মালকার বিয়ে হইব মনু মিয়ার সাথেরে

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | রবিবার , ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় তিনশ’ বছর আগে মনু মিয়ার পিতা শেরমস্ত খাঁ ছিলেন দিল্লির সম্রাট শাহজাহানের পুত্র বাংলার নবাব শাহ সুজার প্রধান সেনাপতি।
পরবর্তীতে আরাকান রাজ্যের অধীন রামুর চাকমা কুলের রাজা ছিলেন এই শেরমস্ত খাঁ। তিনিই আনোয়ারা উপজেলার শোলকাটা গ্রামে বসবাস করতেন। শেরমস্ত খাঁর একমাত্র পুত্র ছিলেন মনুমিয়া। খ্যাতনামা গবেষক ও চট্টলবিদ আবদুল হক চৌধুরী-জবরদস্ত খাঁকে শেরমস্ত খাঁ প্রকাশ মনু মিয়ার পিতা বলেই উল্লেখ করেছেন। সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম চৌধুরী ও ওহীদুল আলম চৌধুরী গ্রন্থিত চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে শেরমস্ত খাঁকে মনু মিয়া এবং পিতার নাম জবরদস্ত খাঁ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে রাজকীয় ফরমান মূলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায় চট্টগ্রাম। তারও বহু বছর আগে শেরমস্ত খাঁ আরাকান রাজ্যের অধীন সমুদ্র, পাহাড়, লাল-সবুজ টিলা আর পবর্তঘেরা দেয়াঙ রাজ্য তথা বর্তমান আনোয়ারার পশ্চিম শোলকাটা গ্রামে এসে বসতি শুরু করেন। মনু মিয়ার পিতা শেরমস্ত খাঁ এতই প্রভাবশালী ছিলেন যে, রামু থেকে চকরিয়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়া এবং আনোয়ারা পর্যন্ত বিশাল ভূ-সম্পদের অধিকারী ছিলেন তিনি। তার অধীনে ছিল ছোট ছোট বহু জমিদার।
শেরমস্ত খাঁর দুই সন্তান। তাদের মধ্যে একজন জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া। অপর এক কন্যা হলেন কালাবিবি চৌধুরানী। পিতার মৃত্যুর পর বিশাল জমিদারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেরমস্ত খাঁর একমাত্র পুত্র মনু মিয়া। তবে তাদের জমিদারির সময়কাল সম্পর্কে, সঠিক কোনো তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়নি।
তবে আনোয়ারা উপজেলার পশ্চিম শোলকাটা গ্রামে মনু মিয়ার রাজপ্রাসাদ ছিল। এটি প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিনশ’ বছর আগের ইতিহাস। এখন মনু মিয়ার বিশাল এই বসতভিটায় কোনো রাজপ্রাসাদ নেই। কালের পরিক্রমায় এখানে গড়ে উঠেছে পাকা, কাঁচা-পাকা ছোট-বড় অসংখ্য বসতি। তবে তার এই বসতভিটা এবং বিশাল এলাকাজুড়ে বহু স্মৃতিচিহ্ন আজও কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে সগৌরবে। বসতভিটার সামনে এবং পেছনে তৎকালীন নির্মিত দীর্ঘ প্রাচীরের অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান। পোড়া মাটির তৈরি বিশেষ ধরনের ইট দিয়ে তৈরি প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ এখনো চোখে পড়ে। এক ইঞ্চি মোটা এবং পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি চওড়া এ ধরনের ইট মুঘল আমল কিংবা তারও আগের সময়কার বিভিন্ন স্থাপনায় দেখতে পাওয়া যায়।
মনু মিয়ার বসতভিটার চারপাশে প্রায় দেড় থেকে দুই হাত চওড়া উঁচু প্রাচীরের অস্তিত্ব আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও ছিল। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধীরে ধীরে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে মনু মিয়ার বসতভিটা থেকে মাত্র তিনশ’ গজ সামনে রয়েছে ‘মনুমিয়ার দীঘি’ নামে প্রকাণ্ড এক দীঘি। সবুজ বৃক্ষরাজি পরিবেষ্টিত বিশাল এই দীঘিটি আজও পর্যটক এবং পথচারীদের নজর কাড়ে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার হিসেবে পিতা শেরমস্ত খাঁর চেয়েও অধিক প্রভাবশালী ছিলেন মনুমিয়া। তিনি এতই শক্তিধর জমিদার ছিলেন যে যুদ্ধে ব্যবহৃত মুঘল আমলের শক্তিশালী কামান পর্যন্ত তার সমরাস্ত্র ভাণ্ডারে মজুদ ছিল। প্রায় তিনশ’ বছর পর এর প্রমাণও মিলেছে।
মনুমিয়ার ঐতিহাসিক রাজবাড়ির সামনে এবং পেছনে দুটি বিশাল পাকা গেট ছিল। দুই গেটে বসানো ছিল মস্ত বড় দুটি কামান। খুব সম্ভবত দেয়াঙ বন্দরে পর্তুগিজ জলদস্যুদের হামলা এবং বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে মনুমিয়ার রাজবাড়ির পেছনের গেটের ধ্বংসস্তূপের নিচে তলিয়ে যাওয়া প্রায় সাত মণ ওজনের একটি কামান উদ্ধার করা হয়। খবর পেয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কামানটি নিয়ে যায়। বর্তমানে কামানটি নৌ-বাহিনীর হেফাজতে রয়েছে।
বলা বাহুল্য, মনু মিয়ার উদ্যোগে আনোয়ারায় নির্মিত স্থাপনা এখনো বহন করছে তাঁর ইতিহাস। এই গ্রামে মনু মিয়ার নির্মিত একটি মসজিদ আছে। মসজিদটির পরিসর ছোট হলেও এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী এবং পরিবেশ অপূর্ব। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছরের পুরনো এই মসজিদটি আজও সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।
মুঘল আমলের মসজিদটি সামনের দিকে কিছুটা সম্প্রসারণ করা হলেও মূল অবকাঠামো ঠিক রাখা হয়েছে। ২০ ও ৪০ ফুট আয়তনের মসজিদের দেয়ালজুড়ে, ভেতরে বাইরে নান্দনিক কারুকাজ আর গম্বুজ। মসজিদের প্রবেশপথে একটি ফলকে লেখা আছে, ‘মুঘল আমলের শেষের দিকে জমিদার জবরদস্ত খাঁ (মনু মিয়া) এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর প্রথমা স্ত্রী খোরসা বানুর নামে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। তাঁর আরেক স্ত্রী ছিলেন বাঁশখালীর সরল গ্রামের বিখ্যাত মালকা বানু। নির্মাণের পর থেকে এই মসজিদটি আর সংস্কার করা হয়নি। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও এর সৌন্দর্য বাড়াতে ১৪১৭ এবং ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটিতে টালি সংযোজন ও সংস্কার করে।’
চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থ দেয়াঙ পরগণার ইতিহাসএর তথ্যমতে, মনু মিয়া প্রথমে বিয়ে করেন কাট্টলীর জমিদার দেওয়ান বদিউজ্জমানের বোন খোরসা বানুকে। খোরসা বানুর কোনো সন্তান না হওয়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল গ্রামের সওদাগর কন্যা মালকা বানুকে। মালকা বানুকে দেখা আর পরে তাঁকে বিয়ে করাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় লোকগাথা মালকা-মনুর প্রেম উপাখ্যান।
ইতিহাস গ্রন্থে আছে, মনু মিয়া একদিন পাইক-পেয়াদা নিয়ে জমিদারি দেখতে বাঁশখালীর সরল গ্রামে যান। সেখানে সওদাগর বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেন। ওই সময় মনু মিয়ার চোখে পড়ে সওদাগরের মেয়ে মালকা বানুকে। মালকা তখন কাজির মক্তবে পড়াশোনা করতেন। তখন মনু মিয়া কাজির কাছ থেকে মালকা বানু সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেন। কাজির মক্তবে মনু আরও একবার খুব কাছ থেকে দেখেন মালকাকে। এরপর মনুর নাওয়া-খাওয়া যেন বন্ধ হয়ে গেল। মনুর ভাবনায় শুধুই মালকা। মালকাকে চাই মনুর।
