দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

গ্লোভস খুঁজে না পাওয়ার ছোট পুত্রের হাহাকার কর্নকুহুরে ডংকা বাজিয়ে দিতেই , তড়িঘড়ি জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে হাতফোন বের করে লি খাঁকে ডাকার জন্য ফোন হাতে নিয়ে তার পর্দায় চোখ রাখতেই , এরকম ঘোরতর ঠাণ্ডায়ও মেরুদণ্ড বেয়ে নীচে নেমে গেল এক শীতলতম উদ্বেগ, ভয়, দুর্ভাবনা নাকি আতঙ্কের সুনামি!
হাতফোনটি দেখছি পরিণত হয়েছে এ মুহূর্তে মৃত লাশে! প্রতিনিয়ত ব্যবহার করা থেকে শুরু করে, কালেভদ্রে ব্যবহার করা এমনকি কখনো একেবারেই ব্যবহার না করা নানান রঙ্গয়ের আর ঢঙ্গয়ের “অ্যাপ” নামের ডিজিটাল পণ্যে আকীর্ণ এর ঝলমলে পর্দাটির চেহারা হয়েছে ধোঁয়াশায় ঢাকা , খা খা তেপান্তর তিয়েন আন মেন স্কয়ারের মতো। অথচ এটিতেই তো অতি সতর্কতায় জমা করে রেখেছিলাম এই তুষারহিমরাজ্যে আমাদের বিনা তারের লাইফলাইন, মানে লি খাঁর টেলিফোন নম্বর! যার গাড়িকে মনে মনে ইতোমধ্যে বানিয়ে রেখেছি বেইজক্যাম্প। বাড়তি কমিশনের ধান্দায়এই স্বল্পদুরুত্ব পাড়ি দেবার জন্য মিস ইনা ছলনায় ভুলিয়ে, যতোই ধরিয়ে দিয়ে থাকুক না কেন, ভাষাবিভ্রাটের মূর্তিমান চায়নিজ স্মারক লি খাঁকে, তারপরও এই তেপান্তরে সেই-ই তো আমাদের একমাত্র ভরসা ও পথ প্রদর্শক। হবে কি এখন তবে?
একদৃষ্টিতে মৃত ফোনের পর্দায় উদ্বেগচঞ্চল হতাশ চোখ রেখে, দ্রুত চাপচাপি করতে থাকলাম ওইটির ডান আর বা দিকের কানের কাছে থাকা সুইচের বোতামগুলো, যদিবা ফেরে প্রান তাতে তার কিছুটা হলেও আর ভেসে উঠে পৃথিবীকে বদলে দেয়া তিন আপেলের, তিন নম্বর আপেলটির চেহারা, যেটি নাকি আবার একটুখানি খাওয়া। নীরব ত্রস্ততায় আঙুলে সেই বোতামগুলো চাপলেও মনের মধ্যে চলছে ঐ রকম চাপাচাপি, যেরকমটা করে দু হাতে, হঠাৎ করে থেমে যাওয়া কোন রোগীর হৃদপিণ্ড কে চালু করার চেষ্টায় ডাক্তার বা প্যারামেডিঙরা। নাহ কাজ হল না কোন তাতেও! হাতফোনের অন্ধকার পর্দা নিরাবেগ তার নিস্প্রাণ মুখব্যাদান করে চুপ করেই থাকল; দেখা নেই সেই স্টিভ জবসের দেয়া একটুখানি খাওয়া আপেল!
