ভ্যারিয়েন্ট

আবু মোশাররফ রাসেল | শুক্রবার , ২১ মে, ২০২১ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

এবার সে কিছুতেই ছাড় দেবে না, শপিংয়ে যাবেই যাবে। ছাড় না দেওয়ারই কথা, গতবারও ঈদের সময় তাকে করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে আমি শপিংয়ে যেতে দিইনি। তাকে শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিলাম, এবার কেউ শপিংয়ে যাচ্ছে না, বেঁচে থাকলে জীবনে ঈদ অনেকবার আসবে, শপিংও করা যাবে। কিন্তু কোনো কারণে যদি শপিং করতে গিয়ে করোনা সংক্রমিত হয়ে যাও তাহলে তো বাঁচা-মরার প্রশ্ন। শারমিন, আমার স্ত্রী পাল্টা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করে। স্বর বাড়িয়ে-রাগ দেখানোর ভঙ্গি করে বলে-করোনার দোহাই দিয়ে দিয়ে তুমি আসলে টাকা বাঁচানোরই ফন্দি করছ। ভেতরে-ভেতরে সবাই কিন্তু শপিং করছে। এমনকি বাড়ির অন্য বউয়েরাও কেউ বাকি নেই। আমি তখন তাকে গ্যারান্টি দিয়ে বললাম, তোমার ধারণা ভুল, কেউই শপিংয়ে যাচ্ছে না। একটু কৌতুকও করলাম, যেসব স্বামী এই করোনার মধ্যে স্ত্রীদের শপিংয়ে পাঠাচ্ছে, বুঝতে হবে তাদের ভালোবাসায় গুরুতর সমস্যা। তারা হয়তো তাদের স্ত্রীদের ভালোবাসে না, ‘আপদ বিদায় করতে’ না পেরে কৌশলে করোনার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। করোনায় বউ মরুক, আবার বিয়ে সারবে!’ নাহ, বেশিদিন যেতে হয়নি, সেই ঈদের দিনই আমি ভুল প্রমাণিত হলাম। শারমিন হাতেনাতে দেখিয়ে দিল-সবাই নতুন কাপড় কিনেছে, শুধু আমরা ছাড়া। আমিও বেশ অবাক, এই পরিস্থিতির মধ্যে সবাই নতুন কাপড় কিনলো কি করে? বাঙালির প্রশংসা না করে পারা যায় না, গেরিলা স্টাইলে সব সেরে ফেলতে পারে।
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, এরই মধ্যে কয়েকশ’বার নিজেকে বদলে নিয়েছে করোনাভাইরাস, সে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। দেশে গত বছরের শনাক্ত আর দৈনিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান আর এ বছরের পরিসংখ্যান দিয়ে তাকে বললাম-নাহ, এ বছরও কিছুতেই শপিংয়ে যাওয়া যাবে না, করোনা ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট বদলে আরও শক্তি সঞ্চয় করেছে, এখন আক্রান্ত হলেই আইসিইউ লাগছে, অঙিজেন দিতে হচ্ছে। অথচ দেশে হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকট, অঙিজেন মিলছে না। এ অবস্থায় নিজেকে গত বছরের চেয়েও সংযত রাখতে হবে। বেঁচে থাকলে, জীবনে অনেক ঈদ করা যাবে। ‘ভ্যারিয়েন্ট’ শব্দটি শুনে শারমিন রাগ দেখায়। এবার নতুন কথা শুরু করেছো তো? ভ্যারিয়েন্ট আবার কী? আমি ভ্যারিয়েন্টের সংজ্ঞা তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি। সে পাল্টা যুক্তি দেয়, গত বছর করোনার দোহাই দিয়ে শপিং করতে দাওনি, অথচ দেখা গেল সবাই ঠিকই নতুন কাপড় নিয়ে ঈদ করেছে। এবারও একই কথা বলছো। আচ্ছা, তুমি আমাকে আশপাশের-চেনাজানার মধ্যে মাত্র একটা মেয়ে দেখাও তো যে শপিংয়ে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে। করোনায় বেশিরভাগই পুরুষরা মারা যাচ্ছে। কারণ কী জানো? আমি বললাম নাহ, জানি না। শারমিন বললো, ‘এর কারণ আমার মতে দুটি। এক. পুরুষদের এন্টিবডি দুর্বল, মেয়েদের যেহেতু মা হওয়ার একটা ব্যাপার আছে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের ধারাবাহিকতা রক্ষার মূল দায়িত্বটি তাদের কাঁধে, তাই আল্লাহতায়ালা হয়তো তাদের শরীরে বিশেষ এন্টিবডি দিয়েছেন, এই এন্টিবডির দেয়াল করোনা ভাইরাস হয়তো সহজে মাড়াতে পারে না। দুই. বেশিরভাগ মেয়েই দেখবে মুখ ঢেকে রাখে, বাইরে গেলেই নেকাব পরাটা তাদের কাছে প্রায়ই স্বাভাবিক। কিন্তু পুরুষদের তো মুখ ঢেকে রাখার অভ্যাস নেই, মাস্কটিই তারা সঠিকভাবে পরে না।’ কথায় যুক্তি আছে, শারমিনের যুক্তিতেও দেখছি নতুন ভ্যারিয়েন্ট। মনে মনে ভাবছি, ভ্যারিয়েন্ট কি শুধু করোনা ভাইরাসের হয়েছে?