সেই থেকে মালকার টানে মালকা বানুর বাড়িতে ছুটে যেতেন মনু। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে মালকা-মনুর প্রেমের কাহিনি। একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচবেন না। একদিন মনুর পক্ষ থেকে মক্তবের কাজির মাধ্যমে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব যায় সওদাগর বাড়িতে, মালকা বানুর বাবার কাছে। মালকার বাবাও মনুর প্রস্তাবে খুশি হলেন। তবে বেঁকে বসলেন মালকা। তিনি শর্ত দিলেন, নদীপথে নৌকা পারাপারে তাঁর ভয় করে। তাই নিতে হবে সড়কপথে। এ কথা শোনার পর মনু দেরি না করে নদে বাঁধ দিয়ে সড়ক তৈরি করেই মালকাকে আনার সিদ্ধান্ত নেন। মনু শঙ্খ নদে বাঁধ দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন এবং হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেন নদে বাঁধ দেওয়ার জন্য। বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে শুরু হয় বিয়ের আয়োজন। মালকা এলেন মনুর ঘরে। মালকা-মনুর এই প্রেম ও বিয়ের উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট লোকগীতি আজও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে।
‘জলদী থানার মাঝেরে, এক সদাইগর রে
সেই না সদাইগরের কন্যা নামে মালকা বানুরে ।
মালকা বানুর সাত ভাই, অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই
মালকার বিয়া হইব মনু মিয়ার সাথেরে।
মনু মিয়ার দেশেরে জোড়ের খাড়া বাজেরে
যাইবরে মনু মিয়া হাউসের মালকার দেশেরে।
মনু মিয়া লইল সাজ মাথায় দিল সোনার তাজ
যাইবরে মনু মিয়া হাউসের মালকা বানুর দেশেরে।’ (সংক্ষেপিত)
কিন্তু দুর্ভাগ্য মালকা বানুর গর্ভেও মনু মিয়ার ঔরসে কোনো সন্তান জন্ম নেয়নি। নিঃসন্তান মনু মিয়া মারা যাওয়ার পর পাশে কাজীর পাহাড় এলাকায় কবর দেওয়া হয়। মনুর মৃত্যুর পর প্রথম স্ত্রী খোরসা বানু স্বামীর বাড়িতে থেকে গেলেও বাঁশখালীর সরল গ্রামে বাবার বাড়ি চলে যান দ্বিতীয় স্ত্রী মালকা বানু।
পুঁথি গবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী সংগৃহীত একটি প্রাচীন দলিলের বরাত দিয়ে দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস-আদিকাল গ্রন্থে বলা হয়েছে, মুক্তিনামা নামে উক্ত দলিলে দাতার নাম জমিদার রানী মালকা বানুর স্বাক্ষর রয়েছে। দলিলটি সম্পাদিত হয় ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে। মালকা বানুর পিতা ও ভাই ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ৮টি গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবারকে সেবায়েত হিসেবে দলিলমূলে কিছু জমি দান করেছিলেন।
মালকা বানু ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় উক্ত দলিল যোগে সেবায়েতদের পুনঃ মঞ্জুরি দান করেন। দলিলে দেখা যায় মলাকা বানুর পিতার নাম আনিস এবং স্বামীর নাম রয়েছে আব্দুল হালিম। এ থেকে এ ধারণা করা হয় মনু মিয়ার মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় স্ত্রী মলকাবানু বাঁশখালী থানার সরল গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে সেখান থেকেই জমিদারী পরিচালনা করতেন।
অপরদিকে মনু মিয়ার উত্তরাধিকার কেউ না থাকলেও মনু মিয়ার মসজিদ, কবরস্থান আর সুবিশাল দিঘি জানান দেয় ইতিহাসের।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে : ফজলে করিম
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য