২০২২ এর বাংলাদেশ : সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং মোকাবেলার কৌশল

ড. নারায়ন বৈদ্য | রবিবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি দেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি পরিচালনা করে সরকার। অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নের জন্য এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকার বার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ বার্ষিক পরিকল্পনার সময়কে বলা হয় আর্থিক বৎসর। আবার আর্থিক বৎসর ও ক্যালেন্ডার বৎসরের মধ্যে পার্থক্য আছে। ক্যালেন্ডার বৎসর হিসাব করা হয় জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। আর আর্থিক বৎসর হিসাব করা হয় বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে। এ আর্থিক বৎসরের ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি দেশ বার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এ বার্ষিক পরিকল্পনায় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় উন্নয়নের জন্য। উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার পরিমাণ এক এক দেশে এক এক রকম হয়। বার্ষিক আর্থিক পরিকল্পনা শুরুর মাসও এক এক দেশে এক এক রকম। যেমন- বাংলাদেশে আর্থিক বাজেটের মেয়াদ হয় ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। চীন, শ্রীলংকা ও ভিয়েতনামের অর্থবছরের ব্যাপ্তি হয় ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ এ দেশগুলো ক্যালেন্ডার ইয়ারকে অনুসরণ করে। ভারতের অর্থবছরের ব্যাপ্তি হয় ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ। যুক্তরাজ্যের অর্থবছরের ব্যাপ্তি হয় ৬ এপ্রিল থেকে ৫ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্রে হয় ১ অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর। পাকিস্তানের ও অষ্ট্রেলিয়ার অর্থবছরের ব্যাপ্তি হয় ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর এবং জাপানের অর্থবছরের ব্যাপ্তি হয় ১ এপ্রিল থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। প্রত্যেক দেশ প্রতিটি অর্থ বছরের ব্যাপ্তিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করে। এ উদ্দেশ্যে আর্থিক বছরের প্রারম্ভে বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। যে সব দেশের আর্থিক বছর শুরু হয়েছে জুলাই ২০২১ মাসে সেসব দেশের অর্ধেক সময় পড়েছে ২০২১ সালে এবং আর অর্ধেক সময় পড়েছে ২০২২ সালে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়কালে প্রথম দুই মাস করোনা কবলিত থাকলেও পরবর্তী চার মাস অনেকাংশে করোনামুক্ত ছিল। ফলে বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছিল দ্রুত। কিন্তু জানুয়ারি ২০২২ এর প্রথমদিকে আবার অমিক্রম (করোনা) নামক এক ভ্যারিয়েন্ট মাথাচড়া দিয়ে উঠে। ফলে বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।
অর্থনীতিতে পূর্ণ নিয়োগ [FULL EMPLOYMENT] বলে একটি শব্দ আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির জনক লর্ড জে, এম, কেইনস বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের সামগ্রিক চাহিদা ও সামগ্রিক জোগান যদি পরস্পর সমান হয় তবে অর্থনীতিতে পূর্ণ নিয়োগ অর্জিত হয়। তিনি আরো বলেন, অর্থনীতিতে পূর্ণ নিয়োগ কখনো
সম্ভব নয়। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে, ভোক্তার আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে ভোক্তার ভোগ ব্যয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ভোক্তার স্বাভাবিক প্রকৃতি এরূপ যে, ভোক্তার আয় যে পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ভোক্তার ভোগ ব্যয় সেই পরিমাণ বৃদ্ধি পায় না। কারণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত আয় থেকে ভোক্তার সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। ফলে প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা (Marginal Propensity to Consume- MPC) এর মান কখনো এক (১) হয় না। MPC এর মান শূন্য অপেক্ষা বড় হয় আবার এক অপেক্ষা ছোট হয়। এ কারণে অর্থনীতি কখনো পূর্ণ নিয়োগস্তরে পৌঁছে না। অর্থনীতিতে অপূর্ণ নিয়োগ (Under Employment) বজায় থাকে। এ অপূর্ণ নিয়োগস্তর বজায় থাকা অবস্থায় পূঁজিবাদী ও মিশ্র অর্থনীতিতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হয়। ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। অবশ্য তা সরকারি হিসেবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যকে যদি সঠিক বলে ধরে নেয়া হয় তবে বলা যায়, ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে এ হার অবশ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এ সময়কালে কোটিপতি মানুষের সংখ্যা বেড়েছে তবুও এ কথা সত্য যে, আয়ের সমবন্টন না হওয়ার কারণে এ সময়ে একশ্রেণির মানুষ ধনী হয়েছে, আর অন্য শ্রেণির মানুষ হয়েছে দরিদ্র। অবশ্য প্রতিটি পুঁজিবাদী ও মিশ্র অর্থনীতিতে পরিপূর্ণ আয়ের সমবন্টন কখনো সম্ভব নয়। তবুও এ কথা বলা যায়, সরকারি নীতি ও কৌশল এ সব কোটিপতিদের এবং আধা কোটিপতিদের আরো অধিক অর্থের মালিক হতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিগত এ দুই বছরে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি। একদিকে দরিদ্র শ্রেণির আয়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির আঘাতে দুর্বল হয়েছে এ শ্রেণি। ফলে বাংলাদেশে বিস্তৃর্ণ এলাকায় বসবাসরত দরিদ্র মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য সরকার এ সত্য উপলব্ধি