মনে পড়ে, মন পোড়ে

জেসমিন খান স্মরণে

জিনাত আজম | শনিবার , ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:১৩ পূর্বাহ্ণ

আমরা ‘জেসমিন’ নামে কতভাবেই না প্রভাবিত হই। জেসমিন একটি মিষ্টি ফুলের নাম। জেসমিন সুরভি এবং জেসমিন টি! জেসমিনকে ঘিরে আরো কথকতা! আমাদের চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গনে যে জেসমিন পুষ্পটি প্রস্ফুটিত হয়েছিল তার সুরভিতে আমাদেরকে বিমোহিত করেছিলো। হঠাৎ করেই তাঁর বিদায় আমাদেরকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো বিমূঢ় করে তুলে ছিলো উপস্থিত সকলকে। বিশেষ করে সাহিত্য মনস্কদের।

জেসমিন খান নিজ গুণেই তাঁর সাহিত্যের সম্ভারকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাঁকে ঘিরে ছিলো আমাদের মত অনেকেরই মুগ্ধতা। তাঁর রচিত ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা, রবীন্দ্র বিষয়ক রচনাবলীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘আজ মিশালী’র পাতায়। এরপর একদিন হঠাৎ দেখা হলো রোজ গার্ডেন লায়ন্স ক্লাবের এক সভায় ডা. শাহানার বাসায়। নিজেই পরিচয় দিলেন আমি জেসমিন খান কলামিস্ট। সেই প্রথম দেখা ও পরিচয়। অপরূপ এক ভালো লাগা তাঁকে ঘিরে শেষ দিনটি পর্যন্ত অক্ষত ছিলো আমার হৃদয়ে। মাঝে মাঝে কথা হতো। ভালো মন্দের সাথি হয়েছি। অকালে মুনকে হারিয়ে দেখেছি, শুনেছি সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা নিঃশব্দ আর্তনাদ। প্রয়াত মুনের পোশাককে জড়িয়ে ধরে তাঁকে অনুভবের সেই বেদনাবিধুর প্রয়াস!

তাঁর হার্টের সমস্যা ছিলো। থাকতেন সপরিবারে আমেরিকায়। চিকিৎসা চলছিলো। দেশে আসার সময় ডাক্তারের বারণ শুনেননি। বোধ করি মাতৃভূমি তাঁকে বক্ষে ধারণ করার জন্যেই; শেষ শয্যা এখানে রচনার জন্যই এই আসা।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারির এক বিকেল। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে আমরা অনেকেই সমবেত হয়েছি। উপলক্ষ শ্রদ্ধেয় ফাহ্‌মিদা আমিনের স্মরণ সভা। আপা প্রয়াত হয়েছেন মাত্র ২৩ দিন আগে। অনুষ্ঠানের আয়োজকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনু, ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদসহ আরো অনেকেই। ইতোমধ্যে শ্রদ্ধেয় ফেরদৌস আরা আলীম, অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম, কবি মর্জিনা আখতার এসে গেছেন। এসে গেলেন জেসমিন খানও। ঘড়ির কাঁটা তখনো ৪টার ঘরে পৌঁছেনি। আমরা নিজেরাই কথা বলছিলামসব কথা হচ্ছিলো মৃত্যুকে ঘিরেই। ফাহ্‌মিদা আপার তিরোধানে সবাই বেদনার্ত। সেদিন জেসমিনও বলেছিলেন মৃত্যু এমন ভয়ংকর কঠিন সত্যযা আমাদেরকে ইচ্ছে হোক বা না হোক আলিঙ্গন করতেই হবে। কবি বলেছেন, ‘বিধাতা অলখ্যে হাসিলেন।’

ঘটেছিলোও তাই। যমদূত সেদিন যে তাঁর পেছনেই দাঁড়ানো ছিল, তা কে জানতো? যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। উপস্থাপিকা মর্জিনা আখতারের স্বাগত কথার পর প্রথমেই ডাকা হলো জেসমিন খানকে। হালকা মেরুন রঙের সুতির শাড়িতেও তাঁকে খুবই সুন্দর ও ব্যক্তিত্বসম্পন্না দেখাচ্ছিল। ছিলেনও তাই। জেসমিন মঞ্চে উঠলেন। নিজের লেখা বই থেকে মুন এর স্মরণে লেখা কিছু লাইন উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। এর পরেই তাঁর ঢলে পড়া। শুধু উচ্চারিত তাঁর মৃদু কণ্ঠে ‘অক্সিজেন’। মজনু ভাই তাৎক্ষণিক তাঁকে আগলে ধরলেন। ডাক্তার মঈনুল ইসলামের গাড়িতে তাঁকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেবার চেষ্টা চলছিলো। আনোয়ারা আপা তাঁর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মুখে দিলেন। কতটুকু ভেতরে গিয়েছিলো সেই পানি জানিনা।

