ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে সৃজনশীলতায়

নিশাত হাসিনা শিরিন | রবিবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা নূতন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা দিয়েছেন। এর নাম সৃজনশীলতা। এই প্রতিভা বা গুণটি প্রায় সকলের কাছে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। একে বিকশিত করার সুযোগ করে দিতে হয়।
আমাদের সমাজে দেশে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তাহল এই সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করতে না দেয়া। আমাদের অভিভাবকরা অর্থাৎ মা-বাবা এমনকি শিক্ষকরা ও সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা মনে করেন সন্তানদেরকে গান বাজনা, লেখালেখি, বইপড়া, নাটক করা, চিত্র আঁকা, ওরেসেমি, আবৃত্তি করা, অভিনয় করা ইত্যাদি নানা সৃজনশীল কাজে জড়ালে তাদের পড়ালেখায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। ফলে তারা বাবা মায়ের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হবে এবং নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে না। একটা কুচক্রী মহলতো সবখানেই রয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টায় থাকে কিভাবে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ও রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করবে। এজন্যে তারা প্রতিনিয়ত যুব সমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। মাদক, পেশীশক্তি, দুর্নীতি, প্রভাবপ্রত্তি প্রভৃতির প্রতি নিত্য আকৃষ্ট করাই তাদের কাজ। তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে তাদের মেধা মননকে বিনষ্ট করে সমাজ ও দেশকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। অথচ ঐ ভবিষ্যৎ প্রজন্মই দেশের কর্ণধার বা প্রাণ। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি ধ্বংস হয় তবে দেশও ধ্বংস হতে বাধ্য।
এখন বড় দুঃসময়। থমকে দাঁড়িয়েছে জীবন। তথাকথিত সমৃদ্ধি ও উৎকর্ষ অর্জনের প্রতিযোগিতায় বস্তুবাদী মানুষ আজ দিশেহারা। ফুলের পেলবতা, পাখির কুহুতান, ঝর্ণার নুপূর আজ আর মানুষকে কাছে টানে না। আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা নৃশংসতায় রূপ নিয়ে সমাজকে অবক্ষয়ের প্রান্তসীমায় পৌঁছে দিয়েছে। এ ঝিমমারা সমাজটাকে একটু নাড়া দিতে, মানব মননকে জাগাতে, তার বুকে আগুনের পরশ দিতে, সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসির গহণ গভীরে ডুব দিয়ে জীবনে পরম সত্যকে বুঝতে এবং বুঝাতে সৃজনশীলতার চেয়ে বড় আশ্রয় আর কী হতে পারে? নিজের মনের সাথে কথা বলতে, আবেগ, প্রেম ও স্বপ্নকে লালন করতে সৃজনশীল কাজগুলোই প্রশান্তি পরমনির্ভরতা! সৃজনশীল মানুষগুলো স্রষ্টা এবং ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাও। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন আর বৈজ্ঞানিকেরা তা বাস্তবে রূপদান করেন। তাই, সৃজনশীল মানুষগুলোর সৃজনশীলতাকে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনেরর মূলমন্ত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না বা বেশি বলা হবে না। সৃজনশীলতায় থাকে অপার মুগ্ধতা আর ভাললাগা বোধে নিমগ্ন থাকার অন্যরকম অনুভূতি সে এক মোহনীয় শক্তি। সৃজনশীলতার মাধ্যমে (সৃজনশীল নানা কাজের) মানুষ পৌঁছে যায় অগণিত পিপাসার্ত মানুষের হৃদয়ে মাধ্যমে সঞ্জীবত করেন মানুষের অন্তর। সাহিত্যিক আবুল ফজলের মতে ‘মনুষ্যত্ব বা মানবধর্মের সাধনাই সংস্কৃতি এবং একমাত্র এই সাধনাই জীবনকে করতে পারে সুন্দর সুস্থ। আবার সাহিত্যিক মোতাহার হোসেন চৌধুরীর মতে-‘সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে বাঁচা, বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা। আসলে সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকায় রয়েছে গভীর প্রশান্তি।
দেশের বর্তমান যুব সমাজের মাঝে অসুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, ফেইসবুক, অসুন্দর প্রলোভন, মানসিক অস্থিরতা, জঙ্গিবাদ, খুনাখুনি, মাদকাসক্তি, মদ, জুয়া তথা রাজনৈতিক নীতিহীনতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে করছে হতাশাগ্রস্ত। আরো আছে পশ্চিমা অপসংষ্কৃতির নিলজ্জ আগ্রাসন। এসব কিছু থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তি দেয়ার মানসে, সুস্থ সংস্কৃতি চর্চায় তাদেরকে অনুরক্ত করতে সৃজনশীলতার কোন বিকল্প নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পড়ালেখার পাশাপাশি দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ‘উদ্বুদ্ধকরা দেশের দুর্দিনে অসহায় দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো, পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি বা পাঠাগার তৈরি করা, বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা, শুদ্ধ উচ্চারণে, উপস্থাপনা ও বক্তব্যে নিজেদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলা, জাতীয় বিশেষ দিবসসমূহে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা ইত্যাদি সৃজনশীল কাজে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে পারলে তারা আর অপকর্মে লিপ্ত হবার সুযোগ পাবে না। একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে দেশ ও জাতির সম্পদে পরিণত হবে শত্রুতে নয়।
তাই মানাবার পাশাপাশি শিক্ষকেরও এ ব্যাপারে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। স্কুলে বা কলেজে ছাত্র-ছাত্রীরা বেশি সময় ব্যয় করে শিক্ষকদের সাথে। সেই সুযোগে উভয়ের মধ্যে গড়ে ওঠে এক আন্তরিক ও হৃদ্যতার সম্পর্ক যা মধুময়। ছাত্র ও শিক্ষকের সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি Alexander ও Aristotle-এর সম্পর্ক। I owe my life to my of other, to Aristotle how to live on. ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অষবীধহফবৎ এর এই উক্তি বেশ প্রযোজ্য বলে মনে হয়। আসলে মা বাবা ও শিক্ষক এরা তিনজন মিলে গড়ে উঠে এক আবর্তিত আত্মীয়তা যেখানে প্রত্যেকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ-“একাকী গায়কের নহে তো গান।” আসলে অভিভাবকের সাথে শিক্ষকরা ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৃজনশীল কাজে অনুপ্রাণিত করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে উন্নতির শীর্ষচূড়ায়। পৃথিবীর ইতিহাস খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, যে জাতি সৃজনশীলতায় যত উন্নত সব দিক দিয়ে সে জাতিই উন্নতির শিখরে অবস্থান করছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জাপান, ফ্রান্স ও চীন- আমরা তাদের দিকে তাকালেই দেখতে পাই উন্নত জাতি হিসেবে তারা সৃজনশীলতার চরম সীমায় অবস্থান করছে। এমন কি গ্রীস, মিশর, পারস্য প্রভৃতি পুরাতন সভ্যতার দিকে তাকালেও আমরা এ সত্য অনুধাবন করতে পারি।
মুসলিম সভ্যতার গৌরবময় যুগের কথা বলা বাহুল্য। এর কথাই বা না বলে থাকছি কেন? মুর, আব্বাসীয়, আটোমান তাদের কথাও বাদ দিই কি করে? এরা সকলেই সৃজনশীলতায় উৎকর্ষ সাধন করেছিল।
স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গতবাঁধা লেখাপাড়ায় সৃজনশীলতার কোন স্পর্শ নাই। সিলেবাসে আছে সৃজনশীল কিন্তু সেখানে সৃজনশীলতার বালাই নেই। আসলে সৃজনশীলতা মানে হচ্ছে প্রত্যেকের ভিতরের সুপ্ত প্রতিভাকে বের করে তা কাজে লাগিয়ে বর্তমান বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোর দিকে ধাবিত করা-যেন তারা অন্ধকার দূর করে আলোর মশাল হাতে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যেতে পারে। আর সময় নেই। এখনো অনেক পথ বাকি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমস্ত কুকর্ম থেকে রক্ষা করতে হবে এবং প্রত্যেকের হাতে সৃজনশীলতার কলম ধরিয়ে দিতে হবে। সৃজনশীলতার মন্ত্রে প্রত্যেককে উজ্জীবিত করতে হবে। যে যার সৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসলে সমস্ত অপকর্ম দূর হয়ে যাবে। দেশ জোর কদমে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের যুব শক্তি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৃজনশীলতার দিকে ধাবিত করার মাধ্যমেই কেবল উন্নয়ন সম্ভব হবে। প্রচুর সম্ভাবনাময়ী এ শক্তিকে সৃজনশীল কাজ কর্মে উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিতে হবে। এমনকি এদের সিলেবাসে ও তা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সৃজনশীল কাজের জন্যে একশত নম্বর বরাদ্দ করতে হবে এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত শিক্ষক রেখে তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আশার বাণী হচ্ছে-শহর অঞ্চলে কিছুটা হলেও যেমন শিশু একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, অনেক নাট্য সংগঠন, আবৃত্তি সংগঠন, অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে যেখানে নিয়মিত শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা চলছে এবং অসংখ্য কর্মী সেখানে নানা রকম সৃজনশীল কাজে আশানুরূপ সফলতা অর্জন করছে। কিন্তু গ্রাম অঞ্চল এখনো সেদিক থেকে অনেক দূরে। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, গোঁড়ামী ইত্যাদি নানা কারণে গ্রাম অনেকটা পিছিয়ে আছে। তাই অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত যুব সমাজের মাঝে তাদের উপযুক্ত মত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে তাদের মাঝে সৃজনশীলতার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই কুচক্রী মহল তাদের প্রচেষ্টার সকল দরজা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। আজ দেশে উন্নয়নের যে জোয়ার বইছে তা ধরে রাখতে হবে এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে আরো বেগমান করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৃজনশীলতার মন্ত্রে সঠিকভাবে পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক : কবি, আবৃত্তিশিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশীতের রূপ ও শৈশব স্মৃতি
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে