বেশি মজুরি তত্ত্বে অর্থনীতির নোবেল ২০২১

শঙ্কর প্রসাদ দে | রবিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ

ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির বক্তব্য হলো, মজুরি বাড়লে শ্রমিক চাকুরি হারাবে। এবারের নোবেল পাওয়া তিন অর্থনীতিবিদ এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেছেন তথ্য উপাত্ত দিয়ে। ডেভিড কার্ড কানাডীয় বংশোদ্ভুত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গত তিন দশক ধরে তিনি মূলত অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে বৃটেন ও আমেরিকায় যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেটির উপর গবেষণা করেছেন। ই ইউ’র অন্য দেশগুলো থেকে অভিবাসী শ্রমিকরা সত্যিই কি ব্রিটিশ নাগরিকদের বেকারত্ব বৃদ্ধির প্রধান কারন? দ্বিতীয়ত আমেরিকান শ্রম বাজারের তথ্য সংগ্রহ করে দেখতে চেয়েছেন গোটা পৃথিবী থেকে অভিবাসী শ্রমশক্তি এনে আমেরিকা কি নিজ জনগণের প্রতি অবিচার করছে?
ই ইউ’র অভিবাসী শ্রমিকদের কারনে বৃটেনের নাগরিকরা চাকুরি পাচ্ছে না, এই বক্তব্য গত দু’দশক বৃটেনের রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ডেভিট ক্যামেরন ই ইউ থেকে বের হতে রাজী ছিলেন না। গণভোটে তাঁর মত পরাজিত হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন এরপর টেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হলেন এই বলে যে তিনি মাঝামাঝি একটা সমাধান আনতে পারবেন। সেটিও প্রত্যাখ্যাত হল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস ডানসন বললেন, বৃটেনকে ই ইউ থেকে বের করবেন’ই। তোপের মুখে, টেরিসা মে পদত্যাগ করার পর জনসন সত্যিই বৃটেনকে ই ইউ থেকে বের করে আনলেন।
একই জাতীয় বক্তব্য নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমেরিকা আমাদের। গোটা পৃথিবী থেকে আমেরিকায় মানুষ ঢুকতে দেয়ার দরকার নেই। তিনি বিদেশীদের নতুনভাবে নাগরিকত্ব দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
শক্তিশালী এই দু’টি দেশের রক্ষণশীল এই নীতির মূল বক্তব্য ছিল অভিবাসী লোকজন ঢুকে পড়ায় দেশের মানুষ চাকুরী পায় না। ডেভিড কার্ড তথ্য হাজির করে দেখালেন, অভিবাসী শ্রমিকরা ছোট খাট চাকুরীতে ঢুকার ফলে দেশের জনগণ ভাল চাকুরীগুলোতে ঢুকার সুযোগ পায়। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল, শ্রমিকদের বেতন বাড়ালে অনেকে চাকুরী হারাবে এটা ভুল কথা। তথ্য হাজির করে বললেন, বেতন বাড়ালে শ্রমিক কাজে আগ্রহী হয়, দক্ষতা বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে, মজুরি বাড়ালে শিল্পপতিরা নতুন নতুন শিল্পস্থাপনের সুযোগ পায়। এতে অর্থনীতি আরো চাঙ্গা হয়। ক্লাসিকাল অর্থনীতিকে গুড়িয়ে দেয়া এই তত্বের জন্য ডেভিড কার্ডকে যথাযথ সম্মান দেয়া হয়েছে। বেশী মজুরী ও অভিবাসী শ্রমিকের পর তাঁর তৃতীয় বক্তব্য ছিল, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন মানুষকে বেশী দক্ষ করে না অভিজ্ঞতা বেশী দক্ষ করে। পৃথিবীব্যাপী সরকারগুলো টেকনিক্যাল শিক্ষার উপর যে হারে গুরুত্ব দিচ্ছে, ডেভিড কার্ডের বক্তব্য এক্ষেত্রে একটি সুষ্পষ্ঠ বক্তব্য হাজির করেছে। টেকনিক্যাল শিক্ষা ন্যূনতম হলেই যথেষ্ঠ। ন্যূনতম শিক্ষার পর জনশক্তিকে চাকুরিতে ছেড়ে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। ৫ বছর লেখাপড়া করে একজন মানুষ যা শেখে, ১ বছর সরাসরি কাজ করে একই লোক অধিকতর দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এই তত্ত্বটি গোটা পৃথিবীর সাধারণ শিক্ষা, টেকনিক্যাল শিক্ষা ও শ্রম বাজারের জন্য একটি যুৎসই নতুন চিন্তা।
ডেভিড কার্ডের এই চিন্তাকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন, দুই বন্ধু অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্স। এরা অর্থনীতিকে সমাজ বিজ্ঞানের টেবিলে রেখে শ্রম বাজার ব্যাখা করেছেন। হঠাৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যুদ্ধ বিগ্রহ, এথনিক ক্লিঞ্জিং সহ বিভিন্ন কারনে একটি বড় জনগোষ্ঠী যখন অন্য কোন দেশে রিফিউজি হয়, তখন ঐ দেশের শ্রমবাজার কেমন হবে? এর ভাল উদাহরণ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। তাদেরকে আমরা রীতিমতো বেড়া দিয়ে আটকিয়ে রেখেছি। মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এদেরকে বসে বসে না খাইয়ে শ্রম বাজারে কি দেওয়া যায় না? ফিলিস্তিন, সিরিয়া সহ বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বাস্তু হওয়া রিফিউজিরা কি আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য বোঝা? এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর খুঁেজছেন দুই বন্ধু দুই দশক ধরে। তাঁরা দেখেছেন উদ্বাস্তু শ্রমিকরা উদ্বাস্তু হওয়ার পেছনের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। দেখা গেছে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণেই কোন দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। এমনকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও ঘটে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতির কারণে। উদাহরণতো সামনেই আছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফগান সংকট সৃষ্টির পেছনে রাশিয়া আমেরিকার অর্থনৈতিক সামরিক দাবা খেলাই মূলত দায়ী। রোহিঙ্গা সংকটতো প্রতিদিন দেখছি আর ভুগছি। অথচ চীন আর ভারত যদি মিয়ানমারকে বলে, রোহিঙ্গাদের আজই নাগরিকত্ব দিয়ে সসম্মানে ফিরিয়ে নাও, তবে দেখবেন কাল থেকে ফেরৎ নেয়া শুরু হয়ে গেছে।
অ্যাংগ্রিট ও ইমবেন্সের বক্তব্য নিতান্তই শ্রমবাজার কেন্দ্রিক। তারা দেখাতে চেয়েছেন উদ্বাস্তুদের চাকুরি দিলে দেশের মানুষ কি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? দুই বন্ধু বলেছেন, এখানে অর্থনীতির চেয়ে সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্ব বেশী। যখন, একটি জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু হবে, সে যে দেশেই হাজির হোক, শ্রম বাজারে তাদের ঢুকতে দিতেই হবে।
এরপর দুইবন্ধু উদ্বাস্তুদের স্থাপন করেছেন ডেভিড কার্ডের মজুরি তত্বের ছকে। সোজা কথায় উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ দিলে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিই কার্যত শক্তিশালী হবে। উদ্বাস্তু শ্রমিক এমন কিছু পরিশ্রমি কাজ করতে রাজি হয় যা নিজ দেশের মানুষ করতে আগ্রহী হয় না। আমি নিজে ইউরোপের যে কটি দেশের হোটেলে ছিলাম, দেখেছি ক্লিনারগুলো সব আফ্রিকা, সিরিয়া, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হওয়া শ্রমিক। দেখেছি রোম আর প্যারিসে আসা বাঙালি আর পাকিস্তানী যুবকদের শতকরা আশি ভাগই ট্যাঙি চালায়। আমার কয়েকজন বন্ধু আমেরিকায় ট্যাঙি চালায়। আমেরিকান আর ইউরোপিয়ানদের এখন আর এমন ছোটখাট কাজ ভাল লাগে না। একটি নতুন চিন্তাকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য তিনজনকে যৌথভাবে অর্থনীতির ২০২১ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের সাগরের মাঝখানে বেকার না রেখে কর্মে লাগানোর চিন্তা করার সময় এসেছে। ফেরৎ যখন যাবার যাবে। যদ্দিন এখানে থাকবে তদ্দিন কুটির শিল্প, মৎস্য চাষ, সব্জি চাষ, লবণ চাষ, চিংড়ি ঘের, পশুপালন সহ উৎপাদনমুখী কাজে এদের লাগানো উচিত। এরা কাজ করবে। উৎপাদন করবে, আয় করবে। আমাদের অর্থনীতিরতো তাতে ক্ষতি নেই। জানি না আমাদের নীতি নির্ধারক অর্থনীতিবিদরা ডেভিড কার্ডের বক্তব্যকে আমলে নেবেন কি না?
লেখক : অর্থশাস্ত্রের প্রাক্তন প্রভাষক, কাটিরহাট
মহিলা কলেজ; আইনজীবী, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাশ বন পূর্বাচল
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে