করোনাসহ সকল চিকিৎসায় অমায়িক সেবা ‘মা ও শিশু হাসপাতালে’

ড. চৌধুরী মোহাম্মদ মনিরুল হাসান | মঙ্গলবার , ২৪ নভেম্বর, ২০২০ at ১০:২৫ পূর্বাহ্ণ

অসুস্থতাও আল্লাহ তা‘আলার অনেক বড় নিয়ামত। বিভিন্ন হাদীসে রোগ-শোক ও বালা-মসিবতেরও তাৎপর্য ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা মাঝে মধ্যে রোগ বালাই দিয়ে বান্দার ঈমানের দৃঢ়তা বা ওজন পরীক্ষা করে থাকেন। তিনি দেখতে চান বিপদ বা আপদকালীন সময়ে তার বান্দাদের মধ্যে কে বা কারা তার উপর অবিচল আস্থা বা বিশ্বাস রেখে, ধৈর্য্যের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আল্লাহ পাক কোরআনে সূরা বাকারার ১৫৫ নাম্বার আয়াতে ইরশাদ করেন ‘আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে’। অসুস্থতা দেহের যাকাত স্বরূপ। এর দ্বারা শরীর গুনাহমুক্ত হয়, পাক-পবিত্র হয়। আল্লাহর কাছে বান্দার মর্যাদা বুলন্দ হয়। ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য উপদেশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। অসুস্থতার সময় নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা মানুষের কাছে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠে। শারীরিক শক্তি ও সুস্থতা, অভ্যন্তরীণ প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার মিথ্যা অহমিকা অনেকেরই আছে। কোনো অভিনব সৃষ্টিশীল কাজ করে নিজের দিকে তা সম্পৃক্ত করে পুলক অনুভব করার মানসিকতা আছে সবারই। কখনো কোনো বড় কাজ করতে পারলে বুদ্ধির অপরিপক্বতা ও অপূর্ণতার দরুণ আত্মমুগ্ধতার শিকার হয়ে যায় অনেকেই। কখনো এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা এ পর্যায়ে পৌঁছে যে, ব্যক্তি নিজেকেই নিজের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রক ও সর্বেসর্বা মনে করে। অথচ মানুষ এতটাই দুর্বল ও অক্ষম যে, তাকে পরাভূত করার জন্য অতি আণুবীক্ষণিক ছোট্ট ভাইরাসই যথেষ্ট।
একটি অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস, যার আকার ১২০ থেকে ১৪০ ন্যানোমিটার। কিভাবে বিশ্বকে অচল করে দিতে পারে, তা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে বিশ্ববাসী। কিভাবে করোনাভাইরাস নামক একটি মারাত্মক জীবাণু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে তাও দেখছে বিশ্ব। এসবের কাছে আমরা অর্থাৎ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী মানুষ কত অসহায় তা আবার প্রমাণিত হলো। ক্ষুদ্র করোনা ভাইরাসের কাছে পারমাণবিক শক্তিও অচল ও অসহায়। এ মারাত্মক ভাইরাসের প্রতিষেধক কবে নাগাদ মানুষের হাতে এসে পৌঁছবে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
এ করোনা ভাইরাসে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তারাই বুঝতে পারবেন এ রোগ সম্পর্কে। সমপ্রতি আমি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলাম। ডাক্তারদের সেবা ও আন্তরিকতায়, পরিবার এবং স্বজনদের সহযোগিতায় দ্রুত এ ভাইরাস থেকে সেরে উঠি আমি। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর আমি চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন সেন্টারের ৪১৪ নাম্বার কেবিনে সাত দিন ভর্তি ছিলাম। ডাক্তারদের অমায়িক ব্যবহার ও দক্ষতা, নার্সদের যত্ন ও ডিসিপ্লিন এবং পরিচ্ছন্ন কর্মীদের পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম এবং সর্বোপরি তাদের টোটাল ম্যানেজমেন্ট দেখে আমি মুগ্ধ এবং অত্যন্ত খুশি। কয়েকজন মানবতার সেবক ডাক্তারের নাম না বললেই নয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডা. রজত শংকর, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিক বড়ুয়া, ডা. তানভীর, ডা. মোঃ আশরাফ এবং আমার বন্ধু ও করোনা আইসোলেশন সেন্টার (RT-PCR) ল্যাব এর প্রধান মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডা. সঞ্জয় কান্তি বিশ্বাস। আমি তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ এবং তাঁরা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আমি অনেক উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে দেখেছি যাঁরা চট্টগ্রাম মা ও শিশু হসপিটাল থেকে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। যেটা চট্টগ্রামের অনেক নামিদামি হাসপাতালে এ ধরনের সেবা পাওয়া যায় না। সেবা পাওয়া গেলেও অত্যন্ত ব্যয় বহুল। আমি আশা করব চট্টগ্রামের রোগীরা যারা সাধ্যের মধ্যে ও কম খরচের মধ্যে ভাল সেবা ও চিকিৎসা পেতে চান আপনারা চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে আসবেন এবং ভাল সেবা গ্রহণ করবেন ।
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল (সিএমওএসএইচ), ১৯৭৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু বর্ষ উপলক্ষে চট্টগ্রামের কিছু মহৎ প্রাণ ও সমাজ হিতৈষী ব্যক্তির উদ্যোগে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদে অবস্থিত ৪ দশমিক ৩ একর (১.৭ হেক্টর) জায়গার উপর কলেজ ভবন, ৬৫০ শয্যা বিশিষ্ট চট্টগ্রাম মা-শিশু জেনারেল হাসপাতাল এবং একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। এটি একটি অলাভজনক সংস্থা এবং ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার তিন যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র শিশু স্বাস্থ্য বহির্বিভাগের মাধ্যমে এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে এটি ৬৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ জেনারেল হাসপাতাল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৬ সাল থেকে শুরু হয় কলেজের কার্যক্রম। কলেজটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এবং কলেজটি সিএমওএসএইচের কার্যনির্বাহী কমিটি দ্বারা পরিচালিত। কলেজের অধ্যক্ষ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন এ এস এম মোস্তাক আহমেদ।
মানবতার সেবক, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক এস এম ফজলুল করিম স্যার ও গরীব ও দুস্থ রোগীদের মমতাময়ী মা ডাক্তার আন্‌জুমান-আরা -ইসলামের নেতৃত্বে এঙিকিউটিভ কমিটি তথা কার্যনির্বাহী পরিষদ রয়েছে, হাসপাতালের উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও গরীব এবং দুস্থ রোগীদের সেবাই ব্রত আছেন সমাজের এমন জনহিতৈষী, চিত্রশালী ও বিত্তশালী, সাদা মনের কিছু ভালো মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনকে আমার কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রফেসর (ইঞ্জিনিয়ার) এম আলী আশরাফ, ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ জাবেদ আফসার চৌধুরী, এস এম মোরশেদ হোসেন, রেজাউল করিম আজাদ, ডা. পারভেজ ইকবাল শরীফ, ডা. নুরুল হক অন্যতম। তাঁদের সাথে আমার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভায় দেখা করার সুযোগ হয়েছে এবং দেখতে পেয়েছি তাদের আন্তরিকতা, ইচ্ছাশক্তি, দেশের জন্য কাজ করার স্বপ্ন, সর্বোপরি মানবতার জন্য কাজ করার আগ্রহ। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে তাদের জন্য আমি উত্তম প্রতিদান চাই। আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্যই যথেষ্ট।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন শিক্ষক। টাকা পয়সা দিয়ে হয়তো মানুষের সেবা করতে পারবো না। কিন্তু আমার অর্জিত জ্ঞান, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং আল্লাহ প্রদত্ত জানমাল ও সময় দিয়ে মানবতার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বো। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখনই আমাকে ডাকবে আমি তাদের ডাকে সাড়া দিব ইনশাআল্লাহ।
অত্র হাসপাতালে বর্তমানে বহির্বিভাগে শিশু স্বাস্থ্য, মেডিসিন, অবস এন্ড গাইনী, জেনারেল সার্জারী, অর্থোপেডিক সার্জারী, শিশু সার্জারী, নাক-কান-গলা, চক্ষু, দন্ত, চর্ম ও যৌন রোগ, ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার, মানসিক রোগ, এ্যাজমা ক্লিনিক ইত্যাদি এবং আন্তঃ বিভাগে মেডিসিন, শিশু স্বাস্থ্য, নিওনেটলজি, শিশু নিউরোলজি, অবস এন্ড গাইনী, জেনারেল সার্জারী, শিশু সার্জারী করানো হয়। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধি শিশুদের জন্য রয়েছে প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী প্রফেসর ডা. চৌধুরী মাহমুদ আরজুর তত্ত্বাবধানে অত্যাধুনিক সকল সুযোগ সুবিধাসহ বিশেষায়িত শিশু বিকাশ কেন্দ্র ।
