন ও শরীরে।
বাংলাদেশের বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী স্কুল সাধারণ তরুণ ও শিশু প্রজন্মের মধ্যে অস্বাভাবিক মানসিক বিকার, আত্মহত্যা পড়াশোনার প্রতি অনীহা ইত্যাদি সবকিছুর অন্যতম কারণ মোবাইল আসক্তি, প্রথম আলো (৯-১০-২২)
কাল নিউপোর্ট এই আসক্তি থেকে বের করার জন্য বিশ্বব্যাপী ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করেছেন। এটা হঠাৎ বন্ধ করার বিষয় নয়, পর্যায়ক্রমে মোবাইল আসক্তি বন্ধ করার জন্য পাশ্চাত্যে নিয়মিত ওয়ার্কশপ,লেকচার হচ্ছে। তারা কিছু পদ্ধতি প্রেসক্রিপশন করেছেন।
প্রথমতঃ মোবাইল ব্যবহার যত সময় বন্ধ করব তখন কি করব -একটা প্লান করতে হবে, পাশ্চাত্যে আউটডোর কর্মকান্ড যেমন খেলাধুলা, সাঁতার, গান গল্প করা ইতাদি।
কম প্রয়োজনীয় এপ মোবাইল থেকে বাদ দিতে হবে। নোটিফিকেশন বন্ধ রাখতে হবে ও কেবল জরুরি ফোন নাম্বার, মেসেজ বুক মার্ক করতে হবে,
সর্বোপরি পড়ার সময়, ঘুমানোর সময় বাচ্চাদের খাওয়ার সময় মোবাইল হাতের নাগালের বাইরে রাখতে হবে। পারিবারিক সময় কাটানোটা জরুরি বিবেচনা করতে হবে। পাশ্চাত্যে অ্যান্ড্রয়েডে এর বদলে সাধারণ ফার্স্ট জেনারেশ মোবাইল ব্যবহার করতে ডাক্তাররা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছে। স্কুল কলেজে ওখানে অ্যান্ড্রয়েড আনা নিষিদ্ধ, আমাদের দেশে এ ধরনের সমাজিক আন্দোলন না করে মোবাইল ব্যবহারকারীদের গানমন্দ, মারপিঠ ইত্যাদি করা হয়।
টেকনোলজী বিশারদ ক্রানজবার্গ মেলভিন বলেন, টেকনোলজি খারাপও না, ভালও না, নিরপেক্ষও না। মানুষের উচিত অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। মার্কিন মুলুকের সিলিকন ভ্যালির ব্যবসায়ী জিম ক্লাক স্টামফোর্ড ভার্সিটির ছাত্র শিক্ষকদের মাঝে চার ঘন্টাব্যাপী বক্তব্য রাখেন মোবাইল ও সোশ্যাল মিডিয়ার অতি ব্যবহারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, যে লোক মোবাইল নিয়ে সময় কাটায় সে অন্য কাজ করবে কখন? সে অথর্ব,সামাজিক ও জ্ঞান বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য। ফেসবুকে কমেন্ট দিয়ে না হবে পরীক্ষা পাস, না হবে চাকরি। এই কথাটা তরুণদের বুঝতে হবে। জিম ক্লার্ক বলেন, যত সীমিত উপকারই হউক মোবাইলও সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতি সর্বগ্রাসী। তার শেষ বক্তব্য Just dont appreciate Social net working. সেশাল মিডিয়া হেট স্পীচ, নির্বাচন প্রভাবিত করন, মহিলাদের সম্ভ্রম হরন থেকে শুরু করে পুরা সমাজকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে সরকার,সমাজ,পরিবার সবাই তরুণদের সময় কাটানোটা ফলপ্রসূ করে তুললেই এই মহামারী থেকে উদ্ধার সম্ভব। পাশ্চাত্যে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে এই মহামারীর বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ ঘর বহির্ভূত সমাবেশ, ক্রীড়া, বিনোদনের দিকে ঝুঁকছে। আমরা যেন নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে না আনি। ডাক্তাররা দুই থেকে পাঁচ বছর বাচ্চাদের কোন মোবাইল বা ল্যাপটপ বিনোদন নিষেধ করেছেন, পাঁচ থেকে সাত বছরের বাচ্চাদের কেবল আধা ঘন্টা বিনোদন দিতে বলেন তবে পড়াশোনার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। বয়স্কদের জন্য সারাদিন কেবল এক ঘন্টার অনুমতি রয়েছে।
কাল নিউপোর্ট এর বই ডিজিটাল মিনিমালিজম এর সার কথা choosing a focussed life in a noisy world. ফোকাস শব্দের বিপরীত শব্দ দিকভ্রান্ত অর্থাৎ বেসামাল পৃথিবীতে ফলপ্রসূ জীবন নির্বাচনের প্রচেষ্টাই হচ্ছে যত ন্যূনতম মোবাইল ব্যবহার করা। অন্যথায় আপনার জীবন হবে দিকভ্রান্ত।
আপনি ফোকাসড লাইফ চয়েস করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনকে অর্থবহ করবেন না মোবাইল নিয়ে জীবনকে দিক ভ্রান্ত করবেন চয়েসটা বোকাদের জন্য এরকম, সুচিন্তিত মানব সন্তানের জন্য একরকম।
লেখক : কলামিস্ট, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালদা রক্ষায় ডলফিন বাঁচাতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধমিয়ানমারের পাতা ফাঁদ বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