ভাষা শহীদ শিশু অহিউল্লাহ

রেজাউল করিম | বুধবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

শুরু হলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। মাসটি এলেই বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলি। বাংলা ভাষার গুরুত্বকে তুলে ধরি। কিন্তু ভাষা শহীদ কয়জনের নাম জানি। ‘মোদের গরব মোদের আশা, মরি বাংলা ভাষা’ শুধু ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক। ইতিহাস বলছে, বাংলা ভাষার এই আন্দোলনে রয়েছে শিশুকিশোরের ভূমিকা। অহিউল্লাহর কথা আমরা কজনইব জানি, মনে রেখেছি।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্রসমাজ। শান্তিপূর্ণ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পাক জান্তাদের মিলিটারিপুলিশ। গুলিতে রফিক, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত শহীদ হন। গুলিতে গুরুতর আহত আবদুস সালাম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুরো ঢাকা শহর তখন থমথমে ও গুমোট পরিবেশ।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডে পাকিস্তানি সৈন্যদের টহল চলছে। পুরো নবাবপুর রোড এলাকা সুনসান নীরবতা। লোকজনের মাঝে অজানা আতঙ্ক ভর করেছে। মাঝে মাঝে দুচারটা গাড়ি যাচ্ছে এদিকওদিক। ভাষার দাবিতে পাক সৈন্যদের গুলিতে হত্যার শিকার রফিক, জব্বার, বরকতদের হত্যা নিয়ে শোক ও প্রতিবাদ মিছিল বের করে ছাত্ররা। ছাত্রদের মিছিল আর স্লোগানে স্লোগানে নবাবপুর এলাকার আকাশবাতাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

নবাবপুর এলাকা যখন স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত। ঠিক তখন ওই এলাকার খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে আনুমানিক নয় বছর বয়েসী একটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। তার সামনেই ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি। জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত পাকিস্তানি সৈন্যরা ছিল ছেলেটির দেখা এলাকায় নতুন আগন্তুক। এমন বিচিত্র পোশাকের মানুষ ছেলেটি জীবনে প্রথম দেখেছে। নয় বছরের ছেলেটি জানে না তারা কারা। তার আবার ছিল ছবি আঁকার শখ। ছেলেটি পকেট থেকে একটি সাদা কাগজ বের করে জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত সৈন্যদের ছবি আঁকার প্রস্তুতি নেয়। শিশুটি মিছিল দেখামাত্র ছবি আঁকার কাগজ নিজের মুখে পুরে মিছিলে যোগ দেয়। মিছিলটি কয়েক হাত সামনে এগোতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা আকস্মিক গুলি ছুড়তে শুরু করে। সৈন্যদের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান, ছাব্বিশ বছরের আবদুল আউয়াল নামের একজন নিরীহ রিকশাচালক এবং সেই নয় বছরের শিশুটি। ঘাতকের বুলেটে সেই শিশুটির মাথার খুলি উড়ে যায়। এ অবস্থায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। ঘাতকরা তিনটি লাশ নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় শিশুটির পরিচয় নিশ্চিত হতে প্রচেষ্টা চলে। শিশুর লাশটির প্রত্যক্ষদর্শী ডা. মেজর (অব.) মাহফুজ হাসান লাশের বুক পকেটে প্রজাপতি, ফুল, পাখি, জীবজন্তু আঁকা কিছু কাগজ পান। তিনি প্রথমে শিশুটির নাম জানতে পারেন শফিউল্লাহ। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পর নিশ্চিত হওয়া যায় নিহত ওই শিশুর নাম শফিউল্লাহ নয়, অহিউল্লাহ। শিশুটির পিতা রাজমিস্ত্রি। নাম মো. হাবিবুর রহমান। চিহ্নিত হওয়ার পিতাকে খবর দিয়ে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অহিউল্লাহর পিতা হাবিবুর রহমান নিজ ছেলের লাশ নিতে চাইলেও পাক সৈন্যরা লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেনি। অহিউল্লাহর লাশ সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত গোপনে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে।

বাবামায়ের একমাত্র সন্তান লিকলিকে গড়নের অহিউল্লাহ ছিল দুরন্ত প্রকৃতির। মাথাভর্তি ছিল ঝাঁকড়া চুল। সারা দিন ঢাকা শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ানো আর ছকি আঁকাই ছিল তার কাজ। দরিদ্র ঘরে জন্ম নেওয়া অহিউল্লাহর পিতা তার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শত অভাবের সংসারেও ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে। মাত্র তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল অহিউল্লাহ। ছেলে অহিউল্লাহ পাক সৈন্যদের বুলেটে শহীদ হওয়ার পর লাশটিও পাননি পিতা।

ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় অহিউল্লাহর শহীদ হওয়ার ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘সৈনিক’ নামের একটি পত্রিকা। ওই পত্রিকায় ভাষাশহীদদের তালিকায় অহিউল্লাহর নাম ছিল। চিত্রশিল্পী শ্যামল বিশ্বাস অহিউল্লাহর পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী প্রবীণদের কাছে অহিউল্লাহর শারীরিক বর্ণনা শুনে ছবি আঁকার কাজ শুরু করেন। এর আগে পরিবারের লোকজনদের কাছে বর্ণনা শুনে ভাষা শহীদ আবদুস সালামের ছবি এঁকেছিলেন ভাস্কর রাশা। সালাম, বরকত রফিক, জব্বার, শফিউরদের নাম সবাই জানি। কিন্তু ভাষা শহীদ শিশু অহিউল্লাহ অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছেন ইতিহাসের পাতা থেকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাঘের শীতে
পরবর্তী নিবন্ধছয় আসনে আজ উপনির্বাচন