‘তোমার কথারও ভ্যারিয়েন্ট হয়েছে দেখছি শারমিন।’ এ কথা শুনে হেসে উঠে গিন্নি বলে, ভ্যারিয়েন্ট ভ্যারিয়েন্ট জিকির করা বাদ দাও।
দেওয়াল ঘেরা উপার্জনের ওপর আহ্লাদের শপিং বড় এক বোঝা। কিন্তু গিন্নির যুক্তিতে যেহেতু নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করতে পারলাম, সুতরাং পুরোনো কথায় আর তাকে ঠেকানো যাবে না। আমার যুক্তিতেও ভ্যারিয়েন্ট আনতে হবে। তবে আমার সমস্যা অন্যখানে। ভ্যারিয়েন্ট মানে হলো-নিজেকে বদলে নেওয়া কিন্তু আমি নিজেকে বদলাতে জানি না। সে অর্থে নিজেকে বদলে নেওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি বলেই প্রায়ই এক যুগ ধরে এলাকার ‘চেয়ারম্যানগিরি’ করেও গিন্নির শপিংয়ে যাওয়া আটকাতে হয়, মূলত টাকা বাঁচাতেই। সংসারের বিবাদ শুধু গিন্নির সাথে হচ্ছে তা নয়, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থাকলে চারপাশের সবার সাথেই হয়। ছেলেটাও আজকাল তার কোনো বায়না আদায়ে ব্যর্থ হলে নানাজনের উদাহরণ দিয়ে বলে দেয়, ‘এত সরলতা দিয়ে দুনিয়া চলে না বাবা, এখন।’ আমি হাসতে হাসতে বলি, সরলতার ব্যাপারটি জন্মগত এবং পারিবারিক। যে সরলতা সম্বল করে জীবন শুরু করেছে, মাঝখানে এসে সে আর বদলাতে পারে না।’
যাহোক, গিন্নিকে নতুন ভ্যারিয়েন্টের কি যুক্তি দেওয়া যায় তা নিয়ে ভাবছিলাম-ওর মন খারাপ হতে দেওয়া যাবে না। সংসারের শান্তি বজায় রাখতে হলে আর যাই হোক ওদের ক্ষ্যাপানো যাবে না। সোফায় হেলান দিয়ে, চোখ বন্ধ করে একটু ঝিমুনি ভাব। এ সময় বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠল। ডোর হোল দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাইরে ওসি সাহেব দাঁড়িয়ে। ওসি হানিফ প্রায়ই আসেন, এলাকার এর-ওর খবরা খবর নিতে, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে।
ওসি সাহেবকে কেমন জানি বিমর্ষ মনে হচ্ছে, তবে সেটা নিশ্চিত হতে পারছি না। তিনি মাস্ক পরে আছেন। করোনা ভাইরাস আসার পর এই এক মুশকিল। মাস্ক পরা থাকলে কথাবার্তায় ঠিক কি বুঝাতে চাইছেন তা অনুমান করা কঠিন। কথা বলার সময় মানুষের মনের ভাষাটি মুখভঙ্গিতে ফুটে উঠে, শুধু চোখ আর কপাল দেখে মনোভাব বুঝা যায় না। আল্লাহর সৃষ্টিতে খুঁত নেই, ঠোঁটের উঠানামার সাথে মুখের নড়াচড়া আর নাক-চোখে সমন্বয় মিলিয়েই ফুটে উঠে ভেতরের ভাষা। মাস্কে নাক-মুখ ঢাকা থাকলে তা সম্ভব হয় না। এ কারণে করোনা আসার পর মানুষের মনের ভাষা পড়া কঠিন হয়ে গেছে।
‘মানুষ আজকাল কেমন যেন জানোয়ার হয়ে গেছে’-সোফায় বসতে বসতে ওসি সাহেবের খেদোক্তি। কী হলো জানতে চাইলাম। ওসি হানিফ ব্যথিত মনে বলছেন, লালব্রিজ এলাকা থেকে এক নববধূর লাশ উদ্ধার করলাম সকালে। কত তুচ্ছ কারণে মেয়েটাকে মেরে ফেলল তারা। চার-পাঁচ বছর প্রেম করে বিয়ে, বিয়ের মাত্র তিন মাসের মাথায় খুন, মেয়েটার হাতের মেহেদির রঙ এখনও মুছে যায়নি! কী কারণ আমি জানতে চাইলাম। ওসি জানালেন, তাদের বিয়ের দিনে অতিথিদের খাবার কম পড়েছিল, ছেলেটার অভিযোগ ওর অনেক বন্ধুবান্ধব খেতে পারেনি। মেয়েটি তখন বলেছিল, যারা খেতে পারেনি তাদের পরে একদিন ওর বাপের বাড়িতে নিয়ে আয়োজন করে খাওয়াবে। বিয়ের তিন মাস যাচ্ছে সেই আয়োজন হচ্ছে না কেন এ নিয়ে চাপাচাপি…মেয়েটি হয়তো অপারগতা প্রকাশ করেছিল, ব্যাস এটুকুই! কত বড় জানোয়ার। অথচ প্রেম করেছে চার-পাঁচ বছর, এত তুচ্ছ ব্যাপারে তাকে ওই জানোয়ার পিটিয়ে মেরেছে। জানোয়ারটা পালিয়ে গেছে, আমরা ধরার চেষ্টা করছি। মানুষের বিবেকের যে আজকাল কী হলো?
আমি তখন আমার এলাকার একটা ঘটনা বলি ওসি সাহেবকে। বাবাকে পিটিয়েছে ছেলে। ভাই, কী অদ্ভুত অন্ধকার সময়ে চলে আসলাম আমরা? সন্তান এখন জন্মদাতা বাবা-মায়ের গায়ে হাত তুলছে, যেটা কল্পনার বাইরে থাকার কথা। এই করোনায় দেখেননি, সংক্রমণের ভয়ে বাবা-মা’র লাশ রাস্তায় ফেলে গেছে! আহা, বিবেকের কী পরিণতি, কী ভয়াবহ অধঃপতন এই সমাজের। গা শিউরে উঠে।
বিদায় নিতে নিতে ওসি হানিফ মনে করিয়ে দিচ্ছেন-সাবধানে থাকবেন চেয়ারম্যান সাহেব, দেশে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে জানেন তো? আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, আক্রান্ত হলেই অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
আমি হেসে উঠে বিদায়ী রসিকতা করি-ওসি সাহেব ইদানীং বাজার থেকে তরমুজ কিনেছেন? সেই চিরাচরিত সবুজ রঙের তরমুজগুলো আর মিলছে না, এবার কেমন ‘ডোরাকাটা’ তরমুজ দেখলাম আর সেগুলো নাকি বিক্রেতারা কেজিদরে বিক্রি করছে! কৃষকের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকায় পুরো কিনে এনে, কেজি পঞ্চাশ টাকা হিসেবে বিক্রি, কী বিবেকহীন কাজ। বাজারে এখন নানা ভ্যারিয়েন্টের ফল-ফলাদি, খাবার দাবার মিলছে অথচ নিরাপদ খাবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। খাদ্যই হয়ে উঠেছে খাদক! ভ্যারিয়েন্ট কি একা করোনা ভাইরাসের হয়েছে? করোনার চেয়েও বেশি ভ্যারিয়েন্ট হয়েছে মানুষের বিবেকের! সেটাই এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনা কাহিনি
পরবর্তী নিবন্ধনজরুল কাব্যে ঈদ ভাবনা ও তাঁর সাম্যবাদ