জেসমিন খানের সাড়হীন দেহ আগলে ফেরদৌস আপা, ডা. মঈনুল ইসলামসহ আরো অনেকেই গেলেন। কেবল আমরা স্তব্ধ হয়ে ফাঁকা মঞ্চের সামনে বসে রইলাম বজ্রাহতের মতোই।

এর পরের কথা ফেরদৌস আপার কাছেই শোনাসেদিন গাড়িতে তাঁর কাঁধে ছিলো জেসমিনের মাথা। তাঁর মুখনিঃসৃত ফেনায় ভেজা আপার পিঠ। আপা অনুরোধ করলেন ডা. মঈনুলকে পালস চেক করার জন্য। তিনি পালস্‌ চেক করেই মাথা নাড়লেন। গাড়ি ঘুরাতে বললেন মেডিকেলের দিকে। বোধকরি সেই সময়েই আমরা মিলনায়তনে বসে তারই ফোনের মাধ্যমে শেষ সংবাদটি পেয়েছিলাম। তাঁর ফোন রিসিভ করার পর মজনু ভাইও হাত নাড়লেন। অর্থাৎ নেই। সে যে কি অবর্ণনীয় মুহূর্ত! বেদনাক্লিষ্ট হৃদয় নিয়ে আমাদের ঘরে ফেরা। ফেরদৌস আপা বলেছিলেন হাসপাতালে স্বামী, কন্যা, জামাতা সবাই হাজির। শুধু নেই জেসমিন। তাঁর স্বামী মোসলেম খানকে মজনু ভাইই শেষ সংবাদটি পৌঁছে দিয়েছিলেন ফোনে।

আমরা গিয়েছিলাম পরদিন সন্ধ্যায় তাঁর শেষ বিদায়ের সময়ে। তাঁর স্বজনেরা উপস্থিত। আমি, ডা. আঞ্জুমান আরা ইসলাম, বেগম সেরিনা তাহের (তাঁর বেয়াইন) আরো ছিলেন কলামিস্ট সাংবাদিক জনাব হাসান আকবরের স্ত্রী। তাঁর পুত্র মাকে না জানিয়ে সারপ্রাইজ দেবার উদ্দেশ্যে সুদূর আমেরিকা থেকে এসে পৌঁছেছে মাত্র। এসেই সে নিজেই সারপ্রাইজড। এমন হতবিহ্বল, শক্‌ড চেহারা! এই অকল্পনীয় দৃশ্যটি আমাদের জন্যও ছিলো চরম বেদনার।

সাহিত্যিক জেসমিন খানের পুরো পরিবারই ছিলো শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা। তাঁর তিরোধানে আমরা শিল্প ও সাহিত্য জগতের উদীয়মান এক নক্ষত্র ও অত্যন্ত আপন জনকেই হারালামযে স্থান পূর্ণ হবার নয়। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর অদ্ভুত মমতাময়ী মা, নিপুণা গৃহকত্রী সর্বোপরি সাহিত্য অঙ্গন হারালো এক উজ্জ্বল প্রতিভাকে। তিনি থাকলে আরো সমৃদ্ধ হতো আমাদের সাহিত্য অঙ্গন। তাঁর শেষ রচিত বই ছিলো মক্কামদিনার পবিত্র হজ্ব পালনের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে।

মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন পূর্বে তাঁর ফোন পাই। রাশেদ রউফের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে তাঁকে ঘিরেই চট্টগ্রাম ক্লাবে আয়োজন করেছিলো এক মধ্যাহ্ন ভোজ অনুষ্ঠানের। আমার কিছু অনিবার্য কারণ থাকায় উপস্থিতির বিষয়ে অক্ষমতা প্রকাশ করেছিলাম। এরপরেই দেখা হয় প্রেস ক্লাবের সেই তমসা ঘেরা বিকেলে।

আজ মনে হয় সেদিন কেন গেলাম না! গেলে হয়তো তাঁকে আরো দেখা হতো; কিছু কথা হতো। তাঁর সেই শেষ সম্ভাষণ আজো আমাকে পীড়া দেয়আপা আসবেন না? সাধ জাগে মনে, সব ছেড়ে ছুটে যাই এই প্রিয়জনের কাছেই। কিন্তু তাতো আর হবার নয়।

জেসমিনের সেই চমৎকার ব্যক্তিত্ব, আলাপচারিতা, অন্তরঙ্গতা এবং ‘জেসমিন’এর সুরভির মধ্যেই জেসমিন বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন। আমরা সুরভিত হবো বারংবার তাঁর লিখিত রচনা সম্ভারে। আজ প্রার্থনা করি, যেখানেই থাকো হে প্রিয়জন; অনেক সুখে ও শান্তিতে থাকো। তোমাকে বড্ড মনে পড়ে, মনও পোড়ে।

লেখক : রম্য সাহিত্যিক; সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপরিবার থেকেই বাংলা ভাষার সঠিক চর্চা শুরু হোক
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে