মানবতাই মহাশক্তি

রূপক কুমার রক্ষিত | রবিবার , ৯ মে, ২০২১ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

মানবতা এমন একটি গুণ যা মানুষকে যন্ত্র-মানব না হয়ে সৃজনশীল হতে সহায়তা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, মানবকূলে মানবতা ক্রমশ কলুষিত হচ্ছে। বর্তমান কালে ব্যক্তিগত সুনাম বা ক্ষমতা বা অন্য কোন লোভনীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবতা চর্চার অভিনয় দেখা যায়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অভিপ্রায়ে মানুষের মধ্যে মানবতা বিবর্জিত এক ধরনের নিষ্ঠুরতা ও লোভ-লালসায় মনের মন্দ ভাবের তৎপরতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। উচ্চতর ডিগ্রীধারী ও উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী হয়েও নীতি বিবর্জিত হঠকারিতায় প্রলুব্ধ হয়। অসাধু স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে জনসাধারণের স্বার্থহানীতেও শঙ্কা বোধ করেনা। ভাল-মন্দে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে রাতারাতি ধন, মান, খ্যাতি ও যশের অধিকারী হবার নেশায় অসাধু প্রতিযোগিতায় নামে। দেশ বা জাতির সংকটকালেও তারা সুযোগসন্ধানী ভূমিকায় তৎপর থাকে। মহামারী বা অন্য কোন জরুরি সংকটে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি ভয়ানক আতংকের মাঝেও জীবনকে বাঁচানোর শেষ আবেদনটুকু নিয়ে যখন মানুষ সেবা গ্রহণের জন্য তাদের শরণাপন্ন হয় — তখনও তারা মানুষের প্রতি মানবতাবোধে ন্যূনতম মর্মস্পর্শী না হয়ে সংকটের ফাঁদে সুবিধা ভোগের সন্ধানে থাকে। এ যেন মানব জীবনে মহাকালের মহাঅভিশাপ। মানব সংকট নিরসনে কর্তব্যকর্মে দায়বদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অবহেলা, অসহযোগিতা, অবমাননা বা হীনম্মন্যতায় তারা মানবতাকে ক্ষত-বিক্ষত ও বিধ্বস্ত করে এবং মানুষকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়। এ বিভৎস বিকৃত মানসিকতা সত্যিই লজ্জার। এ মানসিকতা দেশ ও দেশের মানুষের চিরস্থায়ী ক্ষতি করে ও মানবতায় হিংসাত্মক তৎপরতা ছড়ায়। এরূপ পরিস্থিতিতে অনৈতিক স্বার্থ হাসিলে তারা নানা অমানবিক ছলছাতুরির আশ্রয় নেয়, পেশী শক্তি ব্যবহার করে জোর-জুলুমে লিপ্ত হয়, এমনকি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জীবনের উপরও আক্রমণ করে। এতে মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ও সোহার্দ্যের অবনতি ঘটে এবং অপতৎপরতা ও ব্যভিচার বৃদ্ধি পেয়ে সমাজ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়। মানবতা বোধে এরূপ মানবিক সংকট সভ্যতার ক্রমবিকাশে অন্তরায় বটে।
