বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্য পৌঁছানোর উদ্যোগ নেই

আলম খোরশেদ | শুক্রবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৯:৫৭ পূর্বাহ্ণ

বছর অনুবাদে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া আলম খোরশেদের জন্ম ১৯৬০ সালে, কুমিল্লায়। বুয়েটের যন্ত্রকৌশল থেকে পাস করে বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করেছিলেন কিছুদিন। এরপর চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। কানাডায় বসবাস করলেও আবার ফিরে আসেন দেশে। দেশে ফিরে প্রথমে বিশদ বাঙলা ও পরে বিস্তার আর্ট কমপ্লেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জাদুবাস্তবতার গাথা: লাতিন আমেরিকান ছোটগল্প সংকলন, বোর্হেসের সঙ্গে কথোপকথন: ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, নিজের একটি কামরা: ভার্জিনিয়া উল্‌ফ, ত্রিশটি কবিতা: নোবেলবিজয়ী ভিস্লাভা শিমবর্স্কা, নাগিব, বোর্হেস, চিনুয়া, মার্কেস ও অন্যান্যের গল্প, দ্বাদশ কাহিনি: সমকালীন বিশ্বের গল্প, দা জাগুয়ার স্মাইল: সালমান রুশদি তাঁর অন্যতম অনুবাদ গ্রন্থ। বর্তমানে পূর্ণকালীন লেখক। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ মুনির।

আহমেদ মুনির: বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন। আমরা শুনেছি, বাংলা একাডেমির একটি অনুবাদ প্রকল্প আছে। এক সময় কিছু ভালো বই অনূদিত হলেও এখন তেমন কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ভারতে যেমন আদান প্রদান সিরিজে সেদেশের আকাদেমি প্রচুর বই অনুবাদ করেছে তার তুলনায় বাংলা একাডেমির কাজ উল্লেখযোগ্য বলার উপায় নেই। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। আপনার ভাবনা জানতে চাই।

আলম খোরশেদ: আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক। তবে এব্যাপারে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারবেন। আমার জানামতে বাংলা একাডেমিতে অনুবাদের জন্য আলাদা কোনো পূর্ণাঙ্গ বিভাগ নেই। একটি উপবিভাগের আওতায় তার সীমিত বাজেটে বছরে দুই তিনটা অনুবাদের বই যা বার হওয়ার তাই হয়, এর বেশি নয়। তবে স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী অনুবাদ প্রকল্প চালু হওয়ার কথা শুনে আসছি আমরাও বেশ কয়েক বছর হল। কিন্তু তার অধীনে আদৌ কোনো কাজ শুরু হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সম্ভবত আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আলোর মুখ দেখার সুযোগ কিংবা সৌভাগ্য হয়নি তার অদ্যাবধি।

আহমেদ মুনির: আপনার প্রথম প্রকাশিত বইতো ‘জাদুবাস্তবতার গাথা : লাতিন আমেরিকান ছোটগল্প সংকলন’। লেখালেখির শুরুটা অনুবাদ দিয়েই কেন হলো? পটভূমি ব্যাখ্যা করুন।

আলম খোরশেদ: লেখালেখির শুরুটা অনুবাদ দিয়ে হয়নি। হয়েছিল যথারীতি কবিতা দিয়েই। একসময় কবি হিসেবেই আমার প্রধান পরিচয় ছিল দেশে। পাশাপাশি প্রবন্ধ ও গ্রন্থালোচনা ছিল আমার সাহিত্যচর্চার অপর প্রধান ক্ষেত্র। পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের অনুরোধে টুকটাক গল্প কবিতার অনুবাদও করে দিতাম অবশ্য। তবে ১৯৮৭ সালে উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর পরিবর্তিত বাস্তবতায় অনুবাদই হয়ে ওঠে আমার প্রধান ক্ষেত্র। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম বইটিই ছিল একখানা অনুবাদগ্রন্থ; ‘জাদুবাস্তবতার গাথা : লাতিন আমেরিকান ছোটগল্প সংকলন’।

আহমেদ মুনির: আপনি হেনরি মিলার, ভার্জিনিয়া উলফ, সালমান রুশদিসহ অনেক বিখ্যাত লেখকের বই অনুবাদ করেছেন। করেছেন কবিতার অনুবাদও। এদের মধ্যে কার বা কাদের লেখা আপনাকে টানে?

আলম খোরশেদ: টানে তো সবার লেখাই, আর সেজন্যই এদের অনুবাদ করা। তবে উল্লিখিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও দুরূহ ছিল নিঃসন্দেহে ভার্জিনিয়া উলফের ‘আ রুম অভ ওয়ানস অউন’ বইটি অনুবাদের কাজ। আর সেজন্যই সম্ভবত সবচেয়ে উপভোগও করেছি এর অনুবাদ প্রক্রিয়াটি। শত হলেও আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের একটি অতুলনীয় মৌলিক ও পথপ্রদর্শক সমালোচনা সাহিত্যের নিদর্শন এবং চিন্তামূলক সাহিত্যে চেতনাপ্রবাহরীতির প্রয়োগেরও পথিকৃৎতুল্য অনন্য দৃষ্টান্ত এটি।

আহমেদ মুনির: বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ প্রসঙ্গে আসি। উপমহাদেশের অনেক ভাষাভাষী লেখক অনুবাদের মধ্য দিয়ে বিশ্বে পরিচিত হয়েছেন। উর্দু সাহিত্যিক ইনতেজার হোসেনের কথাই ধরা যাক। তিনি সমকালীন বিশ্বে বেশ পঠিত। অথচ তার তুলনায় বাংলা ভাষার লেখকদের লেখা অবহেলিতই থেকে গেল। এটা কেন?

আলম খোরশেদ: এর অনেকগুলো কারণ। প্রথম কারণ অবশ্যই এর জন্য প্রয়োজনীয় সুদক্ষ, সমকালীন ইংরেজিতে পারদর্শী এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগসক্ষম ও সমৃদ্ধ অনুবাদকদের অপ্রতুলতা। দ্বিতীয় কারণ, এই ধরনের কাজের জন্য একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ, আয়োজন, সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন, যার অভাব অত্যন্ত প্রকট আমাদের দেশে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত এই কাজে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে আসা, কিন্তু সেটা আর হচ্ছে কই। এছাড়া আমাদের প্রধান প্রধান প্রকাশকদেরও উচিত এই কাজে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করা। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন, সদিচ্ছা, সামর্থ্য, সক্ষমতা সর্বোপরি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও বিপণন ব্যবস্থা বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কোনোটাই রয়েছে বলে মনে হয় না। এর ফল, যা হবার তই হয়েছে। ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগে যে গুটিকয়েক কাজ হচ্ছে তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে আর যাই হোক বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ববাজারে এবং বৈশ্বিক পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়া সেভাবে সম্ভব নয়।

আহমেদ মুনির: বাংলা ভাষার সুঅনুবাদকদের কারা আপনার পছন্দের। এদের কোন কোন কাজকে এগিয়ে রাখবেন?

আলম খোরশেদ: এই প্রশ্নের উত্তরটা আপাতত দিতে চাচ্ছি না মুনির।

আহমেদ মুনির: আপনি অনেককাল প্রবাসে ছিলেন। ফিরে এসে যতটা লেখক, তারচেয়ে যেন বেশিই সংগঠক হয়ে গেলেন। প্রথমে বিশাল বাংলা এরপর বিস্তার গঠন করলেন। এটা কি আপনার লেখক সত্তার জন্য ক্ষতিকর ছিল? আরও কি বেশি লিখতে পারতেন?

আলম খোরশেদ: তা কিছুটা সত্যি বইকি। বিশেষ করে ‘বিশদ বাঙলা’ প্রতিষ্ঠা ও তার পরিচালনার কাজটি এতটাই সার্বক্ষণিক ছিল এবং সেটি এতটাই মনোযোগ দাবি করত আমার, যে তখন আর অন্য কিছুতে মনঃসংযোগ করা সম্ভব ছিল না, অন্তত প্রথম পর্যায়ে তো বটেই। পরে অবশ্য এই আকণ্ঠ ব্যস্ততার মধ্যেও কিছু কিছু কাজ করেছি। যেমন আপনার উল্লেখ করা হেনরি মিলারের রিফ্লেকশনস্‌ ও সালমান রুশদির দা জাগুয়ার স্মাইল বই দুটোর অনুবাদ কিন্তু আমি এই বিশদ বাঙলাবিস্তার পর্বেই করেছি। করোনার আচমকা আগ্রাসনে ২০২১ সালে বিস্তার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য আমি অনেক বেশি সময় দিতে পারছি আমার লেখালেখি ও অনুবাদকর্মে। গৃহবন্দি গত দু’বছর দুহাতে কাজ করতে পেরেছি। অনুবাদ, গ্রন্থালোচনা, নিবন্ধ, সংবাদপত্রের কলাম ইত্যাদি মিলিয়ে প্রচুর কাজ করেছি আমি। এরমধ্যে দুটি বইয়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। একটি হচ্ছে আমার সার্বিক সম্পাদনায় লন্ডনের বালেস্টিয়ের প্রেস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের পঞ্চাশজন নারীর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ সংকলন ‘অ্যারাইজ আউট অভ দা লক’ এবং অপরটি সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে আমার অনুবাদে প্রকাশিত কানাডীয় মিশনারি সেবিকা জিনি লকারবির একাত্তরের স্মৃতিকথা ‘অন ডিউটি ইন বাংলাদেশ: দা স্টোরিজ দা নিউজপেপার্স ডিড নট পাবলিশ’ বইটি, যেটি মূলত আমাদের এই চট্টগ্রাম অঞ্চলেই সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের কালে তাঁর ও তাঁর অপরাপর সহকর্মীদের প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতার লোমহর্ষক বয়ান।

আহমেদ মুনির: আপনি এখন পূর্ণকালীন লেখক। অনুবাদ বা অন্য কোনো কিছু লেখার পরিকল্পনা আছে কি?

আলম খোরশেদ: সে তো রয়েছেই। বলাবাহুল্য অনুবাদটাই হবে আমার প্রধান ক্ষেত্র। যেমন এই মুহূর্তেই আমি অনুবাদ করছি বিশ্বসাহিত্যের একজন ব্যতিক্রমী ও বহুল আলোচিত লেখক জার্মানির জি ডব্লুভিইউ সেবাল্ডএর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘দা এমিগ্রান্টস’ বইটি। তবে বিদেশি ভাষার বাংলা অনুবাদের পাশাপাশি বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মের ইংরেজি অনুবাদের প্রতিও মনোযোগ দেবার কথা ভাবছি আমি। সেইসঙ্গে প্রবন্ধ ও সমালোচনা সাহিত্যেও নতুন করে ফিরে যাবার একটা প্রচেষ্টা থাকবে। বস্তুত এমাসের সাতাশ তারিখেই অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষে বাংলা একাডেমির মূলমঞ্চে একটি প্রবন্ধ পড়ার কথা রয়েছে আমার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআউশ
পরবর্তী নিবন্ধমোহরা ওয়ার্ড আ.লীগের শীতবস্ত্র বিতরণ