‘মনোকৈতব’ মানবমনের অকপট বয়ান

শান্তনু দাশ | শুক্রবার , ১২ মে, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

ভাষা যদি হয় মনের আয়না, তো কবিতা হতে পারে মননের। মননের যে ধারাপাতে মন ও আবেগের নানান স্তর পার করে তাই হয়ে ওঠে একজন কবির কাছে কবিতার প্রথম শব্দটি বা ছন্দের প্রথম বোলটি। একান্ত নিজস্ব এই অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কবি কেবল কবিতা লিখেই নয়, তা পাঠকের কাছাকাছি নিয়ে এসেও করেন। তেমনই এক বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই কবি শাহনাজ সিঁথির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মনোকৈতব’এ।

বইটির প্রচ্ছদের মানুষ আর পাখিটির মধ্যেকার নীরব কথোপকথনের মতোই পাতা উল্টানোর পর পাঠকের সাথে কবিতার, বা লেখকের, এক নীরব কথোপকথনে পাঠক মন সরব হয়ে উঠবে এমন এক প্রতীকী প্রস্তাবই যেন প্রচ্ছদটি দেয়। প্রচ্ছদটি যতটা ভালো লেগেছে ততটাই ভাবিয়েছে এর শিরোনামটি। মনোকৈতব। ‘কৈতব’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কপটতা বা ছল। সেই সূত্রে মনোকৈতব শব্দটিকে কি মনোঃ+কৈতব ধরে এর অর্থ মনের কপটতা বা ছল বলে মানবো? লেখক কি মনের ছল বলতে মন আর মগজের লুকোচুরিকেই বোঝালেন? পরবর্তীতে লেখককে জিজ্ঞেস করে জানলাম মনোকৈতব এক্ষেত্রে মন+অকৈতব অর্থাৎ মনের অকপটতা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অভিধানে এই শব্দের উল্লেখ নেই; নতুন শব্দগঠন করে শিরোনাম ধার্য করা হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে লেখা, বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের, বিভিন্ন বিষয়ের মোট ৫৯টি কবিতা স্থান পেয়েছে। খুব অবধারিতভাবেই লকডাউন সর্বস্ব ঘরবন্দী সময়কে প্রতিফলন করেছে যেমন কোনো কোনো কবিতা। আবার সেই একই ঘরবন্দী সময়কে ছাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে কোনো কোনো কবিতা গিয়ে পৌঁছেছে অধিকতর মানবীয় কিছু অস্ফুট, স্পর্শাতীত আবেগের দোরগোড়ায়।

বইটির প্রথম কবিতাটি ‘কষ্ট’ লেখকের অত্যন্ত ব্যক্তিগত এক অনুভূতির ধ্বনিতে বাঁধা আখ্যান বলেই পাঠক টের পায় বুঝি। আবার শেষ কবিতা ‘ভালোবাসো মানুষ’এ দেখা যায় ব্যক্তিগত কষ্টকে ডিঙিয়ে বৈশ্বিক এক সমস্যা নিরসনের উদার আহ্বান। কিছুটা ব্যক্তিগত, কিছুটা সার্বজনীন, আবার কিছুটা ব্যক্তিগত থেকে বেরিয়ে সার্বজনীনএই ছকেই বইটির সব কবিতাকে ফেলা যায়। যেমন ‘কষ্ট’, ‘আমার কণ্ঠ’, ‘ব্যক্তিগত’ এগুলো যদি হয় লেখকের একান্তই নিজস্ব অনুভূতি, তবে ‘১৫ আগস্ট, ১৯৭৫’, ‘চেরনোবিল থেকে সীতাকুন্ড’, ‘দেশ’ এই কবিতাগুলোকে স্পষ্টতই সমবেত কণ্ঠের আওয়াজ বলা যায়। আবার একই সাথে খুঁজে পাই ‘হারানো বিজ্ঞপ্তি’এর মতো কবিতা, যেখানে ‘কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না নিজেকে’ বলে লেখক লিখতে শুরু করলেও শেষ স্তবকে এসে পাঠককেও আহ্বান করছেন “আচ্ছা, আপনারা কি জানেন, / কোথায় আপনি? কোনটা আপনি? কেন আপনিই আপনি?/ না জানলে, আসুনএকসাথে একটা ‘হারানো বিজ্ঞপ্তি’ দিই…” এই বলে। ব্যক্তিগত আবেগের অনুরণন গিয়ে কড়া নাড়ে সার্বজনীন এক উত্তরআধুনিক অস্তিত্ববাদী জটিলতার দুয়ারে।