বৈশ্বিক ক্ষেত্রে মানব সম্প্রদায়ের এ অমানবিক যজ্ঞ আরও ভয়ানক। দেশে-দেশে, জাতিতে- জাতিতে নানা ইস্যুতে মানব ও মানবতা হননের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। রাজ্য দখল, ধর্মীয় অনুভূতি বা দেশাত্মবোধে যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানবতাবোধ নগ্নভাবে বিধ্বস্ত হয়। আর এর স্বীকার হয় লক্ষ-কোটি নির্দোষ অসহায় মানুষ যারা স্বজন-সর্বস্ব হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধর্ম, জাতি ও অন্য যেকোন স্বার্থান্বেষী বিষয়ে মানবসৃষ্ট এ ধরনের বিভেদ সৃষ্টিকারী অসম প্রতিযোগিতার ফলে সমাজ ও দেশে বারবার অবক্ষয় নেমে আসে। মানবতার প্রতি মানবসম্প্রদায়ের এ নিষ্ঠুরতা বড়ই নির্মম। অথচ জীবনের মূল ধারা হচ্ছে মানবতা। এর জন্যে মূলত জাতি, সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে সমুন্নত রেখেই মানুষের প্রতি মানুষের মানবিক হওয়া উচিত। কিন্তু মানুষের প্রতি শর্তবিহীন ভালোবাসার পরিবর্তে মানুষ মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ভুলতে বসেছে যার ফলে মানবতা লোপ পাচ্ছে। মানবতা বোধের এ অবক্ষয় মানে শুধুমাত্র খারাপ কাজ করাকে বা মানুষের ক্ষতিকারক কার্যকলাপকে নির্দেশ করে না, এতে মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধের সম্পৃক্ততার অবনতির ইংগিতও পাওয়া যায়। তাই মানবতাবোধের এ অবক্ষয় যেমন মেনে নেয়ার নয় তেমন এ অবক্ষয় রোধ অসম্ভবও নয়। মানবিক গুণের শক্তি অপরিসীম– মানবিক মানুষের মানবিক তৎপরতায় অমানবিকতার নাশকতা সহজেই বিলীন হয়ে যায়। অমানবিকতার এ অবক্ষয় রোধ করার জন্যে মানবিক শক্তির ব্যবহারই যথেষ্ট। পৃথিবীতে মানবিক মানুষ একেবারে কম নয়। গুটিকয়েক অমানবিক লোকের অমানবিকতা পৃথিবীর শান্তি নষ্টের কারণ হতে পারে না। অন্ধকার সত্য কিন্তু আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকারও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। মাহাত্মা গান্ধী বলেছেন,“ণড়ঁ সঁংঃ হড়ঃ ষড়ংব ভধরঃয রহ যঁসধহরঃু, ঐঁসধহরঃু রং ধহ ড়পবধহ, রভ ধ ভব িফৎড়ঢ়ং ড়ভ ঃযব ড়পবধহ ধৎব ফরৎঃু, ঃযব ড়পবধহ ফড়বং হড়ঃ নবপড়সব ফরৎঃু.– সত্যিই মহাসাগরসম মানবতা বোধ অবহেলায় কর্দমাক্ত হবার নয়, নোংরা চিন্তাকে পরিহার করে সকলে একত্রে শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্যে মানবিক কাজ করা জরুরী ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও স্পষ্টভাবে ধর্ম ও মানবতার মধ্যে সম্পর্কের সেতু বন্ধন করে বলেছেন, স্বর্গের সাথে যোগসূত্র সৃষ্টি করতে হলে মানবতা ধারণ করতে হবে। অসহায় ভাগ্যহীনদের সাহায্য করা–ঈশ্বরকে সেবার সমতুল্য। মানবতা হলো আত্মার ধর্ম। সত্যিকার অর্থে, মানবতার আত্মাকে জাগ্রত করা না গেলে মানবতা কেন্দ্রীভূত হবে এবং তা ক্রমশ ফ্যাশন ও প্রহসনে পরিণত হবে। মানবতা যুগে যুগে প্রজন্ম পরম্পরায় সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানবিক মূল্যবোধকে প্রসারিত করে। সকল মানুষের সাধারণ স্বপ্ন একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী। এ পৃথবীকে শান্তিপূর্ণ বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে প্রত্যেকের নিজ নিজ মানবিক বোধ নিয়ে ভাবা উচিত।
