দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

নৈতিকতার গিরগিটী রং

মানব সমাজে প্রচলিত নীতিবোধ বিষয়ক এদিকটা তো আগে এভাবে মনে পড়েনি কখনও। মানে ভাবছি মানব সমাজের সেই নীতিবোধ বা নৈতিকতার ধারনাটই যে আদতে গিরগিটী স্বভাবের সেটির কথা! তাও আবার যে সে গিরগিটী না, এক্কেবারে সময় সুযোগ মতো রং বদলাতে পারে যে গিরগিটী, সেই গিরগিটী হল মানুষের নৈতিকতা বোধ। তথাকথিত সভ্যতার প্রাতকাল থেকেই নিজ প্রয়োজন অনুযায়ীই বানিয়েছে মানুষ তার সেই নীতি নৈতিকতার নিক্তিটি! যেমন যুদ্ধের জন্য সে ঠিক করেছে এমন এক নীতি, তাতে যে সব কর্ম যুদ্ধকালীন সময় পায় অবশ্য করণীয় কর্মের ভিত্তি, অন্য সময়ে সমাজে তা হয়ে উঠে চরম অনৈতিক এমন কি আইনগতভাবে অপরাধও।
অবশ্য যুদ্ধের সাথে সে প্রেমকেও জুটিয়েছে সাথে। যার কারণেই কি না হয়েছে সেই ইংরেজি প্রবাদের অবতারণা, ‘এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।’ আচ্ছা চিরকালের বেনিয়া ইংরেজ এই প্রবাদে যুদ্ধের সাথে প্রেম কে ঢোকাল কোন যুক্তিতে? শিল্পবিপ্লবের প্রথম সূচনাকারী দেশ হিসাবে, তাদের পণ্য উৎপাদনের চাকাটি সচল রাখার জন্য যেমন দিকে দিকে তারা ছড়িয়েছে নানান যুদ্ধ, বানিয়েছে কলোনি; আবার সেইসব কলোনিতে তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সমপ্রসারণের জন্য হেন কোন কাজ নেই যা তারা করেনি। অতএব তাদের প্রবাদ তো হওয়া ছিল এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন ট্রেড এন্ড ওয়ার”। কিম্বা ভালবাসা ব্যাপারটাকেও যদি রখাতেই হয় তবে বলা উচিৎ ছিল এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ, ট্রেড এন্ড ওয়ার।
আজও ব্যবসা সমপ্রসারণের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে এক্কেবারে কর্পোরেট পর্যায়ে যে সব কৌশল মানে স্ট্রাটেজি বা ট্যাক্টিঙ নেয়া হয়, তার সবই যে এসেছে বিখ্যাত সব যুদ্ধবাজ সেনাপতিদের , নানান যুদ্ধের কৌশল থেকে, এ তো সর্বজনস্বীকৃত। অতএব যুদ্ধের আর ব্যবসার সফলতার জন্য তো মনে হচ্ছে সবই জায়েজ ! যদিও আজকাল নিজেদের মধ্যে ব্যবসায়িক কামড়াকামড়ি আর যুদ্ধের হানাহানির ঝঞ্ঝাট কমানোর জন্য আবার সেই সভ্যতার শিখণ্ডীরাই যেমন যুদ্ধের জন্য জেনেভা কনভেনশনের অবতারণা করেছে, তেমনি ব্যবসাতেও আনছে নিত্য নতুন নৈতিকতার মোড়ক ; যেগুলো অনেক সময়ই আদতে হয়ে দাঁড়ায় তাদের ব্যবসায়ে জেতারই কৌশলই মাত্র। যেসব কৌশলে একসময়ের ব্যবসায়িক মোগলরা নিজেদের ব্যবসাকে করেছিল সুসংহত, পরবর্তীতে নতুন কোন প্রতিদ্বন্দ্বী যখন সেই একই কৌশল প্রয়োগ করে ভাগ বসাতে চায় তাদের লাভের গুড়ে, তখনই তারা নীতি কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে নীতিনির্ধারকদের দিয়ে, ঐসব কর্মকাণ্ড বা কৌশলকে অনৈতিক, বেআইনি ইত্যাদি সব নানান তকমা লাগিয়ে দেয়।
আচ্ছা স্বর্গ শান্তির চত্বর মানে তিয়েন আন মেন স্কয়ারের এই যে দোজখি ঠাণ্ডা, যার উপর মাঝে মধ্যেই বসে পড়ছে শাঁকের আটি না এক্কেবারে জগদ্দল পাথরেরে মতো কনকনে তার চেয়েও ঢের বেশী হাড়হিম করা বাতাস, তাতে কি মাথার নিউরনে নিউরনে চলমান বৈদ্যুতিক প্রবাহও জমে স্থির হয়ে যায় নাকি? যেমন জমে গিয়েছিল সকালে হাতফোন? আর না হয় স্ট্রাটেজি আর ট্যাক্টিস, এই দুটোরই বাংলা প্রতিশব্দ মনে করতে গিয়ে শুধু কৌশল শব্দটিই মনে পড়ছে কেন? না কি এই দুটোর কোন আলাদা প্রতিশব্দ নেই বাংলায়? আর তা যদি না থাকে তবে, দুটো ইংরেজি শব্দের সঠিক ব্যঞ্জনা কিভাবে আনা যাবে বাংলায়? ইংরেজিতে তো এ দুটো শব্দেরই নিগুঢ় মানে ও ব্যঞ্জনা অনেকটাই আলাদা। নাহ, সম্ভবত তাই হয়েছে। মাথা কাজ করছে না নিশ্চয়ই! আর না হয় আবারো এইমাত্র এখানকার এই হিমকে দোজখি হিম ভাবলাম কেন। দোজখ তো চরম গরম জায়গা।
“বাবা, বাবা তো চলেই এসেছি কাছে। আমি তা হলে ঢুকে যাচ্ছি ঐ বিল্ডিং এ এক্ষুণি” দীপ্রর এ কথায় সম্বিৎ ফিরে কিছু বলতে পারার আগেই দু পাশ থেকে দু পুত্র দিয়েছে ভৌ দৌড় সামনের সেই সুবিশাল ও চমৎকার আধুনিক স্থাপত্যে নকশায় বানানো সেই দালানটির দিকে, যার ভেতরে কি আছে জানি না এখনও। হ্যাঁ প্রায় কাছেই এসে পড়েছি সবাই সেই দালানের। কতোটাই বা দূর হবে এখান থেকে সেটার? হবে হয়তো মিটার পচিশ বা তিরিশ।
এই, এই তোমরা ওখানে গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করো। না হয় তোমাদের যদি আবার হারিয়ে ফেলি। গল উঁচিয়ে পুত্রদের উদ্দেশ্যে এই কথা বলতে বলতে নিজের হাঁটার গতিও বাড়াবো কি না, কিম্বা দেব কি না একটা ভৌ দৌড় ওদেরই মতো? সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম পেছনে। ভাল নেতার নেতৃত্বগুণের সূত্রানুযায়ী, অনুসারীদের বিপদে বা ঝামেলায় ফেলে রেখে নেতার আরাম আয়েশের কথা চিন্তায়ও আনা উচিৎ নয়, এ কথা মানার চেষ্টা করি জ্ঞানত সবসময়েই। তদুপরি ঠেকায় পরে হলেও যদি স্ত্রী কখনো অনুসারি হয়ে পড়ে যদি, তবে তেমন অবস্থায় সজ্ঞানে তো প্রশ্নই ওঠে না অজ্ঞান অবস্থাতেও স্ত্রী কে এই হিমে এইভাবে এই প্রান্তরে পেছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যাবার মতো অপরাধ তো করতে পারি না ভুলেও, অবচেতনেও। এই হিমে আর সব চিন্তাভাবনা জমে গেলেও যেতেই পারে , তবে এই বিষয়ের প্রখর বোধ যে জমে যাবে না, তার প্রমান তো দিলামই এই মাত্র ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে চেয়ে -“অ্যাই অ্যাই, তুমি ওদের ছেড়ে দিলে কেন? থামতে বলো ওদের।“ পায়ের ব্যাথাকে অগ্রাহ্য করে নিজ গতি বাড়াতে বাড়াতে বলে উঠল লাজু। এদিকে হেলেনও হাঁটা বাদ দিয়ে দেখছি জগিং এর ভঙ্গিতে আমাকে পিছু ফেলে এগিয়ে গেল ভাতুস্পুত্রদের দিকে।
আমি তো ওদের ধরেই রাখতে পারিনি। দেখো না দু হাত ঢোকানো আছে দুই পকেটে । অতএব ছাড়লাম আর কই। ঠিক আছে হেলেন এগিয়ে গিয়ে ওদেরকে থামাক, বলতে বলতে লাজুর সাথে তাল মিলিয়ে ওরই গতিতে এগুতে লাগলাম সামনে। এদিকে এতোটা কাছে উষ্ণতার হাতছানি দেখতে পেয়ে ওর গতিও দেখছি বেড়ে গেছে অনেকটাই এরই মধ্যে ।
দু’জনে একদম একসাথে তাল মিলিয়ে পা ফেলে না হলেও অনেকটা একই গতিতে এগুতে এগুতে সামনের দেয়ালে নজর যেতেই চোখে পড়ল, প্রথমে পাঠের অগম্য অতপর তারই নীচে পাঠযোগ্য লেখাটি । হ্যাঁ চায়নিজ লেখার নীচেই গোটা গোটা ইংরেজিতে লেখাটি ঘোষণা করছে যে এটি হল চায়নার জাতীয় মিউজিয়াম।
বাহ! এ তো দেখছি এক্কেবারে গাছে না উঠতেই এক কাঁদি অবস্থা। তিয়েন আন মেন চত্বরে এ জিনিষ পাবো এ তো জানতামই না। আগেই তো বলেছিলাম, সেই যে ছোট বেলায় আব্বার হাত ধরে মিউজিয়ম দেখার পাঠ নিয়েছিলাম, সেই থেকে যে কন জায়গাতে গেলেই সেখানকার মিউজিয়ম দেখার ব্যাপারে মনের ভেতরে একটা প্রবল ইচ্ছা সারাক্ষন আঁকুপাঁকু করে। ফলে এমুহূর্তে অবস্থা তো হয়েছে এক্কেবারে সোনায় সোহাগা! সবাই যখন উষ্ণতার খোঁজে ঢুকতে চাইছে দ্রুত ঐ ঘরে, সেখানেই পেয়ে গেলাম কী না নিজ মনের প্রার্থিত মিউজিয়ম! এমনিতে মিউজিয়মে ঢুকতে কারো আপত্তি থাকলেও এখন তো আর তা হচ্ছে না।
গতির দ্রুততার কারণে এরই মধ্যে দুজনেই পৌঁছে গেছি সামনের জাতীয় জাদুঘরের সদর দরজার সিঁড়ির গোঁড়ায়, যা টপকে বেশ কিছুক্ষণ আগেই উপরে উঠে করিডোরে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে দু পুত্র। হেলেন আছে সিঁড়ির মাঝামাঝি। আর সিঁড়ির গোড়ায় এসে উপরের দিকে উঠার জন্য পা চালানোর গতি বাড়িয়ে দিলাম দু জনেই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে।
ফলে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে পারার কারণে কমে গেল হিমের ধমক। সিঁড়ির উপরের দিকের শেষ মাথার এ জায়গাটা বলা চলে মোটামুটি তিন দিক ঘেরা। অতএব ঠাণ্ডা যা আসছে ওখানে, আসছে তা শুধু সামনের দিকে থেকে তিয়েন আন মেন স্কয়ার থেকেই, বাকী তিন দিকে বাতাসের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সটান দাঁড়িয়ে দেয়াল।
ভাবছি, মিউজিয়মে ঢুকতে হলে তো কাটতে হবে টিকিট। সদর দরজার মুখের এই করিডোরে কোন টিকিট ঘর আছে বলে মনে হচ্ছে না। তা হলে কি কাটতে হবে টিকিট অন্য কোথাও থেকে? তা যদি হয়ই, হবে তা হলে আরেক ঝঞ্ঝাট। আবারো আমাকে ঝাপ দিতে হবে ঐ হিম সাগরে টিকিট কাটার জন্য। আর আছে যে কোথায় সেই টিকিটঘর সেটাই তো জানি না? সে ঘর খুঁজতে গিয়ে কতোক্ষণ যে ফের খাবি খেতে হয় এই হিম সাগরে তাও তো ঠাহর করতে পারছি না ।
“বাবা, বাবা ঐ দরজাটা দিয়ে আমরা ঢুকছি না কেন? এখানেও তো অনেক ঠাণ্ডা” দীপ্র বলে উঠতেই, সাথে সাথেই োর সাথে গলা মেলাল, মা আর ফুফফি।
মিন মিন করে বললাম, না মানে এটা তো মিউজিয়াম। এখান ঢুকতে তো নিশ্চয়ই টিকিট কাটতে হবে , তাই ভাবছিলাম কোত্থেকে কাটতে হবে টিকিট।
“এখানে হয়তো টিকিট কিনতে হবে ঐ দরজা দিয়ে ঢুকে ভেতর থেকে।“ আমার কথার জবাবে দীপ্র এ কথা বলে উঠতেই, মনে হল আরে ঠিকই তো । শুধু শুধু কেন ভাবছি এখানেও টিকিট ঘর আছে ভিন্ন কোনখানে । তা তো নাও হতে পারে। অতএব এগুলাম সেই দরজার দিকে যদিও জানি না, দরজাটি কি বন্ধ ভেতর থেকে? নাকি খোলা? এমন কি কোন গার্ড ফার্ড ও দেখছি না এই দরজার আশেপাশে। অবশ্য থাকলেও যে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে কোন কিছু উদ্ধার করতে পারতাম তা তো নয়। অতএব এ নিয়ে অতো চিন্তা করে লাভ কি?
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে সৃজনশীলতায়
পরবর্তী নিবন্ধ২০২২ এর বাংলাদেশ : সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং মোকাবেলার কৌশল