মহাসড়ক নিরাপদ হবে কবে?

ঋত্বিক নয়ন | বুধবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

নিরাপদ সড়কের দাবি যেন গুমরে কেঁদে মরছে। একদিকে অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ বা ফিটনেসবিহীন যানবাহন। এই দুইয়ে মিলে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক অনিরাপদ করে তুলেছে। কোনোভাবেই থামছে না দুর্ঘটনা। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে হাটহাজারীর চারিয়া এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছেন। এভাবেই চলতি বছর গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত দশ মাসে শুধুমাত্র ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে ৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৯৭ জন। আহতের সংখ্যা দেড়শতাধিক।

সড়কে এভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুই যেন নিয়তি এখন। ফলে সড়কপথে ভ্রমণ করা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলোচালকের অদক্ষতা, চালকের ক্লান্তি, গাড়ির বেপরোয়া গতি এবং গাড়ির ফিটনেস না থাকা। সাধারণের মনে এখন একটাই প্রশ্নমহাসড়ক নিরাপদ হবে কবে? গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত গতি এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া চালকের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের পরামর্শ ও সুপারিশও করা হয়। কিন্তু কেউ তাতে কর্ণপাত করেন বলে মনে হয় না। কর্তৃপক্ষও যেন নির্বিকার। ফলে একের পর এক ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ২০১৯ সালে একটি আইন কার্যকর করা হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন আজও নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা পার পেয়ে যাচ্ছেন সহজেই। দেশে সড়ক দুর্ঘটনা উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় এ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

মহাসড়কে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ উদ্বেগের মধ্যে দিনযাপন করছেন। বিশেষ করে সড়কের পাশে স্কুল হওয়ায় শিক্ষার্থীরা বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে কর্মসূচি পালন করলেও সড়কগুলো এখনো অনিরাপদ। গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই মহাসড়কের কোনো না কোনো স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু মীরসরাইসীতাকুণ্ড অংশে গত এক সপ্তাহে ১০টি দুর্ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ১৩ জন। পুলিশ এবং ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন চেষ্টার পরও মহাসড়কের এই অংশে দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। কয়েকজন যাত্রী আজাদীকে বলেন, মহাসড়কে বের হওয়ার আগে দোয়াদরুদ পড়তে হয়।

মহাসড়কে চলাচল করা যাত্রীদের অভিযোগ, বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালানো, মাত্রাতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকের প্রতিযোগিতা, চালকদের অবসাদগ্রস্ততা কিংবা মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি, চালকদের অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অনভিজ্ঞতা এবং ট্রাফিক আইন না জানা ও যথাযথ অনুসরণ না করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা জানান, মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিষিদ্ধ থাকায় গাড়ির চালকরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। ফলে ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছে। ফলে মহাসড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে লাশের সংখ্যা।

ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল করা বাসের কয়েকজন চালক বলেন, সড়কে গাড়ি বের করার সময় অনেক গাড়ির মালিক চালককে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেন। তাতে চালকদের নির্ধারিত সময়ে পৌঁছার তাড়া থাকে। আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা।

ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) রফিক আহমেদ মজুমদার জানান, ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে চালকদের ৭০ শতাংশের বৈধ কাগজপত্র নেই। বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে যেসব যানবাহনের চালক ও গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নেই ইতোমধ্যে তাদের কয়েক দফা জরিমানা করা হয়েছে। তারপরও দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। ক্রমান্বয়ে সংঘটিত এসব দুর্ঘটনায় ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রী সাধারণের পাশাপাশি যানবাহন চালকমালিকরাও এখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সড়কের পাশে যাওয়াআসা করা স্কুল শিক্ষার্থী ও পথচারীরা।

প্রশ্ন একটাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও সড়কগুলো এখনো অনিরাপদ কেন?

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক নিরাপত্তায় ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, থানা পুলিশ, আনসার নিয়োজিত রয়েছেন। জেলার সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, বিআরটিএ সুশৃঙ্খল যানবাহন চলাচলে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু এতকিছুর পরও যদি সড়ক নিরাপদ না হয়, দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকে, তাহলে স্বভাবতই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে সকল দায়িত্ব। আবার এসবের দায় নিতেও রাজি নয় দায়িত্বশীল কেউ। বরং লরি, কাভার্ডভ্যান, ট্রাক ও বাসের মতো অন্যের কাঁধে দোষ চাপাতে ব্যস্ত সবাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২৫০০ টাকা নির্ধারণ
পরবর্তী নিবন্ধএক পরিবারের ৭ জনের মৃত্যু