ভূগোলের গোল

ডা. কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:২৬ পূর্বাহ্ণ

হিজ মাস্টারস ভয়েস কলের গানের কুকুর
বর্তমান পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি আমরা ষাটোর্ধ্ব মানুষদের জন্য একটা অকল্পনীয় ব্যাপার। ইউটিউব জীবনকে যেন বিন্দু থেকে সিন্ধুতে পরিণত করেছে। হেন বিষয় নেই যা এক আঙুলের টিপে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু টেকনোলজির এই উন্নতি একদিনে হয়নি। সেই শ-দেড়শ বছর আগে মানুষের বিনোদন জগতই বা কেমন ছিল? রাজা বাদশা জমিদাররা হয়ত নিজ অঙ্গনে গান বাদ্য শুনতেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ গান বাদ্য কিভাবে শোনত? মানুষের শব্দ কিভাবে ধরে রাখা যায় তার থেকে উদ্ভাবিত হয় ফোনোগ্রাফ। ফোনোগ্রাফ থেকে উদ্ভাবিত হয় গ্রামোফোন। তার পরের স্তর ক্যাসেট, ডিস্ক আর এখন মোবাইল বা অন্য কোন পিসি। যন্ত্রের মাধ্যমে গান ধারণ, শোনা হয়। মিনিটেই রেকর্ডও অন্যত্র প্রেরণ হচ্ছে। আধুনিকায়নের ইতিহাস চমকপ্রদ। ষাটের দশক পর্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে বিয়ে, স্কুল কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গ্রামোফোনের রেকর্ড বাজানো হত। পঞ্চাশের দশকে অবধারিত গান ছিল মালকা মানুর বিয়েতে ও হিন্দি পুরানো ছবির গান-বাবু এক পয়সা দেদে, মন দোলে ইত্যাদি। সারাদিন রাত লাউড স্পিকার বা মাইকে বাজানো হত। মানুষ বিনা পয়সায় কিছু বিনোদন পেত।
আমার পরিবারে একটা গ্রামোফোন ছিল ১৯৬০ পর্যন্ত। আমার প্রয়াত পিতা যখন ৪র্থ শ্রেণি থেকে উচ্চ বিদ্যালয় ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি হয় (১৯৩৬ সাল-তখন বোধ হয় হাই স্কুল ৫ম ক্লাস থেকে শুরু হত) তখন এই গ্রামোফোন কেনেন বার্মা থেকে প্রবাসী দাদা। কারণ গ্রামের এক মুরব্বী দাদাকে পরামর্শ দেয় যে, ছেলে এখন হাই স্কুলে গেছে গান টান শুনলে মন ভাল থাকবে, পড়াশোনা মন দিয়ে করবে। সেই থেকে আমাদের ঘরে এই গ্রামোফোন গান শোনা হত। অনেকে বিয়েতে, মেহেদিতে অথবা ছেলেদের খৎনা বা মেয়ের কান ছেদানী (ছিদ্র করা) ইত্যাদি অনুষ্ঠান গান শুনতে গ্রামে ফোন নিত। গ্রামোফোনের রেকর্ডে লেখা থাকত ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ – একটা ফনোগ্রামের সামনে একটা কুকুর যুৎ করে বসে গান শুনছে। এই মনোগ্রাম বা লোগো সারা বিশ্বের গানের রেকর্ডে থাকত। এটা কেন ছিল তা বোঝার ও জানার বয়সও আমার ছিল না। আবার যাদের বয়স বেশি তারা রেকর্ড থেকে শুধু গানই শোনত। কুকুরের লোগো কেন তা জানার প্রয়োজন বোধ করার দরকারই হয়নি। ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ গান রেকর্ড কোম্পানিটা প্রথমে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে তারা বিলাতে স্থানান্তর করে। গানের রেকর্ড বিক্রির প্রথম দোকান খোলা হয় লন্ডনের অঙফোর্ড স্ট্রিটে।
তখনো এই রেকর্ডগুলোতে কুকুর আর ফনোগ্রামের লোগো ছিল। কিন্তু হিজ মাস্টারস ভয়েস ইন্ডিয়ার ইতিহাস ও কুকুরের লোগোর কাহিনী ভিন্ন। ব্রিটেনে নেপিয়ান নামে একটি কুকুরের সাথে এই লোগোর কাহিনী আছে। মালিক ভিন্ন হলেও দুই কুকুরের কাহিনী আলাদা।
ভারতের মধ্য প্রদেশে আবদুল করিম খান নামক এক অসাধারণ গায়ক ছিলেন। তার জন্ম উত্তর প্রদেশের শাহিরানপুরে। তিনি যখন গান গাইতেন তখন তার পালিত কুকুর দৌড়ে বাহির থেকে ঘরে এসে গান শুনত। আবদুল করিম খানের একটি গান ‘পিয়া বিন চাহি নেহি’ শুনে কুকুরের চোখে পানি গড়িয়ে পড়ত। এই কুকুরের কাহিনী দূর-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। হিজ মাস্টারস ভয়েস ইন্ডিয়ার গ্রামোফোন কোম্পানির কর্মকর্তা ওস্তাদ আবদুল করিমের গান রেকর্ড করে যখন ফনোগ্রামে বাজানো শুরু করে তখন এই কুকুরটা দৌড়ে ফনোগ্রামের আওয়াজ বের হওয়া চোঙার মুখে বসে গান শুনতে থাকে। গ্রামোফোন কোম্পানির ফটোগ্রাফার ঠিক ঐ মুহূর্তের ছবিটা ক্যামেরা বন্দি করে। তারা এই ছবিটাকে “লোগো” করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।
ভারতীয় গ্রামোফোন কোম্পানির ইতিহাসও চমকপ্রদ। আমেরিকান গায়ক ফ্রেডরিক গেইসবার্গকে রেকর্ড করার কাজের জন্য বিলাতের গ্রামোফোন কোম্পানি লন্ডনে নিয়ে আসে। রেকর্ড করতে ৮টি টেকনিক প্রয়োজন যা তখনকার দিনে একমাত্র ফ্রেডরিকই জানত। কিন্তু লন্ডনে ব্যবসা ভাল না চলাতে ফ্রেডরিক এক জার্মান রেকর্ডিং এঙপার্টসহ ভারতে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতে এসেই তারা কলকাতার হ্যারিসন রোডে অভিজাত বাবুদের সামনে গান রেকর্ড করা শুরু করেন। প্রথম রেকর্ড করেন আগ্রা থেকে আগত গওহরজান নামক এক গায়িকার কণ্ঠে। কলকাতার লোকজন হুমড়ি খেয়ে গানের রেকর্ড কেনা শুরু করে। গ্রামোফোন কোম্পানী লাভ দেখে ১৯০৮ সালে শিয়ালদহে রেকর্ডি তৈরির কারখানা স্থাপন করে। মানুষ তখন শিয়ালদহকে ‘বাজনীপাড়া’ নামে ডাকা শুরু করেন। হিজ মাস্টারস ভয়েস পরে দিল্লি, মুম্বাই ও চেন্নাইয়ে রেকর্ডিং স্টেশন খুলে। তারা এত বেশি লাভ করে যে বিভিন্ন গায়ক-গায়িকার সাথে চুক্তি ও রয়েলটি চালু করে। এই রেকর্ডের বাজার সিংহল ও বার্মায়ও বিপুলভাবে প্রসারিত হয়। এই এম ভি বা হিজ মাস্টারস ভয়েস রেকর্ড কোম্পানী ১৯২৬ সালে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে তার কবিতা রেকর্ড করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি ১৪০০ সাল কবিতা আবৃত্তি করেন।
১৯২৮ সালে শিয়ালদহ থেকে রেকর্ড ফ্যাক্টরি দমদমের যশোর রোডে সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর ভারতীয় সিনেমা শিল্প রেকর্ড কোম্পানীর মুনাফাকে বৃদ্ধি করে দেয়। সায়গল, মুকেশ, লতা, হেমন্ত সবার গান রেকর্ড করে ভারতের বিশাল বাজারে দাপটের সাথে রেকর্ড কোম্পানি ব্যবসা চালিয়ে যায়। ’৭০ এর দশকে ক্যাসেট ও পরিবর্তীতে ডিস্ক চালু হওয়ায় গ্রামোফোন কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় এক শত বছরের ব্যবসার সমাপ্তি ঘটে ২০০০ সালে এইচ এম ভি হিজ মাস্টারস ভয়েস কোম্পানী সারেগা মা ইন্ডিয়া কর্তৃক খরিদ করা হলে। এইচ এম ভির ২০% রেকর্ড এখনো বিদ্যমান। আর ৬০% রেকর্ড বিভিন্ন সংগীত প্রেমীদের ঘরে সংরক্ষিত। কুকুরের প্রভু করিম খান যেমন আর নেই, তেমনি কুকুরের লোগোর সেই গানের রেকর্ডও আর নেই। টেকনোলজির বিবর্তনে কলের গান বা গ্রামোফোনের রেকর্ড লুপ্ত। কিন্তু ইতিহাস অমর করে রেখেছে ওস্তাদ আবদুল করিম খান ও তার গান শুনে মুগ্ধ হওয়া সেই কুকুর।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, চিকিৎসক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকরোনাসহ সকল চিকিৎসায় অমায়িক সেবা ‘মা ও শিশু হাসপাতালে’
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে মাস্ক বিতরণ ও সচেতনতামূলক সভা