করোনাকালীন একটা লম্বা সময় ধরে কবিতাগুলো লেখা হলেও করোনাই সব কবিতার একমাত্র উপজীব্য নয়। আধুনিক, উত্তরআধুনিক মানবজীবন, নারীজীবন, মানবজীবন থেকে নারীজীবনকে আলাদা করতে চাওয়া বা নাচাওয়া কিংবা করতে না পারা এরকম বিষয়গুলোও কবিতাগুলোতে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে। শাহনাজ সিঁথির যে কয়টি কবিতায় নারীজীবন বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে সেগুলোতে নারীবাদের খানিকটা প্রকাশ রয়েছে এ কথা সত্য, তবে জোরালো, প্রতিবাদী নারীবাদের কবিতা সেগুলোকে বলা যায় না। বরঞ্চ সেই কবিতাগুলোতে রয়েছে একজন আধুনিক নারীর পথ চলতে গিয়ে মুখোমুখি হওয়া কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজবার চেষ্টা, খুঁজে না পেয়ে নিজেকেই ফের প্রশ্ন করা, কিছুটা স্বপ্ন আর প্রত্যয়ের বুনিয়াদ, এবং কিছুটা সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। ‘বৃত্তবন্দী স্বপ্ন’, ‘তবে কেমন?’, ‘একসময় ও অন্য সময়’, ‘তোমাদের জন্য করুণা’, ‘অন্যরকম কন্যা’, ‘একবিংশ শতাব্দীতে নারী চাকুরিজীবী : অতঃপর’ এই কবিতাগুলোতে তাই নারীবাদের যে প্রকাশটি দেখতে পেয়েছি বলে আমি মনে করছি তা অনেকটাই মোলায়েম। যেমন ‘বৃত্তবন্দী স্বপ্ন’ কবিতাটির শেষ স্তবকে তিনি এক দৃঢ় প্রত্যয়ের ডাক দিচ্ছেন কন্যাদের; তিনি লিখছেন-‘বৃত্তে বাঁধা তোমারআমার সময় / জননী, জেনো তার আধাআধি জীবন। / কন্যা, তুমি তৈরি থেকো বুঝে নিতে তোমার যত অধিকার / বৃত্তবন্দী স্বপ্ন আর নয়; হোক তবে, বৃত্ত ব্যাপ্তির প্রত্যয়!’ লেখক এখানে স্বীকার করেই নিচ্ছেন সময় বৃত্তে বাঁধা থাকে; তার মধ্যে থেকেই কন্যারা তাদের যত অধিকার বুঝে নিয়ে বৃত্তের ব্যাপ্তি ঘটাবে, বৃত্তের ভেতর স্বপ্নদেরকে মাথা কুটে মরতে দেবে না। প্রত্যয়ের আহ্বান যথেষ্ট পরিস্কার। কিন্তু বৃত্ত ব্যাপ্তির স্লোগান মনে প্রশ্ন জাগায়গ্লাস সিলিং কি তবে কন্যারাও কখনোই ভাঙবে না? এই ধরনের ছোটখাটো কিংবা পুরুষতন্ত্রের মতে ‘অহেতুক’ প্রশ্নে কবিতার নারীবাদী বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে অবশ্যই। পাঠকের কাছে সেই দুয়ার খোলা রেখেছেন শাহনাজ সিঁথি, এমনটাই মনে হয়েছে। আবার লেখক নারী বলেই যে তাঁর লেখায় তীব্র নারীবাদ গর্জে উঠবে তা দাবি করা যায় কি না, এমন আলোচনার অবকাশও রয়েছে অবশ্যই।

প্রকৃতিও বইটির বেশ কিছু কবিতায় এসেছে। প্রায় লেখকই প্রকৃতির কাছে যায়। প্রকৃতি বিষয়বস্তু হিসেবে কবিতায় আছে সেই শুরু থেকেই। আবার প্রকৃতি প্রতীকের আকর হিসেবেও লেখকের কাছে ধরা দেয়। ‘মনোকৈতব’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোয় প্রকৃতির নানান উপকরণে শাহনাজ সিঁথিও জীবনের গূঢ় অর্থ খুঁজতে চেয়েছেন আমাদের সবার মতো। ‘কৃষ্ণচূড়ার জন্য এলিজি’, ‘গোধূলি সন্তান’ এরকম কয়েকটি কবিতাকে উদাহরণ হিসেবে আনা যায়। পাশাপাশি বৃষ্টিবিলাস নিয়ে কবিতা আছে, আছে সমুদ্রের বিশালতার সামনে মানবজীবনের ক্ষুদ্রতার অনুভূতির কাব্য। আবার বেশ কয়েকটি কবিতায় প্রকৃতিকে লেখক দেখেছেন এবং এঁকেছেন নাগরিক দর্পণে। শাহনাজ সিঁথির কবিতার এই নগর রোদ পেয়ে ঝলমল করে আর চাঁদের আলোয় রাত জেগে নিশিকাব্য লেখে। তেমন কয়েকটি কবিতা হচ্ছে ‘সব গল্প জানতে নেই’, ‘শহুরে নিশি’, ‘চন্দ্রবিলাস’ ইত্যাদি।

কবিতা যেহেতু গভীর অনুভূতির ধ্বনিগত উচ্চারণ সেহেতু ধ্বনিকে পাশ কাটিয়ে বিষয়বৈচিত্র্যে অকৃত্রিমভাবে মুগ্ধ হতে পারি অবশ্যই, কিন্তু নিমজ্জিত হতে পারি না। ‘মনোকৈতব’এর কবিতাগুলো পড়ার সময় এর ধ্বনিগত রূপ আর শব্দচয়নের দিকেও তাই আমার পাঠক মন উঁকি দিয়েছে বারবার। কবিতাগুলোর মধ্যে গদ্যছন্দের ব্যবহার প্রচুর। আধুনিক এবং উত্তরআধুনিক কাব্যচর্চায় এটি বেশ জনপ্রিয় একটি আঙ্গিক হয়ে উঠেছে তা বলাইবাহুল্য। গদ্যছন্দের অসমমাত্রিক পর্ব লেখককে এক ধরনের স্বাধীনতা দেয়। শাহনাজ সিঁথি যে সেই স্বাধীনতার পূর্ণ প্রয়োগ করেছেন তার সবগুলো কবিতার সহজিয়া ধারাটি দেখলেই বোঝা যায়। এছাড়াও শব্দচয়নে রয়েছে একই সাথে বাংলা ও ইংরেজি শব্দের প্রয়োগনিঃসন্দেহে আরও একটি উপকরণ যা কবিতাকে সাধারণ পাঠকের কাছে এনে দিতে পারবে বলে মনে করি।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে পরিচ্ছন্ন একটি আয়োজন। বইয়ের ফ্ল্যাপে সাহিত্যিক মোহীত উল আলমের মন্তব্যের উল্লেখ আছে। সাহিত্যিক মোহীত উল আলমের লেখার গভীরতা এবং অভিজ্ঞতা এই অল্প কথাতেই ঠিকরে পড়ছে। আশা রাখছি সামনে আবার শাহনাজ সিঁথির কবিতা পড়া হবে অন্য কোনো নতুন মলাটের আলিঙ্গনে, অন্য কোনো নতুন শিরোনামের ছায়ায়।

মনোকৈতব, শাহনাজ সিঁথি, কাব্যগ্রন্থ, প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০২৩, প্রকাশক : তৃতীয় চোখ, প্রচ্ছদ : সারাজাত সৌম, মূল্য ১৫০ টাকা।

লেখক : সহকারি অধ্যাপিকা, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধনিরন্তর জীবন