করে খাদ্য সহায়তা দিলেও ২০২২ আর্থিক বছরে সম্ভাব্য খাদ্যাভাবকে মোকাবেলা করতে হবে। শুধু তাই নয়। বিগত দুই বছরে দারিদ্র্যের হারও ২০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। সরকারের রূপকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে ২০২২ সালের প্রথম থেকে দারিদ্র্যের হার কমানোর জন্য সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু আর্থিক সহায়তা দিলে দারিদ্র্যের হার হ্রাস করা কষ্টকর হবে। বরং একই সাথে বাড়াতে হবে কর্মসংস্থানের হার। গ্রামীণ জনপদে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প সরকারকে হাতে নিতে হবে। অবশ্য এ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার সমগ্র বাংলাদেশে ১০০টি শিল্পাঞ্চল স্থাপন করছে। এ সব শিল্পাঞ্চলে দেশি ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য সরকার প্রচুর সুযোগ সুবিধা প্রদান করছে শিল্পপতিদের। তারপরও সরকারকে সজাগ থাকতে হবে যাতে শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগ সংক্রান্ত কোন ফাঁকি না থাকে। চলতি বছরে সরকারকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। যদি সরকার ২০২২ সালে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সফল হয় তবে একই সাথে বেকারত্ব যেমন হ্রাস পাবে তেমনি দারিদ্র্যের হারও হ্রাস পাবে। দেশে করোনার নতুন ধরন অমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে অর্থনীতিতে ভর্তুকির চাপ আছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রদত্ত প্রণোদনার অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এর ওপর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। তাই করোনার আঘাত কাটিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা বর্তমান সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ এমনভাবে মোকাবেলা করতে হবে যাতে কৃষিখাত ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অর্থাৎ কৃষি খাতের ওপর কোন চাপ তৈরি করা যাবে না। কারণ করোনাকালীন সময়ে অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১ সালে কৃষিই এদেশের জনগণকে পর্যাপ্ত খাদ্যের জোগান দিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, এ সময়ে কৃষিই অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাছাড়া করোনায় যারা পেশা পরিবর্তন করেছে তাঁদেরকে সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। একই সাথে বৈষম্য হ্রাস ও মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর জন্য সরকারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে ছোট ও মাঝারী আকারের কল-কারখানাগুলো। এসব ছোট ও মাঝারী আকারের কারিখানাগুলো এখনও সংকটে আছে। কাঁচামালের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে এ কারখানাগুলোর উৎপাদিত পণ্যের খরচও বাড়ছে। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এসব কারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকারকে রপ্তানি বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য সমন্বিত রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
কোভিডের অভিঘাতে বাংলাদেশে কত মানুষের আয় কমেছে এবং কত মানুষ কাজ হারিয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। এরূপ কোন জরিপ সরকার পরিচালনা করেনি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (WEF) অতি সম্প্রতি ‘বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন-২০২২’ প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে সংস্থাটি বাংলাদেশসহ শতাধিক দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ৪টি ঝুঁকি চিহ্নিত করে। এমন কি পরিবেশগত ঝুঁকির কথাও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিআইজিডি-পিপিআরসি ২০২০ ও ২০২১ সালে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিয়ে ধারাবাহিক জরিপ প্রকাশ করেছে। এ জরিপে দেখা যায়, দেশের অনেক মানুষের আয় কমেছে। অনেক মানুষ আবার তুলনামূলকভাবে উচ্চ দক্ষতার কাছ থেকে নিম্ন দক্ষতার কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি অনেক মানুষ সেই যে কোভিডের শুরুতে ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে গ্রামে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই আর ফেরেনি। ফলে কর্মসংস্থান ও জীবিকার প্রসঙ্গ যে বাংলাদেশের মানুষের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে WEF এর প্রতিবেদনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতির সংকোচন হয়েছে ৩ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২১ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
মহামারির শুরু থেকেই সরবরাহ সংকট দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। ২০২০ সালের তুলনায় পণ্যমূল্য ৩০ শতাংশ বেড়েছে। শুধুমাত্র সরবরাহ সংকটের কারণে সমগ্র বিশ্বে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ এ মুদ্রাস্ফীতি চাহিদা জনিত নয়, বরং সরবরাহ জনিত। এ সংকট ২০২২ সালেও চলবে। অতএব বাংলাদেশের জনগণকে অধিকতর সুখে ও শান্তিতে রাখতে হলে অবশ্যই সরকারকে অধিক সচেতন হতে হবে পূর্ব থেকেই। তবে একটি সুখবর হচ্ছে যে, আইএমএফ সহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা জানিয়েছে যে, এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। তখন এ দেশের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির গতি আরো দ্রুত হবে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধজলাবদ্ধতা নিরসনে যুবরা ভূমিকা রাখতে পারে