অসহায়, দুস্থ ও গরীব রোগীদের এখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া অসহায় ও গরীব রোগীদের প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যাকাত ফান্ড ও দরিদ্র কল্যাণ তহবিল থেকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। অন্যান্য রোগীদের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত কম মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে সকল চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ কোন রোগী অর্থাভাবে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হবে না। এটি এই প্রতিষ্ঠানের একটি অন্যতম লক্ষ্য।
চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কর্মে এ প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এখানে একটি বেসরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, নতুন নতুন বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা চালু সহ একটি পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ভিলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। সে লক্ষ্যে হাসপাতালের একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরী করা হয়েছে। এ মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ৮৫০ শয্যা বিশিষ্ট ( ১৩ তলা) নতুন হাসপাতাল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। এ নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। গত ২৬/০১/২০১৩ ইং তারিখ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নতুন এই হাসপাতাল ভবনের নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। আমরা আশা করি যথাসময়ে এই নতুন হাসপাতাল ভবনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। নতুন এই হাসপাতাল ভবনে সকল বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা থাকবে। নতুন এই হাসপাতাল ভবন নির্মিত হলে তা এই অঞ্চলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে যুগান্তকারী অবদান রাখবে। পাশাপাশি আমি হাসপাতালের উন্নয়নে সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।
পরিশেষে এখন আমি যে বিষয়টির উপর গুরুত্বারোপ করবো তা হলো- করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরে আমরা যখন ঘরে অবস্থান করি অথবা অনেকেই আবার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরি তখন আমরা কিভাবে ফলোআপে এ থাকবো, ওষুধপত্র খাব, কি নিয়মে খাওয়া-দাওয়া করব এই সবগুলোকে একসাথে আমরা পোস্ট কোভিড ম্যানেজমেন্ট বলি। যেহেতু SARS-CoV2 একটি নোবেল করোনাভাইরাস এবং যেটা আগে কোন মানুষকে আক্রান্ত করেনি। তার অতীত কোনো অভিজ্ঞতা নেই কোন বিজ্ঞানীর কাছে। সেজন্য এই ভাইরাস সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। এই ভাইরাস পরবর্তীতে আমাদের শরীরের কোন অঙ্গ কে আবার আক্রান্ত করবে কিনা! অথবা কিভাবে আমরা এই নতুন ফ্লু ভাইরাস থেকে পরিপূর্ণ সুস্থ হতে পারব। তা নিয়ে হয়নি উল্লেখযোগ্য গবেষণাও। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ডাক্তারদের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। যাদের শ্বাস কষ্ট, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং কিডনিসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ আছে তাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদের অবশ্যই একজন মেডিসিন অথবা বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে একজন মানুষের বিভিন্ন বয়স অনুযায়ী এ করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হতে দুই থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এছাড়াও নিয়মিত ব্যায়াম ও মেডিটেশনও করা উচিত।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটেকসই শিল্প সম্পর্ক শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল