এটি সর্বজনবিদিত যে, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আবহমান বাংলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিশ্বনন্দিত। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ জনপদ বরাবরই ছিল ভিনদেশী শাসক-শোষকের নিপীড়ন-নির্যাতন-নিষ্পেষণের অভিঘাতী অনগ্রসর গ্রাম। আর্য-দ্রাবিড়-রাঢ়-মৌর্য-তুর্কি-পাঠান-মোগল-ইংরেজ-পাকিস্তানসহ সকল উপনিবেশিক আমলে লুন্ঠনের প্রেক্ষাপট ছিল অভাগী বাংলার দু:খ-দুর্দশার ক্রোড়পত্র। পক্ষান্তরে বিদেশি বণিকদের আকৃষ্ট করার মত বিচিত্র ও মূল্যবান পণ্য সামগ্রীর সমারোহে বাংলার প্রকৃতি ও পরিধির অবস্থান ছিল অতুলনীয়। সতের শতকের এই বাংলা সম্পর্কে ফরাসী ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস বার্ণিয়ার বলেছিলেন, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মনোরম ও সুফলা দেশ হিসেবে মিসরকে বর্ণিত করা হলেও বিষয়টি আসলে প্রাপ্য ছিল এই বাংলার। সমগ্র অশুভ শক্তির অন্ধকারের দেয়াল ভেঙ্গে মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে সামরিক ও সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছিল মহান ভাষা আন্দোলন।
১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে রাজপথ রক্তভেজা হয়েছিল শহীদদের প্রাণ বিসর্জনে। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনার সূচনাপাঠ ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এর ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতিসত্তার নবতর উন্মেষ ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিস্মরণীয় প্রজ্বলনে বাঙালি অর্জন করেছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ৩০ লক্ষ শহীদান ও ২ লক্ষ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন হয়েছে মূলত ভাষার আন্দোলনের উৎসসূত্রে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এর স্বকীয় বিকাশ ও বিস্তারে বিশ্বে এতবেশি রক্তদানের অধ্যায় একান্তই বিরল। প্রখ্যাত সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী-লেখক ও কলামিস্ট সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’ গানটির মর্মস্পর্শী প্রাণস্পন্দনে উচ্চকিত পথযাত্রায় বর্ণিল হয়েছে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের অনবদ্য ইতিহাস।
জাতির দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায়ে শুধু উপমহাদেশে নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও চট্টগ্রাম সমাদৃত হয়েছে অনন্য, উজ্জ্বল ও প্রত্যয়ী ভূমিকার জন্যে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক ‘আজাদীর’ প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে মুদ্রিত কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা সংশ্লিষ্ট নিদারুণ নিপীড়ন, নির্যাতনের বিষয়সমূহ এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যা আমার অনেক নিবন্ধে ইতোমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। আজকের দিনে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠায় রফিক-জব্বার-বরকত-সালামসহ সকল শহীদ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল প্রাণ বিসর্জনকারী শহীদানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। অতি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে; প্রভাতফেরির অচিন্তনীয় ভাবাবেগে নারী-পুরুষ-শিশু ও কিশোর-তরুণ-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ আপামর জনসাধারণের পদচারণায় ও শহীদ মিনারের বেদীমূলে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ তৈরি করেছে বাঙালির শাশ্বত অটুট বন্ধন। এরই প্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে সৌহার্দ সম্প্রীতি প্রকাশে বাঙালির ঐতিহ্য-কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অপরূপ বৈশিষ্ট্য এবং নির্ভীক-নান্দনিক-মাঙ্গলিক দেশপ্রেমের অবিচ্ছেদ্য পটভূমি।
বস্তুতপক্ষে বাংলার স্বরূপ উন্মোচনে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হবে রবীন্দ্র-নজরুল-জসিমউদ্দিন-জীবনানন্দ-সুকান্ত ও শামসুর রাহমানের কাছে। প্রাসঙ্গিকতায় পল্লীকবি খ্যাত বাংলার প্রকৃতি পূজারী কবি জসীম উদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ থেকে কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করতে চাই। ‘গড়াই নদীর তীরে, কুটিরখানিরে লতা-পাতা-ফুল মায়ায় রয়েছে ঘিরে।/ বাতাসে হেলিয়া, আলোতে খেলিয়া সন্ধ্যা সকালে ফুটি,/ উঠানের কোণে বুনো ফুলগুলি হেসে হয় কুটি কুটি।/ মাচানের পরে সীম-লতা আর লাউকুমড়ার ঝাড়,/ আড়া-আড়ি করি দোলায় দোলায় ফুল ফল যত যার।/ তল দিয়ে তার লাল নটেশাক মেলিছে রঙের ঢেউ,/ লাল শাড়ীখানি রোদ দিয়ে গেছে এ বাড়ির বধূ কেউ।/ মাঝে মাঝে সেথা এঁদো ডোবা হতে ছোট ছোট ছানা লয়ে,/ ডাহুক মেয়েরা বেড়াইতে আসে গানে গানে কথা কয়ে!/ গাছের শাখায় বনের পাখিরা নির্ভয়ে গান ধরে,/ এখনো তাহারা বোঝেনি হেথায় মানুষ বসত করে।’ কী অসাধারণ ভারসাম্য ব্যঞ্জনায় নির্মিত হয়েছে গ্রামীণ বাংলার মানুষ ও নিসর্গের রূপক মেলবন্ধন। উল্লেখ্য পরিক্রমায় সৃজিত ভাষার প্রতি আবেগ ও গুরুত্ব অনুধাবন মহান স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট নতুন জ্ঞান গরিমায় এবং ত্যাগের আদর্শে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সচেতন বাঙালি সম্যক অবগত আছেন, ভাষাভিত্তিক একটি জাতি হিসেবে বাঙালির আত্নপ্রকাশ ঘটেছে হাজার বছরের বহু পূর্বে। ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মান ভাষার সমরূপ বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রায় দশম শতক থেকেই প্রবাহমান। মূলত: মানব সংস্কৃতির বস্তুগত উপাদান সৃষ্টির পটভূমিতে রয়েছে অবস্তুগত জ্ঞান-বিজ্ঞানেরই ধ্যান- ধারণা। অবস্তুগত সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ মাতৃভাষা মানুষের মনো-জগতের ভাব-কল্পনা, ধ্যান-ধারণা, সাহিত্য-শিল্পকলা ইত্যকার সকল অপার্থিব ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক রূপে চিহ্নিত। যেহেতু অন্য কোন প্রাণীর ভাষা নেই, তাদের সংস্কৃতিও নেই। একমাত্র ভাষার কারণে মানুষ সংস্কৃতিবান হতে পেরেছে। বিজ্ঞজনের মতে, উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ভাষা হচ্ছে বাংলা ভাষা এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আসীন করার লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এতদ অঞ্চলে দ্বিতীয় নবজাগৃতির দৃষ্টান্ত হয়েছে। বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিশাল আত্মত্যাগের মহিমা বাঙালি জাতির জন্য শুধু গৌরবগাঁথা নয়, এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্ব আজ গৌরবদীপ্ত হয়েছে। খ্যাতিমান ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতে – ৬৫০ খ্রীস্টাব্দে এর প্রকাশ কালকে যদি চিহ্নিত করা হয়, তাহলে এই ভাষার সমৃদ্ধির ইতিহাস প্রায় চৌদ্দশত বৎসর।
বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, বিকাশ ও প্রসারে এই মাতৃভাষার ভূমিকা শুধু ঐতিহ্য বা কৃষ্টিমন্ডিত নয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই ভাষার অবদান এক অভিনব জনান্তিকে আচ্ছাদিত। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিতে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ-পরিক্রমায় ঋদ্ধ প্রাণশক্তিতে পরিপুষ্ট হয়ে মাতৃভাষা বাংলা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্ত ভিত হিসেবে উপহৃত। একুশের চেতনায় ভাস্বর মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিসমূহ তথা সংবিধানসম্মত জাতির প্রধান চার আদর্শ – জাতীয়তাবাদ, ধর্ম-নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে জাতি তাদের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করেছে। মাতৃভাষা বাংলাকে প্রায়োগিক অর্থে যথাযথ মূল্যায়ন এবং সর্বত্র এর বিকাশমানতাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনে আমাদের তৎপরতা কোনভাবেই জাতির সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে না। মাতৃভাষার মাধ্যমে সকল স্তরে এবং সকল জনপদে শিক্ষাকে যদি কার্যকরভাবে জনপ্রিয় করা না যায় তাহলে শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং এর প্রাসঙ্গিক উন্নয়ন নিয়ামকসমূহের তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি কোনভাবেই সম্ভব নয়।
বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার যে প্রবণতা তা যে শুধু ব্রিটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান শাসিত আভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুগে সমপ্রসারিত হয়েছিল তা নয়। এর বহু আগে থেকে বিশেষ করে তুর্কি শাসনের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি বিরূপ ধারণা স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। মধ্যযুগে বাংলাভাষার মর্যাদাকে স্ব-শাসনে প্রতিষ্ঠাকল্পে কবি আব্দুল হাকিম তার ‘বঙ্গবাণি’ শীর্ষক এক কবিতায় লিখেছেন- “যে সব বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণি, সে সব কাহার জনম নির্ণয় ন জানি”। এটি যে শুধু একটি ব্যঙ্গার্থক কথপোকথন বা কোন রচনার পংক্তি ছিল তা নয়, তা ছিল এই অপশাসন এবং বাংলা ভাষা অবমূল্যায়নের বিরুদ্ধে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের প্রচীয়মান প্রকাশ। ‘আমার ধ্যানের ভারত’ শীর্ষক রচনায় ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) বলেছেন- ‘মাতৃভাষাকে স্থানচ্যুত করার পদ্ধতিকে, ইংরেজদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায় বলে বর্ণনা করা যেতে পারে’। তিনি বলেন, রামমোহন রায় আরো বড় সংস্কারক এবং লোকমান্য তিলক আরো বড় পণ্ডিত হতে পারতেন যদি তাঁরা তাঁদের চিন্তাধারাকে ইংরেজিতে চিন্তা বা প্রকাশ না করে তাঁদের মাতৃভাষায় তার প্রকাশ ঘটাতেন।
অবশ্যই উল্লেখ্য গুণী ব্যক্তিরা ইংরেজী সাহিত্যের সু-সমৃদ্ধ রত্নভাণ্ডারের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন, নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে না হওয়াতে এ জ্ঞান অর্জন কতটুকু জনগণের উপকারে এসেছে তা প্রশ্নের দাবি রাখে।
নিজের মাতৃভাষায় জ্ঞানের সমৃদ্ধিকরণকে অবহেলা করে গান্ধী মনে করেন, একদল অনুবাদকের সৃষ্টি করে কোন জাতি মহৎ কিছু অর্জন করতে পারে না। মাতৃভাষায় চিন্তা, মত প্রকাশ এবং সামগ্রিক অর্থে জ্ঞান অর্জনের যে ধারা সেটি বিশ্বের শীর্ষ উন্নত দেশসমূহ তথা চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মান ইত্যাদির উন্নয়নের সফল ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পরিপূর্ণ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা অভিষিক্ত হলেও এখনো আমরা পাইযে, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তনের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে বাংলা ভাষায় একটি রীট আবেদন করা হয়। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ বাস্তবায়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনী ঘোষণা করা হবে না, বাংলা ভাষা আইন সর্বত্র অনুসরণ করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ঐ আইনের ৪ ধারা অনুসারে প্রয়োজনীয় বিধি জারি করার নির্দেশ দেওয়া হবে না, এই মর্মে মন্ত্রী পরিষদ সচিব, আইন সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবসহ সাতজনকে বিবাদী করে হাইকোর্টে রুল চাওয়া হয়।
এর প্রক্ষিতে হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারপতি জনাব কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি জনাব এ বি এম আলতাফ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ইংরেজিতে থাকা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নম্বর প্লেট, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লেখার অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিয়েছেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শহরের অন্যান্য কলেজ, মুদ্রা, স্ট্যাম্প এবং নৌবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষাসহ সরকারি সকল কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেমন ১৯৪৮ সালের ১১ ই মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়েছিল, উল্লেখিত রীট আবেদন নতুন করে সেই ধারণাকে শাণিত করেছে বলে আমার বিশ্বাস। ‘একুশ মানেই মাথা নত না করা’ মাতৃভাষা আন্দোলনের এই ক্ষিপ্রগামী বোধের ধারা এখনো কতটুকু জোরালোভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে,এই রীট আবেদন তারই সাক্ষ্য বহন করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদির অপরিসীম উন্নয়ন মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে এবং এর যথাযথ মর্যাদা এবং সর্বক্ষেত্রেই এর সামগ্রিক প্রচলন যতটুকু না প্রভাব বিস্তারের কথা ছিল, তা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই আমাদের এখনো আদালতের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বাঙালি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা কী হতে পারে! সংস্কৃতির বিশ্বায়ন এমন এক ভঙ্গুর সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মোড়কে দীয়মান হয়েছে যা প্রতিনিয়ত আমাদের ঐতিহ্যকে নষ্টামির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের ধারণা অনুযায়ী প্রচলিত নব্য-উদারনৈতিক বিশ্বায়নের মতাদর্শে গণমাধ্যম, জনসংযোগ শিল্প ও বিজ্ঞাপনের সাহায্যে তথা সংবাদ বুলেটিন, সাক্ষাৎকার, সম্পাদকীয়, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন যন্ত্র এমন এক অবস্থান দখলে নিয়েছে যাতে সাধারণ নাগরিকেরা পরিণত হয়েছে পণ্য সামগ্রীর উৎসাহী ভোক্তা ও ক্রেতায়। অধ্যাপক জ্যাকি বি. জেলিনাসের মতে-’ এই বিজ্ঞাপন কর্মযজ্ঞে প্রতি বছর কোম্পানিগুলো খরচ করে ১৪০০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি যা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মোট ঋণের ৭০ শতাংশ বা বিশ্বব্যাপী শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সকল সরকারি ব্যয়ের ৫০ শতাংশ। সংস্কৃতির এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জাতিগত ঐতিহ্যিক অনুশীলন, ভাষার গুণগত চর্চা ইত্যাদি বাংলা ভাষাকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করছে। ’বাঙলিশ’ অর্থাৎ বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে সংবাদ পরিবেশন, বিনোদন কর্মকাণ্ড উপস্থাপন, বিজ্ঞাপন যন্ত্রে অতিমাত্রায় অনর্থক প্রযুক্তির ব্যবহার, আবৃত্তি, নৃত্যকলা, নাটক, ছায়াছবি ইত্যাদিতে এমন এক অপসংস্কৃতির ধারার বিকাশ ঘটাচ্ছে, টেলিভিশন ও বেতার নির্ভর এসব কর্মকাণ্ড কোন ভাবেই যে বাংলা ভাষা ভিত্তিক একটি উন্নত জাতির ভবিষ্যতকে সত্য-সুন্দর কল্যাণ ও আনন্দের পথে এগোতে দেবে না -এটি অনেকটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়। করোনার এই বৈশ্বিক ক্রান্তিকালে বাঙালির মাতৃভাষা আন্দোলনের আরাধ্য গন্তব্য বা স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার প্রেরণা ও প্রেষণা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের সাথে করোনা মুক্তির জয়গানে পুরোবিশ্ব উদ্বেলিত হউক – এই প্রত্যাশায় ক্ষুদ্র নিবন্ধের ইতি টানছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।