মশা কমে না কেন

চসিকের কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ।। ঢাকা ঘুরে আসা টিমের প্রতিবেদন জমা ।। আজ শুরু হচ্ছে ‘মশা জরিপ’

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৮ মার্চ, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

মশক নিধনে গত ১৬ দিন ধরে ‘বিশেষ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এরপরও নগরে কমছে না মশার উৎপাত। বরং কোথাও কোথাও বাড়ার অভিযোগ আছে। ফলে আরো জোরালো হয়েছে চসিকের ব্যবহৃত কীটনাশকের কার্যকারিতার প্রশ্নটি। অবশ্য ঢাকায় কীটনাশক হিসেবে চতুর্থ প্রজন্মের লার্ভিসাইড ‘নোভালোরন’ (দানাদার বা ট্যাবলেট জাতীয়) ব্যবহার করলেও চসিক তা করে না। এছাড়া পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংসের এডাল্টিসাইড ব্যবহারেও আছে পার্থক্য। এ অবস্থায় নগরে আজ সোমবার থেকে যৌথভাবে ‘মশা জরিপ’ শুরু করছে সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়।
ঢাকার সঙ্গে পার্থক্য : চসিকের চলমান কর্মসূচির মধ্যেও নগরে মশার উপদ্রব না কমানোর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে নিয়ম মেনে একই নালায় প্রতি সাতদিন অন্তর অন্তর স্প্রে করা হয়। যা চট্টগ্রামে হয় না। অভিযোগ আছে, চট্টগ্রামে কোনো নালায় একবার কীটনাশক ছিটানো হলে পরবর্তী কয়েক মাস এমনকি বছরও চলে যায় সেখানে দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে। চসিক সূত্রে জানা গেছে, নগরে গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ দিনের ‘বিশেষ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি’ শুরু করে সংস্থাটি। ওইদিন চান্দগাঁওয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। কর্মসূচির আওতায় প্রতিদিন চারটি ওয়ার্ডে পরপর দুইদিন ছিটানো হয়েছে কীটনাশক। এর পর আবার কবে ছিটানো হবে তা এখনো ঠিক হয় নি। অথচ ঢাকা উত্তরে সাতদিন পর পর ছিটানো হচ্ছে একই স্থানে। নগরে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় প্রতি ওয়ার্ডে সাতজন স্প্রে ম্যান কাজ করছে। অথচ ঢাকা উত্তরে এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের একটি ওয়ার্ডে দিনে ২৪ জন পর্যন্ত স্প্রে ম্যান কাজ করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চসিকের একজন পরিচ্ছন্নকর্মী জানান, ফগার মেশিনের সংকট আছে। মেশিনই যদি না থাকে তাহলে স্প্রে কারা করবেন?
কীটনাশকের পার্থক্য : মশক নিধনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে গত ১৭ অক্টোবর থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের লার্ভিসাইড ‘নোভালোরন’। বিশেষ দানাদার কীটনাশকটি চট্টগ্রামে ব্যবহার করে না চসিক। ‘নোভালোরন’ একবার ব্যবহার করলে প্রায় ৯০ দিন পর্যন্ত কার্যকর থাকে বলে বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
কীটনাশকটি ব্যবহারের আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদের তত্ত্বাবধানে এবং ডিএনসিসির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পৃথকভাবে তিন মাসব্যাপী পরীক্ষাও চালানো হয়েছিল। লার্ভা থেকে সৃষ্টি হয় এমন কীট ব্যতীত মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদেহে এ কীটনাশক কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
এছাড়া ঢাকা উত্তরে পূর্ণাঙ্গ মশা মারতে যে ‘এডাল্টিসাইড লিকুইড’ ব্যবহার করে তার সঙ্গেও চট্টগ্রামে ব্যবহৃতের কিছুটা পার্থক্য আছে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামে ব্যবহার করা হয় রেডিমিঙার। অর্থাৎ এডাল্টিসাইডের সবগুলো উপকরণ মিশানো অবস্থায় সংগ্রহ করে চসিক। ঢাকা উত্তর নিজেরাই মিঙার তৈরি করে। অবশ্য দুটো সিটি কর্পোরেশনই একই প্রতিষ্ঠান থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে। দুটো কীটনাশকই চীনের তৈরি।
চসিকে ব্যবহার করা হয় ‘ক্লোরোপাইরিফস এম ফস ২০ ইসি’ লার্ভিসাইড। ঢাকা উত্তরে ব্যবহার করা হয় ‘টেমপস ৫০ ইসি’। যদিও ক্লোরোপাইরিফস ও টেমপসে খুব বেশি পার্থক্য নাই বলে দাবি করেছেন চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মীরা।
এদিকে চট্টগ্রামে নালা-নর্দমায় ‘লাইট ডিজেল অয়েল’ (এলডিও) বা কালো তেল ব্যবহারে জোর দেয়া হচ্ছে। আগে না করলেও ঢাকা উত্তরে সম্প্রতি এর ব্যবহার শুরু হয়েছে।
মশা বাড়াচ্ছে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প : জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র মেগার প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পের আওতায় রিটেইনিং ওয়াল ও কার্লভার্ট নির্মাণে বাধ দেয়া হয়েছে খাল-নালায়। এতে পানি চলাচল করতে পারছে না। জমাটবদ্ধ স্থির পানি হয়ে উঠেছে মশার প্রজনের প্রধান স্থান। সরেজমিন পরিদর্শনে শহরের বিভিন্ন নালা-নর্দমায় কিলবিল করতে দেখা গেছে মশার লার্ভা।
এদিকে মেগাপ্রকল্পের আওতায় শহরের তিন ফুটের অধিক খাল-নালাগুলোর ময়লা-আর্বজনা অপসারণের বিষয়টিও অর্ন্তভুক্ত। ফলে গত কয়েক বছর এসব খাল-নালা পরিষ্কারে জোর দেয়নি চসিক। এতেও সেখানে মশার প্রজনন বেড়েছে কয়েকগুণ। অবশ্য সম্প্রতি পরিষ্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
মুরাদপুর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা টিপু আজাদীকে বলেন, মুরাদপুর বড় নালায় রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে ছয় মাসের বেশি হবে। তারও আগে পাশের বিভিন্ন ভবন উচ্ছেদ করা হয়েছিল। সেগুলো নালায় পড়ে ভরাট হয়ে যায়। রিটেইনিং ওয়ালের কারণেও বাঁধ দেয়া হয়েছে। ফলে পানি যেতে পারছে না। এতে বেড়েছে মশার উৎপাত। সিটি কর্র্পোরেশনও সেখানে ওষুধ ছিটাচ্ছে না।
ঘাটফরহাদবেগ এলাকার বাসিন্দা আজিম উদ্দিন আজাদীকে বলেন, রাতদিন মশার অত্যচারে অতিষ্ঠ। সিটি কর্পোরেশনের কোনো উদ্যোগও সেভাবে চোখে পড়ছে না। তারা নাকি ওষুধ ছিটায়। তাহলে মশা কমে না কেন?
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন : মেয়রের নির্দেশে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন পরিদর্শন করে চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের একটি টিম। তারা ঢাকায় মশক নিধন কার্যক্রমের সঙ্গে চসিকের তুলনামূলক পার্থক্য চিহ্নিত করেন। টিম প্রধান চসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা হাসান রশিদ আজাদীকে বলেন, পরিদর্শন রির্পোট জমা দিয়েছি। আমরা যে লার্ভিসাইড ছিটাই তার সঙ্গে ঢাকার কোনো পার্থক্য নাই। তারা ‘নোভালোরন’ ব্যবহার করে। আমরা কালো তেল ছিটাই। তাদের জনবল আমাদের চেয়ে বেশি। আমাদের কম।
এ বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেন নি চসিকের প্রধান নির্বাহী কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক।
চসিকের অতিরিক্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, নিয়মিত কার্যক্রমের বাইরে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় মশক নিধন কার্যক্রম চলছে। প্রতিদিন চার-পাঁচটি ওয়ার্ডে খাল-নালা পরিষ্কারের পাশাপাশি কীটনাশক ছিটাচ্ছি। ২০ দিনের প্রোগ্রাম শেষ হলে দ্বিতীয় ধাপে আবারো শুরু করেবো। আমাদের চেষ্টার কমতি নাই। কিন্তু বিভিন্ন খালা-নালা মেগাপ্রকল্পের কারণে বন্ধ থাকায় জমাটবদ্ধ পানিতে মশার লার্ভা বাড়ছে।
চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ এনতেজার ফেরদৌস আজাদীকে বলেন, এখন নালা-নর্দমায় জমাট হয়ে থাকা পানিতে কিউলেঙ মশার লার্ভা সৃষ্টি হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন লার্ভা ধ্বংসকারী ওষুধ ছিটাতে পারে। বৃষ্টি শুরু হলে আবার কিউলেঙ মশার উপদ্রব কমে যাবে।
তিনি বলেন, সোমবার (আজ) থেকে সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় যৌথভাবে মশা জরিপ শুরু করবে। এটা স্থানীয়ভাবেই হবে। চার সদস্যের টিম প্রতিদিন একেকটি এলাকায় গিয়ে জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭ই মার্চের ভাষণই প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা