ব্রিকসকে হতে হবে বহুমুখী বিশ্বের বাতিঘর : প্রধানমন্ত্রী

নারীদেরকে পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে ৫ দফা প্রস্তাব পেশ

| শুক্রবার , ২৫ আগস্ট, ২০২৩ at ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব অর্থনীতির একচতুর্থাংশের নিয়ন্ত্রণকারী জোট ব্রিকসকে ‘বহুমুখী বিশ্বের বাতিঘর’ হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা এবং বিশ্ব অর্থনীতির একচতুর্থাংশের নিয়ন্ত্রণকারী এই জোটকে সময়ের প্রয়োজন মেটাতে একটি ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম’ হয়ে উঠতে হবে। বাসস জানায়, ব্রিকস সম্মেলনের অংশ হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার জোহানেসবার্গের স্যান্ডটন কনভেনশন সেন্টারে ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে (ব্রিকসআফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ) এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। ব্রিকসের ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’এর সদস্য হিসেবে এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে ভাষণ দেন শেখ হাসিনা। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোসাও এ সংলাপে বক্তব্য দেন। খবর বিডি/বাসসের।

শেখ হাসিনা বলেন, এই বহুমুখী বিশ্বে ব্রিকসকে আমরা একটি বাতিঘর হিসেবে চাই। আমরা আশা করি, এই সময়ের চাহিদা পূরণ করতে ব্রিকস একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আবির্ভূত হবে। আমাদের শিশু ও তরুণদের সামনে আমাদের সেই নজির রাখতে হবে যে, জাতি হিসেবে আমরা হয়ত সংকটে পড়তে পারি, কিন্তু কখনো পরাজিত হই না। ব্রিকস প্লাস ডায়ালগের ফাঁকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি ও ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, উগান্ডার ভাইসপ্রেসিডেন্ট, দক্ষিণ আফ্রিকার উপপ্রধানমন্ত্রী, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুশল বিনিময় হয়। প্রধানমন্ত্রী পঞ্চদশ ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গে আসা রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে একটি ফটোসেশনেও যোগ দেন।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী ও বালিকাদের পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এ লক্ষে পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন। স্যান্ডটন কনভেনশন সেন্টারে ব্রিকস সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজে ভাষণদান কালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্লোবাল সাউথে, আমাদের নারী ও বালিকাদের পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এসডিজি ৫ অর্জনের জন্য আমাদের সকলের হাতে হাত রেখে চলা উচিত। ব্রিকসের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোসা ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে জোহানেসবার্গে আসা রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সম্মানে এ মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন।

কর্মসূচিতে শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের নারী ও বালিকাদের পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি গ্লোবাল সাউথ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রথম প্রস্তাবে বলেন, আমাদের নারী ও মেয়েদের পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলমান খাদ্য, শক্তি ও আর্থিক সংকটের বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, তিনি আমাদের মেয়েদের স্কুলে রাখতে, তাদের সাইবার অপরাধ থেকে সুরক্ষিত রাখতে ও তাদের ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিভাজন কমানোর জন্য প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান। অনেক মেয়েই এই সমস্যার সম্মুখীন হয়। শেখ হাসিনার তৃতীয় প্রস্তাবে নারীদের লাভজনক কর্মসংস্থান, শালীন কাজ, মজুরি সমতা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তাঁর চতুর্থ এবং পঞ্চম প্রস্তাবে, প্রধানমন্ত্রী একটি সক্রিয় ও টেকসই রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য নারীদের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির পাশাপাশি জলবায়ুর প্রভাবের কারণে নারীদের সুরক্ষা ও টিকে থাকার ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীতার ওপর গভীরভাবে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

অন্যদিকে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্লোবাল সাউথে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত পছন্দ ও বিভাজনকে ‘না’ বলা উচিত। সার্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টাকে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের সবাইকে সব ধরনের হুমকি, উসকানি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আমি বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে এসে বিশ্বব্যাপী জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে শান্তি, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।

জলবায়ু ন্যায়বিচার, অভিবাসীদের অধিকার, ডিজিটাল ইক্যুইটি এবং টেকসই ঋণ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সকলকে একসাথে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগসহ নিয়মভিত্তিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা সংরক্ষণ করতে হবে। ব্রিকসের বর্তমান চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার আমন্ত্রণে পঞ্চদশ ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গলবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন।

জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে তার মেয়ে শেখ হাসিনা ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে বলেন, উদীয়মান বিশ্বে আমাদের জন্য, আমাদের ভাগ্য ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে আমাদের নিজেদের সামর্থ্যের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রামাপোসাকে তার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার স্নেহ ও আশীর্বাদ আমি পেয়েছি। সে কারণে আমি দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ব্যক্তিগতভাবে আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫তম বার্ষিকীতে আমাদের উদযাপনে তার (নেলসন ম্যান্ডেলা) যোগদানের কথা আমি স্মরণ করছি।

ম্যান্ডেলার মত বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তার জাতির জন্য ত্যাগের জীবন যাপন করতেন। বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করতে তিনি ১৩ বছরেরও বেশি সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু বর্ণবাদকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে নিন্দা করেন এবং জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া ও ফিলিস্তিনকে উপনিবেশমুক্ত করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার অনুসরণ করে গ্লোবাল সাউথের সাথে আমাদের সংহতি নিশ্চিত করতে আমরা এখানে ব্রিকস আউটরিচে এসেছি। আমরা বিশ্বের সকল জাতির সাথে বন্ধুত্বের মনোভাব বজায় রাখি, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং জলবায়ু সংকট থেকে আমরা যে শিক্ষা পেয়েছি, তা হল সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই নিরাপদ নই। মিয়ানমারের ১২ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে বসবাস করার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আফ্রিকায় শরণার্থীআশ্রয়দানকারী দেশগুলো এর ভার বুঝতে পারেন। আমরা আফ্রিকা মহাদেশের সাথে খাদ্য উৎপাদন, সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের বিষয়ে আমাদের দক্ষতা ভাগ করে নিতে প্রস্তুত।

তিনি বলেন, আমরা সন্ত্রাসবাদ, মানব পাচার, সাইবারঅপরাধ এবং মানি লন্ডারিং মোকাবেলায় সহযোগিতা বাড়াতে পারি। পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে উন্নীত করার জন্য আমাদের আকাশ ও সামুদ্রিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের থিম্যাটিক অ্যাম্বাসেডর এবং অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবি শিক্ষককে শোকজ
পরবর্তী নিবন্ধমহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে