ভোরের পাখি

সাফায়াত খান | শুক্রবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:৪১ পূর্বাহ্ণ

মোতাব্বির দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে জেগে ওঠে। পুরো ঘর অন্ধকার। জানালার পর্দার ছেঁড়া অংশ দিয়ে একবিন্দু আলো দেখে ও বুঝতে পারে কিছুক্ষণ পর সকাল হবে। দু-একটা কাক দূরে কোথাও ডাকছে। স্বপ্ন ঘুমটাকে মাটি করে দিয়েছে। আর ঘুম আসবেনা। বন্ধের দিনটা মনে হয় আজ ভালো যাবেনা। ওঠা যাক। শুয়েই হাতের নাগালের সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই ও চমকে ওঠে। দরজা খোলা, উঠোনে মানুষের হাক ডাক শোনা যাচ্ছে। কি ব্যাপার! এই সাত সকালে এত মানুষ এলো কোত্থেকে? মশারীর ভেতরে বসেই ও কান পাতে। কারা কথা বলছে? কন্ঠস্বরগুলো চেনা চেনা আবার অচেনা লাগছে। কেমন যেন অদ্ভুত কথা বলার ঢং। চৌকি থেকে নেমে ও উঠোনে দৃষ্টি ফেরায়। একটা লাশ বহনের খাট এবং পাশে একটা ভেজা তক্তা পড়ে আছে।
টুপি মাথায় সাদা কালো দাড়িওয়ালা একটা লোক বলছে লাশের গোসল করানো হয়েছে।
গেট দিয়ে আরেকজন লোক ভিতরে ঢুকে বয়স্ক লোকটাকে বললো। হুজুর ইমাম সাহেব ঘন্টা খানেক পরে আসবেন। মক্তবে উনি বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন। খাটিয়ার একপাশে কতগুলো লোক বসে কোরান শরীফ পড়ছে।
মোতাব্বিরসহ আরো ছয় জন এই বাড়িতে ভাড়া থাকে। একটা রুমে মোতাব্বির একাই থাকে পাশাপাশি আরো দুটি রুমের একটিতে দুইজন অন্যটিতে তিনজন থাকে। বাড়ীর ভেতরে বেশ বড় একটা উঠোন অনেক গাছপালা চারপাশে। নিরাপদ এবং বেশ ভালো পরিবেশেই এরা সবাই বাস করছে। ছোট খাট ব্যাবসায়ী এবং চাকুরীজীবী লোকগুলো অনেকদিন ধরে এখানে থাকাতে ওদের সম্পর্কটাও বেশ আন্তরিক। আজ সবাই বেশ দুঃখ ভারাক্রান্ত। দীর্ঘদিন যে মানুষটাকে তারা বন্ধু স্বজন হিসাবে পেয়েছিল তিনি আজ ঘুমের মধ্যে হার্ট এটাকে মারা গেছেন। তারা আজ কেউ অফিসে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে প্রিয় মানুষ মোতাব্বির ভাইয়ের দাফনে ব্যস্ত।
কোরান শরীফ পড়ার সময় সিরাজউদ্দিন খেয়াল করে মোতাব্বিরের চোখের পাতা দুটি খোলা। তিনি একজন হুজুরকে ডেকে বলেন – হুজুর মোতাব্বির ভাইয়ের চোখের পাতা দুইটা বন্ধ করে দেন। তার গলার স্বরে এতই বিনয় যেন মোতাব্বির কষ্ট পাবে। মোতাব্বির নাম শুনেই মোতাব্বির অবাক হয়ে লাশটাকে খুঁজতে থাকে একবার খাটিয়ার ভেতরে আর একবার তক্তার উপরে। সম্ভবত ঐ তক্তার উপরেই লাশকে গোসল করানো হয়েছে তাই তক্তাটি এখনো ভেজা। কিন্তু কোথাও মুর্দাকে দেখা যাচ্ছেনা।
মধ্য বয়স্ক হুজুর লোকটা সিরাজউদ্দিনের কথা শুনে খাটিয়ার কাছে আসে। তারপর দুই হাত দিয়ে কাফনের গিট খোলে এবং আলতো করে চোখের পাতা দুটো বন্ধ করে দেয়। মোতাব্বির স্পষ্ট দেখতে পায় সেখানে কোন কিছুই নাই অথচ লোকটির ভাবভঙ্গি বাস্তবের মতই মনে হচ্ছিল।
ভোরের মৃদু আলোয় গাছগাছালির ছায়া সুর করে কোরান পাঠ সব মিলিয়ে পরিবেশটা ভীতিকর মনে হচ্ছে মোতাব্বিরের কাছে। মোতাব্বির এসব কি দেখছে কেন দেখছে কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। সত্যিই কি সে মৃত? সে কি দৃশ্যমান নয় কেউ কি তাকে দেখতে পাচ্ছেনা? দরজার সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষ অথচ কারো দৃষ্টি সেদিকে নেই।
মোতাব্বিরের কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছেনা। কেউ একবারের জন্যও ওর দিকে ফিরে তাকাচ্ছেনা। কোরান পাঠ বন্ধ করে বয়স্ক হুজুর লোকটা স্বরূপ দা্থর কাছে জানতে চাইলো – ভাইসাব মোতাব্বির সাহেব কেমুন মানুষ আছিলেন। স্বরূপ দা বেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন বড়ই ভালো মানুষ ছিলেন ভাই।
সব ভাড়াটিয়ার সাথে আশে পাশের দোকানদার, মসজিদের হুজুর এবং বেশ কজন অচেনা লোককেও দেখা যাচ্ছে। মোতাব্বির দূর থেকে এতক্ষণ খেয়াল করছিল স্বরূপ দাকে। উনি কি করে খবর পেলেন? সেতো অফিসের কলিগ! যদি গভীর রাতে মারা গিয়ে থাকে তাহলেতো জানার কথা নয়। প্রতিবেশীরাও তাকে চেনেনা। আতর লোবানের গন্ধ ভালো লাগছেনা সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। স্বরূপ দার সাথে মাত্র তিনদিন আগে ঝগড়া হয়েছে। তার কাছ থেকে নেয়া টাকা শোধ না করাতে। অথচ স্বরূপ দা বলছে উল্টো কথা। মোতাব্বির নাকি বড়ই ভালো মানুষ ছিল। বাসার সামনের বড় মুদির দোকানদার তিনিও বেশ ব্যস্ত। তিনি নিজ খরচেই লাশ গোরস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য মরচুয়ারি এম্বুলেন্স ভ্যান নিয়ে এসেছে। অথচ তার মেয়েকে টাকা নিয়ে নিজের অফিসে চাকরি দেবে বলেও দিতে পারেনি মোতাব্বির। তিনিও জানাজায় শরীক হতে আসা লোকদের অবলীলায় প্রশংসা করে যাচ্ছেন।
মোতাব্বিরের মাথাটা ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে, বুকও ধরফর করছে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কি করবে এখন কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা। ঘুম পাচ্ছে অথচ ঘুম আসছেনা। কতক্ষণ হয়েছে কে জানে বাইরে কোন সাড়া শব্দ নেই। জোর হাওয়া বইছে গাছগাছালি ভীষণ দুলছে। টিনের চালে ডাল পালার দুলনি শব্দ করছে।নাহ্‌ এভাবে মরার কোন মানে হয়না। অপরাধ বোধ ওকে কুরেকুরে খাচ্ছে। যে ভাবেই হোক মরার আগে ওয়াদা রক্ষা করে যাবে। ওর বয়স তো মরার মত হয়নি।চবড়ই ভালো মানুষ ছিলচ কথাটা বারবার ইকো হচ্ছে।
দরজা খুলে বেরিয়ে আসে মোতাব্বির। উঠোনে কেউ নেই। সুনসান নীরবতা চারিদিকে। সৎ মানুষ, বড় ভালো মানুষ হয়ে ও এখানে আবার ফিরবে। আশাহত মানুষগুলো কি ওকে অভিশাপ দিচ্ছে মনে মনে। ওদের বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে মোতাব্বির। যে করেই হোক ফিরিয়ে দিয়ে পাপ মোচন করবে ও। যত দিনই লাগুক। আশাহত মেয়েটার মুখটা ভাসছে কেমন অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মোতাব্বির খোলা গেট দিয়ে বেরিয়ে আসে আজ শরীরটাকে খুবই ভারী মনে হচ্ছে। কেন এত ভারী মনে হচ্ছে? সত্যিই কি এত দিনের পাপ অন্যায় জমতে জমতে সাড়ে তিন হাতের দেহটা আর ভার বইতে পারছে না। হাতে বোধ হয় আর দীর্ঘ সময় নেই এই পাপ মোচনের। মানুষের জীবনের আয়ুষ্কাল আর কত? সত্যই কি সে পারবে ধীরে ধীরে জমতে থাকা জঞ্জাল সাফ করে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে? মুহূর্তেই শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। শরীরের ভার অনেকটা কম মনে হচ্ছে বিদায়ী ভোর দূর হচ্ছে দিগন্তে হেলে পড়া সূর্যটা ধীরে ধীরে রং বদলাচ্ছে, মিষ্টি হাওয়া বইতে শুরু করেছে। মোতাব্বিরও কেমন বদলে যাচ্ছে শরীরটাও হাল্কা হচ্ছে ক্রমশ। নিজেকে পাখির মত মনে হচ্ছে। পলকা হাওয়া শরীরটাকে আচমকা পাখির মত হাওয়ায় উড়িয়ে নিল। ধীরে ধীরে উপরে উঠছেও। নীচে তাকিয়ে দেখে ওর বাসাটা ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছে আড়াল হচ্ছে গাছগাছালিতে ঢাকা অরণ্যে। অনেক ওপরে শ্বেত শুভ্র সূর্য উজ্জ্বল আলোর বন্যায় ওকে স্বাগত জানাচ্ছে। সে আলোয় ধীরে ধীরে পবিত্র মানুষ হয়ে উঠবে একদিন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহুঁকো
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাচীন চট্টগ্রামে আদিম মানুষের পদধূলি