রাঙামাটির নানিয়ারচরে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সরকারি খাস জমি বেদখল ও বেচাকেনার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় মৌজা হেডম্যানের কাছ থেকে এক বছরের জন্য সরকারি খাস জমি বন্দোবস্তি নিয়ে বেচাকেনা করা হচ্ছে। উপজেলার আওয়ামী লীগ–বিএনপির সাবেক–বর্তমান নেতা, খোদ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং তাদের আত্মীয়–স্বজনরা মিলেমিশে ‘বেদখল মহোৎসবে’ জড়িত হয়েছেন। বেদখল হয়ে যাওয়া জায়গা উপজেলার সৌন্দর্য অবলোকনের একটি স্থান হিসেবে পরিচিত। যেখান থেকে চেঙ্গী খালের দু’দিকের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কিন্তু সড়কের একপাশ ঘেঁষে স্থাপনা নির্মাণের কারণে সৌন্দর্যও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নানিয়ারচর উপজেলার পরিষদ কার্যালয়ের পাশে উপজেলা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিপরীত পাশে খালি জায়গায় ইটের পিলার (খুঁটি) বসিয়ে প্লট হিসেবে জায়গার ভাগ–বাটোয়ারা করা হয়েছে। পিচঢালা সড়ক ঘেঁষেই বাঁশ দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে শহীদ মিনারের বিপরীত পাশের সেতুর এপ্রোচ থেকে নানিয়ারচর নিম্ন–মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের আগ পর্যন্ত। একেবারে সড়কের এক পাশের পুরো খালি জায়গাটি বেদখল হয়ে গেছে।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, মোট ২৪টি প্লট ভাগাভাগি করা হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি প্লটে টিন–কাঠের আদলে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমাসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা ছয়কুড়িবিল মৌজার হেডম্যান মনিকা দেওয়ানের কাছ থেকে এক বছরের সরকারি খাস জমি এক সনা বন্দোবস্তি (খাজনা দেয়া বাবদ এক বছরের জন্য লিজ) নিয়ে প্লটগুলো ভাগ বাটোয়ারা করেন। বেদখল করা জায়গাটি ২৪টি প্লটে ভাগ করা হয়েছে। সরকারি খাস জমিতে ভাগাভাগিতে জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীদের নাম শোনা যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বুলেট চাকমার বরাদ্দকৃত জমিটি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল উদ্দিন এবং খোদ হেডম্যান মনিকা দেওয়ানের ছেলে দীপায়ন দেওয়ানের নামে বরাদ্দকৃত ভূমি মো. দুলাল নামের আরেক ব্যক্তি ক্রয় করেছেন।
নানিয়ারচর নিম্ন–মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তপন চাকমা বলেন, ‘রেকর্ড অনুযায়ী আমাদের বিদ্যালয়ের এক একর জায়গা রয়েছে। কিন্তু সব জায়গা আমাদের দখলে নেই। যেখানে স্থাপনা হচ্ছে সেখানে আমাদের জায়গাও রয়েছে। এই ব্যাপারে উপজেলা পুলিশ–প্রশাসনের কাছেও অভিযোগ জানিয়েছিলাম।’
নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের ভাইস–চেয়ারম্যান নুর জামাল হাওলাদার বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যানের নিজের জমি আছে কিনা জানি না। তবে উনার আত্মীয় স্বজনের রয়েছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে হেডম্যানের কাছ থেকে নেয়া এক বছরের বন্দোবস্তির জমি বিক্রির সুযোগ নেই। অনেকেই উন্নয়নের স্বার্থে সেই জমিতে গাছপালা সৃজন করতে পারেন। স্থাপনা নির্মাণ করা ওই জায়গায় কয়টা প্লট আমি জানি না, তবে আমার একটাও নেই। মানুষ বলাবলি করে সেখানে আমার প্লট আছে। আমিও আছি। কিন্তু এটা সত্য নয়। আমার কোন দরকার পড়েছে যে সরকারি খাস জমি ভাগাভাগি করে দেওয়ার। আমি তো প্লট ভাগাভাগি করতে পারি না। প্লটগুলোর মধ্যে প্রেসক্লাবসহ স্থানীয় পাহাড়ি–বাঙালিরা অনেকেই আছেন। এসব কথা তো ফোনে বলা যায় না। এই ব্যাপারে কোনো নিউজ করার দরকার নেই।’
বেদখল করা খাস ভূমি নানিয়ারচর উপজেলার নানিয়ারচর (সদর) ইউনিয়নে অবস্থিত হলেও মৌজাভিত্তিক হিসেবে এটি ছয়কুড়িবিল মৌজার অধীনে। ছয়কুড়িবিল মৌজার হেডম্যান মনিকা দেওয়ান জানান, ‘আমার কাছ থেকে এক সনা বন্দোবস্তির জন্য আবেদন করা হয়েছিল। আমি এক বছরের জন্য বন্দোবস্তি দিয়েছি, যেটা প্রতি বছরের জুন থেকে জুন পর্যন্ত। উপজেলা প্রশাসনের একটা রশিদ বই আছে, কর নিয়ে সেই রশিদ তাদের দেয়া হয়েছে। এক বছর পর সরকারি কর না দিলে তখন তাদের বন্দোবস্তি বাতিল হয়ে যাবে।’ বন্দোবস্তির সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান জড়িত আছে কিনা জানতে চাইলে হেডম্যান মনিকা বলেন, ‘২০–২৫ জন ব্যক্তি বন্দোবস্তির আবেদন করেছেন। এরমধ্যে চেয়ারম্যানও থাকতে পারেন। পার্বত্য এলাকায় ব্যক্তি পর্যায়ে স্থায়ী বন্দোবস্তির সুযোগ না থাকায় এক বছরের জন্য বন্দোবস্তি দেয়া যায়। পরবর্তীতে হেডম্যান চাইলে সেটি বাতিল করতে পারেন। এক সনা বন্দোবস্তির জমি বিক্রির সুযোগ নেই।’
নানিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ আমিমুল এহসান খান বলেন, ‘বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের নজরে এসেছে। বেদখলের শুরুতেই আমরা স্থাপনা নির্মাণে বাধা দিয়েছি। আমরা অন্যায়ভাবে কিছুতেই বেদখল করতে দেব না।’
রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’