মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, করোনার ওষুধ সহজলভ্য হোক

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ২০ এপ্রিল, ২০২১ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া এক মাকে মোটর সাইকেলে বসিয়ে বাইকের সাথে সিলিন্ডার বেঁধে হাসপাতালে হাসপাতালে সন্তানের ছুটে চলার একটি ছবি মানুষকে শংকিত করেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে মায়ের কী হবে? এটিই করোনার একমাত্র দৃশ্য নয়, আরো দৃশ্য আছে। আছে করুণ গল্প। নীরবে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার নির্মম ঘটনাও আছে। দেশে প্রতিদিন অনেক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে পরীক্ষা করতে পারছেন, অনেকে পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন না। কারো মাঝে উপসর্গ আছে, কারো নেই। শত শত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন ঘরে, পরিচিত চিকিৎসকদের পরামর্শে। আবার অনেক রোগী ছুটছেন হাসপাতালে। আইসিইউ তো দূরের কথা, সাধারণ একটি বেডের অভাবে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন।
গবেষণায় জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তির ৫ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন ৪৮ শতাংশ রোগী। উপসর্গ প্রকাশের ১০ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন ৩৮ শতাংশ মানুষ। দেশে প্রতি ১২.৮ মিনিটে একজন করে মানুষ মারা যাচ্ছেন। মুহূর্তে একজন মানুষের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়া এবং আইসিইউ, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কিংবা লাইফ সাপোর্ট হয়ে মরে যাওয়ার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছে মানুষ। করোনার চিকিৎসায় কোন ওষুধ কাজ করবে, কোন ওষুধ কাজ করবে না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও দেশি-বিদেশি নানা ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। সুফলও মিলছে। মানুষ সুস্থ হচ্ছেন। আবার সব ধরনের চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবহার করেও মারা যাচ্ছেন অনেকে।
কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য মানুষের আকুতি স্বাভাবিক। কিন্তু সুস্থ হতে গিয়ে কতজন যে তাদের পরিবার-পরিজনকে পথে বসিয়ে দিচ্ছেন সেই গল্প অজানা। একজন কোভিড রোগী আইসিইউ বা লাইফ সাপোর্টে থাকলে তার চিকিৎসা কোত্থেকে, কীভাবে হচ্ছে সেই খবর অধিকাংশ সময় জানার মতো পরিবেশে তিনি থাকেন না। প্রিয়জনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্বজনদের আহাজারি অনেকেরই অজানা। এত কিছুর পরও চিকিৎসা সংকটে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছেন। সাথে নিজের অজান্তেই পুরো পরিবারকে সংকটে ফেলে যাচ্ছেন। আবার নানা শারীরিক জটিলতা থেকে অনেকেই সুস্থ হচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরো পরিবার পড়ছে আর্থিক সংকটে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছি। করোনা চিকিৎসায় সবার অবস্থা খারাপ হচ্ছে না। কিছু মানুষের হচ্ছে। এই সংখ্যা কিন্তু কম নয়। যাদের বাঁচানোর জন্য দেশি-বিদেশি নানা ওষুধ প্রয়োগ করতে হচ্ছে। এসব ওষুধ করোনা হানা দেওয়ার আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সারসহ নানা চিকিৎসায় ব্যবহৃত দামি ওষুধগুলোর প্রয়োগ এই দুর্দিনে মানুষকে আলো দেখাচ্ছে। কিন্তু সব মানুষ এই আলো পাচ্ছেন না। পেলেও একজনের বাঁচার পাশাপাশি পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জটিল অবস্থায় পড়া কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় সুইজারল্যান্ডের রোচ কোম্পানির তৈরি বিশেষ দুটি ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এ্যাক্টেমেরা নামের এই ইনজেকশনের ৪০০ এমজির দাম ৪৩ হাজার টাকা, ২০০ এমজির দাম ২১ হাজার ৫শ টাকা। রেডিয়েন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড সুইজারল্যান্ড থেকে এই ওষুধ আমদানি করে। চিকিৎসকদের প্রথম পছন্দ এ্যাক্টেমেরা হলেও রেডিয়েন্ট তা যোগান দিতে পারে না। দেশে কোথাও স্বাভাবিকভাবে এ্যাক্টেমেরা ইনজেকশন পাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের একই কোম্পানির তৈরি এবং বাংলাদেশেও একই কোম্পানির আমদানিকৃত এভাসটিন ইনজেকশন পাওয়া যায়। তবে তাও সহজপ্রাপ্য নয়। নানা তদবির ও চেষ্টায় জোগাড় করতে হয় দামি এই ইনজেকশন। ৪০০ এমজির প্রতিটি ইনজেকশনের দাম ৭৮ হাজার টাকা, ১০০ এমজির দাম ২০ হাজার টাকা। শারীরিক ওজন হিসেব করে প্রয়োগ করা হয় এভাসটিন। কাউকে একটি, কাউকে দুটি। এক্ষেত্রে এভাসটিন ইনজেকশন দিতে মোটামুটি ওজনের একজন মানুষের খরচ হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন, শুধু এভাসটিন দিয়ে চিকিৎসা হয় না। রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে সেজন্য নাভিতে সকাল-সন্ধ্যা দেশি-বিদেশি ইনজেকশন পুশ করা হয়। একেকটি ইনজেকশনের দাম ৫/৭শ টাকা। একজন রোগীকে ২৫/৩০টি ইনজেকশন দিতে যে পরিমাণ খরচ হয় তা জোগাড় করার সাধ্য সাধারণ মানুষের নেই।
