মাহবুবা চৌধুরীর ‘হাতের দু’ভাঁজে ঘুম’

কাব্য-আলোচনা

আজিজ রাহমান | রবিবার , ২৭ জুন, ২০২১ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

কবি মাহবুবা চৌধুরী একজন শক্তিমান কবি যিনি ধ্বনি, শব্দ, পঙক্তির মাধ্যমে জীবনকে নিঙড়ে নিয়ে শৈল্পিক প্রকাশ ঘটান। একটি কথার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন অনুভবের অনেক কথা। সম্প্রতি বেরিয়েছে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘হাতের দু’ভাঁজে ঘুম’। গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো পড়ে কবিতাপ্রেমী যে কেউ তাঁর কাব্যরস আস্বাদন করতে পারবেন অনায়াসে। রাত্রির কালোছায়া আর দিনের আলোর মায়া ঘিরে জীবনকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করার দিকে কবির মনোযোগ আমাদের মোহিত করে। কবি স্পষ্ট করেন ‘শব্দের ছায়া’ কবিতায়- ‘রাত্রির জল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে/ বিকলাঙ্গ নপুংসক দিন, সুনসান/ শ্মশানচারী শৃগালেরা ওতপেতে বসে থাকে/ লাশের গন্ধ শুঁকে, ক্ষুধার্ত চোখ।/ প্রশ্ন করি প্রতারক আলোককে, কে তুমি?’ ‘সূর্যের উষ্ণতা’ কবিতায় অন্য এক আবহে অভিষিক্ত হন ‘জোছনার মেলা বসেছে চাঁদের দেউরিতে/ একহারা স্বপ্নের গোলায় হানা দিয়েছে/ এক চঞ্চল ইঁদুর, নেমে পড়েছে জলহীন/ নক্ষত্রের জলে, একটা বাউল গানের ডিঙি চড়ে,/ পৌঁছুবে চাঁদের হাটে, কিছু দিবে, কিছু নেবে/ স্বপ্নে উনুনে জ্বালাবে/ বাসনার ঊষ্ণ ঠোঁট।’
অগ্রসর সময় ও মানবিক মূল্যবোধ উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। একটি অসময়ের চিত্র রূপায়নেও তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। ‘অসম সময়’ কবিতায় তাঁর দৃষ্টিপাত ঘটালেন এভাবে, ‘আজন্ম দাঁড়িয়ে আছি, যেন বোধহীন/ পা থেকে সরে গেছে উর্বর মাটি/ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যেন বৃক্ষ আসন/ তুমি আমি ব্যাধিগ্রস্ত সোনালি আঁটি।’
তিনি কবিতায় বিছিয়ে দেন যন্ত্রণাকাতর ভাবভঙ্গির চালচিত্র। প্রেমও এই চালচিত্র ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। এই অনুভূতি তুলে ধরতে গিয়ে ‘পাণ্ডুর দহন’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘রাতের বুক যেন জ্বলন্ত চিতার কাঠ/ মৃত্যুর মাঝে একাকী দাঁড়িয়ে আছে/ নষ্ট দ্রাঘিমায় এসে ফুলের কঙ্কাল পোড়ে/ পড়ে থাকে তৃষ্ণার্ত বিপ্রতীপ প্রেম’। আবার ‘হাতের দু’ভাজে ঘুম’ কবিতায় তাঁর তেমনি উজ্জ্বল উচ্চারণ- ‘স্বপ্নভুক চেতনায় প্রেম পোড়ে সুনীল দহনে/ বুনেছি শস্যের ঘ্রাণ ভালোবেসে অতন্দ্র স্বপনে।’ তাছাড়া ব্যক্তির ভাঙচুর, ক্ষুধা ও শোষণের চিত্রণ কিংবা জীবন যৌবনের গভীর অন্তঃপুর বুননে তাঁর কবিতা নতুন মাত্রায় বিকশিত হয়।
এ কাব্যগ্রন্থের একটি বিশেষ দিক হলো, জাতির পিতার স্বপ্ন স্পর্শে কবি দেশকে জাগিয়ে তোলার কথা দেশিয় অনুষঙ্গে বিধৃত করেন কাব্যগ্রন্থের একেবারে শুরচর কবিতা দিয়ে। আবার এই গ্রন্থের শেষ কবিতায় তিনি আঞ্চলিক উচ্চারণে দেশকে আবারও বুকের জমিনে ঠাঁই করে নেন। শুরু এবং শেষ কবিতায় দেশকে ছুঁইয়ে দিয়ে তিনি দেশপ্রীতির দারুণ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
বিষয়বৈচিত্রে কবির অন্তরলোক সচেষ্ট। বেশিরভাগ কবিতা মুক্তছন্দে এগিয়ে নিয়ে গেলেও কোনো কোনো কবিতা অক্ষরবৃত্তে এগিয়েছে অল্পবিস্তর বিচ্যুতি ঘটিয়ে। কবির সচেতনতাই পারবে তাঁকে সবকিছু ছাপিয়ে নিটোল অবস্থানে পৌঁছে দিতে।
কিন্তু একথা অস্বীকার করার জো নেই, এ কাব্যগ্রন্থে শব্দচয়ন ও বুননে কবি মাহবুবা চৌধুরীর অসাধারণ মেধা ও মননের পরিচয় মেলে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে সমৃদ্ধ অবস্থানে মনের পাখা ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। চাঁদপুরে জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। দীর্ঘদিন কলেজের শিক্ষকতায় ছিলেন। সাথে সাথে বৈচিত্র্যময় কর্ম অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়েছে। ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এক মুঠো চাঁদ’। ‘হাঁতের দু’ভাঁজে ঘুম’ কাব্যগ্রন্থটি বেরিয়েছে শৈলী প্রকাশন থেকে। উত্তম সেনের কোলাজ প্রচ্ছদ দাগ কেটেছে। ১৭০ টাকা মূল্যের এ গ্রন্থটি পাঠককে ছুঁইয়ে যাবে এ আশাবাদ আমাদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামের নামে ছদ্মবেশীদের স্বরূপ উন্মোচনে আপসহীন ছিলেন নঈমী
পরবর্তী নিবন্ধএকটু ছুটি