আচ্ছা হলোটা কি এই ফোনের? এরকম যন্ত্রণায় তো ইহজনমে না হলেও, যতদিন এই ফোন ব্যাবহার করছি, তার কোনদিনই পড়িনি। হল কেন এটার এরকম অবস্থা? কোন ধরনের যন্ত্রেরই যন্ত্রবিশারদ না হয়েও প্রথমেই যে আশংকা জাগল মনে, তা হল এর চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু হবে কেন তা? মনে পড়ে গত সারারাতই তো এটিকে চার্জ নেবার জন্য লাগিয়ে রেখেছিলাম, বিছানার পাশটেবিলের উপরে লাগানো প্লাগ পয়েন্টে।
“বাবা, আমার গ্লোভস” এসময় ফের অভ্রর এই আর্তনাদ কানে যেতেই, তড়িঘড়ি নিজের হাত মোজাগুলো খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, বাবা আপাতত এগুলো পড়ে নাও। আর সবাইকে বললাম চলো আগে বাড়ি , ঐ টিকিট ঘরের দিকে। এই ঠাণ্ডায় এখানে দাঁড়িয়ে বাতাসের ঝাপটায় কাবু হওয়ার মানে নেই । ইচ্ছে করেই কাউকে ফোন বিষয়ক দুর্ঘটনার কথা আর জানালাম না। কি লাভ ওতে? আমার একার দুর্ভাবনা উদ্বেগ সবার মধ্যে বিলিয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বরং বেশী হবে। তারচে বরং আমাদের সমাজে প্রচলিত কথা “যত মুশকিল তত আসান” এই কথার উপর পরিপূর্ণ আস্থা রেখে পা বাড়ালাম সবার পিছু পিছু , টিকিট ঘরের দিকে একটু, উষ্ণতার খোঁজে।
এদিকে টিকিট ঘরের দিকে আগুয়ান হওয়ার ঘোষণা মুখ থেকে বেরুবার সাথেসাথেই এতক্ষনে হিমে জমে স্থানু হয়ে যাওয়া সবাই সচল হয়ে উঠেছিল দ্রুত। এ মুহূর্তে সবার আগে আগে কিছুটা দৌড়ের ভঙ্গিতে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী হিমপ্রতিরক্ষা বলয় ধারন করা হেলেন। তার ঠিক পিছনেই দীপ্র। পায়ের ব্যথার কারণে জোরে হাঁটতে অপারগ লাজু এরই মধ্যে বেশ পিছিয়ে পড়েছে দলের অগ্রবর্তী দুজনের থেকে। আমার কাছ থেকে পাওয়া বড় সাইজের দস্তানাযুগলে নিজের দুহাত ঠিকমতো চালান করার কসরত করতে করতে হাঁটছে অভ্র মায়ের পাশাপাশি।
যদিও ঢাকার বংগবাজার থেকে কেনা আমার দস্তানাযুগল এখানে নিতান্তই অকার্যকর মনে হয়েছিল, নিজ হাতে দেবার পর, তারপরও এই মুহূর্তে সেই অকার্যকর দস্তানা হারিয়ে, এই ঠাণ্ডায় নিজের হাতের ভেতরের হাড়ও মনে হল মুরমুর করে ভেঙ্গে না গেলেও, হাড় ভাঙার ব্যথাটুকু জানান দিতে লাগল সর্বক্ষণ। দ্রুত তাই সমর্পণ করলাম তাদের জ্যাকেটের পকেটের উষ্ণতায়। অবশ্য তার আগে হাতে ধরা ফোনলাশটিকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম প্যান্টের পকেটে। হাঁটছি এখন লাজুর সাথে পা মিলিয়ে নিজের স্বাভাবিক গতির চেয়ে ঢের কম গতিতে। লাগে লাগুক যতই ঠাণ্ডা, এ মুহূর্তে স্ত্রী কে পিছু ফেলে এগিয়ে যাওয়ার মতো নিষ্ঠুর স্বামী এ ধরাধামে আছে বলে মনে হয় না।
“এই ছেলেটা কে নিয়ে আর পারা গেল না। গাড়িতে যতই বললাম হাতে গ্লোভস পড়ে নাও , শুনলা না। এখন বাবাকে দিচ্ছ কষ্ট” লাজুর মুখ নিসৃত তীব্র উষ্মার তোড়ে পিছু ফিরে তাকাল অভ্র, আমার দিকে। হিমভয়ে পকেট থেকে হাত বের করে ওকে আশ্বস্ত করার বদলে মাথা নাড়িয়ে বললাম, বাবা অসুবিধা নাই। ওগুলোতে হাত ফিট না করলেও হাত গলিয়ে হাতগুলো ফের জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে নাও।
মায়ের তিরষ্কারের তোপের মুখে থাকা অভ্রকে সাহস যোগানের সাথে সাথেই মনে পড়লো, কুনমিং হোটেলের সেই লিফট বিভ্রাটে নাকাল হওয়া অভ্রর মুখনিসৃত প্রবাদের মতো সেই কথা, ‘ওয়ান ক্যান্ট এঙপেক্ট বেটার দেন দিস, ফ্রম এ চায়নিজ মেশিন ওর কোম্পানি!’ এ কথা মনে হতেই মনে মনে পেয়ে গেলাম একটু আগে প্রত্যক্ষ করা আমার ফোনের মৃতাবস্থাটির কার্যকারণ। প্রথমেই মনে হল বিছানার পাশটেবিলে সারারাত ফোনটিকে প্লাগপয়েন্টে আটকে প্লাগ থেকে ফোনের ভেতর জিয়নরস টেনে নেবার জন্য শুইয়ে রাখলেও, খোদ ঐ প্লাগ পয়েন্টটিই যে ঠিক ছিল তা কি দেখেছিলাম পরখ করে?
মনে পড়ল নাহ, দেখেছিলাম ওটা ঠিকই। কারণ চোখের সামনেই ফের দেখতে পেলাম রাতের দৃশ্যটি। আমাদের দেশের বাজার তো চায়নিজ পণ্যে ঠাসা। অতএব ঘরে বাইরে যেখানেই ফোন চার্জে দেই না কেন, এটা অভ্যাস হয়ে গেছে যে, প্লাগ পয়েন্টে ফোন চার্জ করার জন্য তার লাগানোর পর, প্রতিবারই ফোনের ডানদিকের উপরের কোনায় যে ব্যাটারির চিহ্ন আছে, তাতে চোখ রাখি; নিশ্চিত হবার জন্য যে লুজ কানেকশন জাতীয় কারনে যেন, ফোন চার্জ বঞ্চিত না হয়। দেশের সেই অভ্যাস চর্চার কারনে বিছানায় শুয়ে যতই তড়িঘড়ি করে ফোনকে প্লাগ পয়েন্টে যুক্ত করি না কেন , এর সাথে সাথে , ফোনের ঐ ব্যাটারিটির সবুজ রং ধারন করা দেখে আর তার উপর ডানদিকে কাত করা “দ” চিহ্নের মতো বৈদ্যুতিক প্রবাহের চিহ্ন দেখে নিশ্চিত হয়ে ঘুমানোর আয়োজনে চোখ মুদেছিলাম।
তার মানে হতে পারে, ঐ মুহূর্তে ফোন ঠিকঠিক চার্জ পেলেও পরে হয়তো কোন কারনে লুজ কানেকশনের ফেরে পরে , সারারাত আর সে কোন চার্জ পায়নি। কিন্তু চার্জ না পেলেও কি ? আমি তো একদম চার্জ নিঃশেষ হওয়ার পর সেটিকে চার্জ করতে দেইনি যে সকালে এটি এক্কেবারে চার্জশুন্য ফোকলা হয়ে যাবে। আর হোটেল থেকে গাড়ি ছাড়ার আগ মুহূর্তেই তো ফোনে লি খাঁর নম্বর ঢুকিয়ে তাকে কল দিয়েছিলাম। তারপর তো আর কোন কিছুই করিনি ফোন দিয়ে, সামান্য হলেও তো চার্জ থাকার কথা!
আচ্ছা এই ফোনটি আমার যতোই হউক আম্রিকান বংশের, এটি ও তো নিশ্চয় তৈরি হয়েছে এই চায়নাতেই। এই কারনেই কি অভ্র উচ্চারিত সেই প্রবাদসম বাক্যটিকে প্রমানিত করার মানসে, নিজ জন্মস্থানে এসে সে আজ বিগড়ে গেছে? এ কেমন কথা হল, তাহলে? তার তো বরং নিজ বাপের বাড়ীতে এসে আরও ভালভাবে সার্ভিস দেয়ার কথা! তা না করে এরকম গড়বড় করে তার বাপের বাড়ির মর্যাদাহানি করার ভূত চাপল কেন তার মাথায়? ঘটনা কি তা হলে এরকম, যেরকম হতো আমাদের দেশে একসময়, অসময়ে বাল্যকালে বিয়ে হয়ে যাওয়া বালিকা বধূদের ক্ষেত্রে!
নাহ ওরকম কিছু চোখে দেখেনি নিজে। তবে নানান বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কোন কোন লেখায় পড়েছি ঐরকম বালিকাবধূরা, বিয়ে হয়ে যাবার অনেকদিন পর বাপের বাড়ি ফিরেই, সাথে আসা স্বামী বা স্বামীর বাড়ির মহাগুরুতবপূর্নদের পিছু ফেলে হঠাৎ প্রগলভ হয়ে, দৌড়ে তারা চলে যেত নিজের পুতুল খেলার ঘরে; কিম্বা দুদ্দাড় উঠে যেত বাড়ির পেয়ারা গাছে! কিম্বা করতো মা বাবা ভাই বোনদের প্রতি প্রবল অভিমানে মুখ বন্ধ করে স্পিকটি নট হয়ে যেত, তেমনি কি আমার পকেটস্থ ফোনও তার জন্মস্থানে এসে ঐ রকম প্রগলভতার কারনেই কি সে হঠাত করেছে অভিমান?
“বাবা তাড়াতাড়ি যাও টিকিট করতে” ঐসব ভাবনায় সাঁতরাতে সাঁতরাতে এ মুহূর্তে টিকিট ঘরের বারান্দায় এসে পা রাখতেই দীপ্রর এই তাগাদায় বোঝা গেল, ঢুকে পড়তে চায় ও দ্রুত কোন ঘরে। এখানে এই খোলা বারান্দায় হিম বাতাসের ঝাপ্টা গায়ে তেমন না লাগলেও, ঠাণ্ডার কমতি তো নেই।
দ্বিরুক্তি না করে দ্রুত এগুলাম টিকিট কাটার কাউন্টারের দিকে। মজার ব্যাপার হল এতোক্ষণ বাইরে কোন জনমানিষ্যির টিকিটিরও দেখা না পেয়ে ভেবেছিলাম টিকিট ঘরও বুঝি শুন্য থাকবে, মানে থাকবে না এখানে কোন দর্শনার্থী ।
কিন্তু এ মুহূর্তে এক কাউন্টার থেকে তিনজনের একদলকে টিকিট নিয়ে ফিরতে দেখে, আরেক কাউন্টারে আরেকজনকে টিকিট কাটতে দিতে বাকী জনা পাঁচেককে পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখে ভাঙল সে ভুল আমার। ভাবলাম আচ্ছা এলো এরা কোন দিক দিয়ে? আমরা না হয় বাঙ্গাল এসেছি বহুদূর থেকে দু চার দিনের জন্য, না হয় এইরকম আবহাওয়ায় তো মোটেও বেরুতাম না ঘর থেকে সবাইকে নিয়ে এরকমভাবে নাকাল হওয়ার জন্য। এরা তো সব চায়নিজ, এরা বেরুলো কোন দুঃখে বা আনন্দে। অবশ্য চায়নিজ হলেও ওরা নিশ্চয় বেইজিংবাসি নয়। বেইজিং হয়তো এসেছে হঠাত করেই জীবনে প্রথম, তাই চলে এসেছে। আর এই ঠাণ্ডা আমাদের কাছে ভয়াবহ মনে হলেও এদের তো মনে হয় এটা গা সহা, অতএব বেরুবে না কেন? কাচের দেয়ালের ওপাশে বসে থাকা টিকিট কাউন্টারের লোকটিকে দেখে আন্দাজ করতে পারলাম না কতো হবে তার বয়স। বলতে পারেন বয়স আন্দাজ করার কি দরকার, আমি তো কোন পাত্র দেখতে যাইনি যে, তার বয়স আন্দাজ করতে হবে। না তা নয়, তারপরও বয়স আন্দাজ করতে চাওয়ার একটা কার্যকারণ আছে মনের ভেতরে অবচেতনে। সেই অবচেতন মনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত কম বয়সের চায়নিজরা একটু আধটু হলেও ইংরেজি বলতে পারে, আর বেশী বয়সীদের অবস্থা হল গতরাতের সেই মুদি দোকানির মতো খাম্বাবৎ। কপাল খুব ভাল হলে সে হতে পারে খুব জোর আমাদের লি খাঁর মতো।
হাতের পাঁচ দেখিয়ে, মানিব্যাগ থেকে তিনটা পঞ্চাশ রেন মেন বির নোট হাতের মুঠোতে নিয়ে, ঐ কাচের দেয়ালের নীচের দিকের মাঝামাঝি জায়গায় যে অর্ধ বৃত্তাকার খোপটি আছে তার ভেতর দিয়ে হাত চালান করে দিয়ে, খাঁটি বাংলায় বললাম দেখি তো চাচা , দেন তো টিকিট পাঁচটা। কপাল ভাল যে টিকিট ঘরের সামনে এক জায়গায় লাল রঙ্গয়ের কালিতে বড় করে লেখা দেখাছিলাম ৩০, সাথে রেন মেন বি র সঙ্কেত। তা থেকেই ধরে নিয়েছি গ্রেট হলে ঢুকতে জনপ্রতি ঐ তিরিশ করে মোট গুনতে হবে ১৫০ রেন মেন বি। লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেশি মজুরি তত্ত্বে অর্থনীতির নোবেল ২০২১
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকৃত বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে হবে