শুধু কি ইনজেকশন? সাথে আইসিইউ, অঙিজেন বিল, বিভিন্ন টেস্ট ও অন্যান্য খরচ মিলে যে অংক দাঁড়ায় তা বহন করা কঠিন। সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হলেও আনুষঙ্গিক অনেক খরচ রোগীকে বহন করতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকারিভাবে হাসপাতালে এভাসটিন বা এ্যাক্টেমেরা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে দেশে তৈরি রেমডেসিভির ইনজেকশন দেওয়ার কথা। দেওয়াও হতো। দুটি ইনজেকশন একই নয়, কাজও সমান নয়। তবুও যাদের ফুসফুস অন্তত ৩০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত তাদের সারানোর ক্ষেত্রে রেমডেসিভির ইনজেকশন দেওয়া হতো। কিন্তু চট্টগ্রামে সরকারিভাবে কোথাও তা পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ছয় ভায়াল রেমডেসিভির ইনজেকশন দিতে হয়। সরকারিভাবে পাওয়া না গেলেও বাজারে দেশীয় কোম্পানির এই ওষুধ মিলে। খোলা বাজার থেকে যা কিনতে ২০ হাজার টাকা লাগে। শ্রমজীবী একজন মানুষের পক্ষে এত টাকার ইনজেকশন কিনে সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব?
করোনায় জটিল রোগীরা সুস্থ হলেও তাদের অন্তত তিন মাস হার্ট অ্যাটাকসহ নানা ঝুঁকি থাকে। ডায়াবেটিস হয় কিংবা বেড়ে যায়। লিভারসহ শরীরে তৈরি হয় জটিলতা। রক্ত পাতলা রাখার ইনজেকশন বা ট্যাবলেটসহ নানা ওষুধ খেতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কোভিড চিকিৎসার দামি ইনজেকশন ছাড়াও আরো অনেক খরচ। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানলাম, কয়েকদিন আইসিইউসহ একটু কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে গড়ে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে। এর একটি বড় অংশ ওষুধ ও টেস্টের। কোভিড চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলো বড় ভূমিকা রাখছে। অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। কিন্তু ইনজেকশন ও ওষুধ সবাইকে প্রায় একই দামে কিনতে হচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশে বিদেশি ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়ার আশা কেউ করে না। ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে অনেক দামি এই ওষুধের ট্যাঙ, ভ্যাট, সার্ভিস চার্জও বেশি নয় বলে জানিয়েছে রেডিয়েন্ট। ওষুধটিই দামি। সিঙ্গাপুর বা আমেরিকায় আরো বেশি দামে বিক্রি হয়। বিশেষ ব্যবস্থাপনা বা ভর্তুকির মাধ্যমে এভাসটিনসহ অন্যান্য ওষুধের দাম যদি সহনীয় করা হয়, তাহলে অনেক মানুষের উপকার হবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। নানা পন্থায় লোপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ক্যাসিনোকাণ্ডসহ নানা খাত থেকে প্রচুর অর্থ সরকার জব্দ করেছে। চোরাচালানের কয়েক হাজার মণ স্বর্ণ ভল্টে আছে। রিজার্ভে তেজি ভাব। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, এঙপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেলসহ নানা প্রকল্পের কাজ চলছে।
মানুষের জন্য উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, কিন্তু করোনার ওষুধ সহজলভ্য এবং সস্তা করে মানুষ বাঁচানো আরো বেশি দরকার। করোনার ওষুধ সহজলভ্য করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ওষুধ ও চিকিৎসার অভাবে কোনো জটিল রোগী যেন মারা না যান।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার হাতে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। আমরা নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলতে চাই। বুক ভরে নিতে চাই নিশ্বাস।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোভিডে ব্যাংককর্মীর মৃত্যু হলে পরিবার পাবে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা
পরবর্তী নিবন্ধকৃষি অর্থনীতির সঙ্গে শিল্পেও বিশেষ নজর : প্রধানমন্ত্রী