হুঁকো

সত্যব্রত বড়ুয়া | শুক্রবার , ৪ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

এক সময় আমার এক ‘হুকো’ প্রিয় ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় ঘটেছিলো। বাড়ি কুমিল্লা। আমি ছিলাম সিগারেট প্রিয় মানুষ। ভদ্রলোক সিগারেট টানতেন না। আমি টানতাম না হুঁকো। দু’জনে দু’জনের টানা অবাক হয়ে দেখতাম। ভদ্রলোকের কাছে আমি সব সময় সিগারেটের গুণকীর্তন করতাম। তিনি করতেন হুঁকোর। কিন্তু আমি হুঁকো টানা জানি না। হুঁকো টানা সহজ কাজ নয়। এটা টানার কায়দা-কৌশল রয়েছে। উপলব্ধি করলাম হুঁকো টানা রীতিমত একটা আর্ট। আর্ট রয়েছে নারকেলের খোল দিয়ে তৈরি হুঁকোতেও। হুঁকো ধরার কায়দা রয়েছে। কায়দা না জানলে বেকায়দায় পড়তে হয়। প্রথম প্রথম আমিও পড়ে যেতাম। টানতে গিয়ে হুঁকোর জল মুখ দিয়ে ঢুকে যেতো। যখন হুঁকো টানা শিখলাম তখন মনে হলো আমি বিশ্বজয় করেছি। চোখ বুজে বুজে মনের সুখে হুঁকো টানতাম। সে এক পরম সুখকর অনুভূতি। এ অনুভূতি ব্যাখ্যা করা যায় না। আমি সিগারেট টানা ছেড়ে দিলাম। হুঁকো ছাড়া জীবনটাকে মূল্যহীন মনে হতো। ভদ্রলোকের বাসায় আরো কয়েকজন হুঁকো টানার জন্যে আসতেন। জমে উঠলো আমাদের হুঁকো আড্ডা। ভদ্রলোকের নাম সাধন পাল। আমাদের সবার তিনি ছিলেন সাধনদা। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো সাধনা পাল। সাধন-সাধনা একেবারে কাছাকাছি নাম। এ ধরনের সমিল নাম সাধারণত হয় না। সাধনদার স্ত্রীর চেহারার মধ্যে এমনিতেই একটা বৌদি বৌদি ভাব ছিলো। তিনি হয়ে গেলেন আমাদের সবার বৌদি। সাধনদা-সাধনা বৌদি ছিলেন নিঃসন্তান। আমাদের হুঁকো আড্ডায় বৌদিও যোগ দিতেন। অদ্ভুত ব্যাপার তিনিও হুঁকো টানতেন। আমি এর আগে কোনো দিন হুঁকো টানা মহিলা দেখিনি। বৌদি কল্কে সাজিয়ে আনতেন। হাত বদল করে করে আমরা ‘সিরিয়ালি’ হুঁকো টানতাম। গুড় গুড় আওয়াজ হতো। ধুঁয়োর সাথে তামাকের গন্ধ মিশে থাকতো। এ গন্ধে আমরা আমোদিত হতাম। আমাদের আড্ডার কোনো নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ছিলো না। আমরা ‘ফ্রিস্টাইলে’ বকবক করতাম। আমাদের বকবকানিতে আলাপ, প্রলাপ, বিলাপ সব কিছুই থাকতো। বুঝতাম সবাই আমরা গুল মারছি। কিন্তু আমরা যখন গুল মারতাম তখন মনে হতো আমাদের মতো সত্যবাদী মানুষ আর হয় না। আমি একবার বললাম ভিন গ্রহের বাসিন্দারা প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতে আসে। আমার আমন্ত্রণে আজকে এই হুঁকো আড্ডায় একজন এসেছেন। আপনারা তাঁকে দেখতে না পারলেও আমি দেখছি। তিনি বসে বসে হুঁকো টানছেন। সবাই আমার কথা বিশ্বাস করলো। আরেক আড্ডারু বললেন তিনি নাকি যুক্তরাজ্যে হুঁকো রপ্তানি করছেন। আমরা সবাই বললাম এতো খুব খুশির সংবাদ। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। বাড়বে প্রবৃদ্ধি। বৌদি একদিন হুঁকো টানতে টানতে বললেন তোমাদের দাদা বাসর রাতে আমাকে বললো, তুমি ‘হারানো সুর’ ফ্লিমের সুচিত্রা সেনের মতো বসে থাকো। আমি থাকি উত্তম কুমারের মতো। আমি লজ্জায় জবুথবু হয়ে বসে রইলাম। তোমাদের প্রিয় দাদা সারা রাত আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে বসে থাকলো। তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানি না ও এখনো আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। এই হা হয়ে থাকবার জন্যেই এখনো আমাদের কোনো সন্তান হলো না। সাধনদা হুঁকোতে একটা লম্বা টান মেরে বললেন, তোমাদের বৌদি শুধু একটু হ্যাঁ বললেই আমাদের সন্তান হয়ে যেতো। আমি এখনো একটু হ্যাঁ শোনার অপেক্ষায় হা করে তোমাদের বৌদির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমরা সবাই হা হা করে হেসে উঠলাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচিঠি হয়ে যাই
পরবর্তী নিবন্ধভোরের পাখি