বলাবাহুল্য, মানবতা একটি স্বতন্ত্র গুণ যা মানুষকে অন্য মানুষ হতে পৃথক করে। প্রকৃত অর্থে মানবতা হলো মানুষের মানবিক বোধ হতে উদ্ভুত নৈতিক সত্তা যা মানুষকে পরার্থে নিজেকে উৎসর্গীকরণে প্রলুদ্ধ করে। ল্যাটিন শব্দ ‘হিউম্যানিটাস’ থেকে উদ্ভুত ‘হিউম্যানিটি’ শব্দটি মানব হৃদয়ে প্রতিনিয়িত মানবতার সতর্ক ঘন্টা বজিয়ে চলেছে। কিন্তু কর্মজীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও প্রতিযোগিতার ব্যস্ততার ভীড়ে মানুষ এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে যে মানবতা বোধের তাড়নায় মানবিক ভাবনা অবিকশিত থাকে। বাস্তবিক পক্ষে আমরা ভাবি অনেক, অনুভব করি কম; কৃত্রিমতার চেয়ে আমাদের অধিক প্রয়োজন আন্তরিকতা ; চতুরতার চেয়ে অধিক প্রয়োজন দয়া ও বিনয়– এ বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে না পারলে মানব জীবন হিংস্রতায় বিপন্ন হবে। অবিরাম যুদ্ধ বা মানব হত্যা মানুষকে মানবতাবোধে জাগ্রত করার স্বপ্নপূরণে বাধাগ্রস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে ভিন্নতা সম্পর্কে আমাদের সহনীয় হতে হবে যাতে আমাদের মাঝে সত্যিকার মানবতাবোধের সূত্রপাত ঘটে। ভিন্নতা একটি সাধারণ ব্যাপার, এটা সবসময় স্বাগতম; কিন্তু ভিন্নতাকে ঘিরে কোন দুষ্ট চিন্তাকে অংকুরে বিনষ্ট করতে হবে। মনে রাখা দরকার, যখন আমরা সহনশীলতার কথা বলি তখন সেটা সবার নিকট আশাপ্রদ। কারো এমন কোন অসহনীয় আচরণ করা উচিত নয় যা হতে অন্যের ও অনুরূপ অসহনীয় আচরণ করার উদ্রেক সৃষ্টি হয়। অনেক সময় অসহনীয় আচরনের মাধ্যমে অন্যের সহনীয় আচরণ আশা করা হয় যা প্রায়ই অসম্ভব। মানবতার পূর্বশর্ত হলো মানুষের প্রতি যথার্থ মূল্যবোধ। বস্তুত, সবার উপর মনুষ সত্য, তাহার উপর নাই- চন্ডী দাসের এ বাণী মানুষের মাঝে আজীবন মানবতাবোধের প্রেরণা যোগায়। মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, সমতা, সহমর্মিতা, ক্ষমা, সহানুভূতিবোধ হতেই মনুষ্যত্বের সুত্রপাত ঘটে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ‘প্রেম এবং সহানুভূতি জীবনের জন্য অপরিহার্য, বিলাসিতা নয়’। ইহা ছাড়া মানবতা অচল। ‘মানব জন্ম’ হল প্রদত্ত কিন্তু ‘মানবতা ধারণ’ হচ্ছে ইচ্ছা। এ দুর্লভ মানব জনমে মানবতা ধারণ করা না গেলে মানবতা বোধে মানবিক সংকট নিরসন করা কঠিন হবে। সকল বৈষম্যের অন্তরায়কে পরাভূত করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার এ গুরু দায়িত্ব আগামী প্রজম্মের উপর বর্তায় নি:সন্দেহে। প্রত্যাশায় থাকি, আগামী দিনের বৈশ্বিক মানবতা আগামী প্রজন্মের চেতনায় আলোর পথ পাবে। নেলসন ম্যান্ডেলার কথায় বলি, ওঃ রং ঃরসব ভড়ৎ ঃযব হবীঃ মবহবৎধঃরড়হ ঃড় পড়হঃরহঁব ড়ঁৎ ংঃৎঁমমষব ধমধরহংঃ ংড়পরধষ রহলঁংঃরপব ধহফ ভড়ৎ ঃযব ৎরমযঃং ড়ভ যঁসধহরঃু. রঃ রং রহ ুড়ঁৎ যধহফং. মানবতাই বিশ্বের মহাশক্তি। ধর্ম বিশ্বাসীদের জন্য এটাই মূল ধর্ম, মুক্তির পথ।
লেখক : ডিজিএম, রূপালী ব্যাংক লিমিটেড

পূর্ববর্তী নিবন্ধলাইলাতুল ক্বদর
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে