বিশ্বজিৎ চৌধুরী একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক, নাট্যকার, সমালোচক ও কিশোর সাহিত্যিক। যখন যেটা লিখেছেন এবং লিখছেন, সেটা অনন্য ও অসাধারণ হয়ে পাঠকের কাছে ধরা দেয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করেছেন নতুন ধারা।
জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যও যে অপরিহার্য ও উপভোগের বিষয়, যেটা আমরা বুঝতে পারি, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মতো লেখকদের সপ্রাণ উপস্থিতিতে। তাঁর সমগ্র সাহিত্য মানব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি এবং মানুষের উজ্জীবনী শক্তি। পাঠকের সুপ্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলার কষ্টার্জিত শ্রমলব্ধ প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। তাঁর প্রতিটি রচনা যেমন সহজবোধ্য ও অতলস্পর্শী, তেমনি ব্যাপক। তাতে আছে বিষয় ও ভাষার কারুকাজ, আছে অভিনব বর্ণনা, আছে ঔদার্য ও বিস্ময়।
এ পর্যন্ত অনেকগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। তন্মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ, রয়েছে গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধগ্রন্থ এবং রয়েছে কিশোর গল্পগ্রন্থ। কিশোর গল্পগ্রন্থের মধ্যে আমরা পেয়েছি লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস, পাখির জন্য খোলা আকাশ, ভূতের সঙ্গে পরির বিয়ে, কিশোর গল্প, লাল বাড়িটা ডেঞ্জারাস।
সাহিত্যের নানা শাখায় স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় হলেও কথাসাহিত্যই বিশ্বজিৎ চৌধুরীর প্রধান চর্চিত মাধ্যম। এ অঙ্গনে তাঁর কাজ ব্যাপক ও উল্লেখযোগ্য। জীবন ও ইতিহাস–আশ্রিত উপন্যাস রচনা করে তিনি সমকালের অন্যতম মেধাবী কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন, দিয়েছেন তাঁর শক্তির পরিচয়।
হাসান আজিজুল হক এক লেখায় বলেছেন, ‘ইতিহাস আর উপন্যাস এক জিনিস নয়। এই দুয়ের মাঝে এক রসায়ন থাকতে হবে। একটা কেমিস্ট্রি থাকতে হবে।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরীর উপন্যাসে ইতিহাস আর কল্পনার সমন্বয় ঘটেছে চমৎকারভাবে। নার্গিসকে নজরুলের জীবনীর প্রচলিত আঙ্গিকে দেখবার যে ঐতিহ্য, তাকে ভেঙে দিয়ে তিনি নতুন একটি পথ রচনা করেছেন। অতি সম্প্রতি আমরা পেয়েছি ‘কবরী’।
গল্প বলি, উপন্যাস বলি, সবক্ষেত্রে বিশ্বজিৎ চৌধুরী দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এই দক্ষতা কেবল বড়দের গল্প–উপন্যাস রচনাতেই নয়, ছোটোদের জন্য রচিত গল্পগুলোতেও বিশ্বজিৎ চৌধুরীর সক্ষমতা স্পষ্ট।
সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিশু–কিশোর সাহিত্যও বিকশিত হয়েছে। প্রচুর কর্মী কাজ করছেন এখন। বলতে গেলে আমাদের ‘শিশুসাহিত্য’ এখন কম সমৃদ্ধ নয়। বরং কালের আবর্তে শাখাটি অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে বলা যায়। বর্তমানে যারা শিশু–কিশোর উপযোগী সাহিত্য রচনা করছেন তাঁদের মধ্যে অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিক রয়েছেন, যাঁরা অত্যন্ত মেধাবী ও নিষ্ঠাবান। তাঁরা যেমন সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করছেন, তেমনি পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছেন। বর্তমানে ছড়া, রূপকথা, কবিতা, গল্পের পাশাপাশি উপন্যাস, কিশোর রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী, ভৌতিক উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশনের বই প্রকাশিত হচ্ছে, যা খুবই আনন্দের। এই জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের একজন বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
তাঁর রচনায় যেমন বিস্ময় রয়েছে, তেমনি আছে রোমাঞ্চকর বর্ণনা ও উত্তেজনা। নির্ভেজাল গল্পরসের আস্বাদ গ্রহণ করেন যে কোনো পাঠক তাঁর গল্প থেকে। তিনি কতটা নিষ্ঠাবান, কতটা পরিশ্রমী, কতটা মেধাবী ও আন্তরিক, তা বোঝা যায় তাঁর গল্পগুলো পাঠের মাধ্যমে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো যেমন বিচিত্র জীবনের কথা বলে, তেমনি ফুটিয়ে তোলে বাস্তব জগতের অপূর্ব চিত্র। চরিত্রগুলোর মানসিক দৃঢ়তা, মানবিকতা, সৎ–সাহস, একাগ্রতা ও নিষ্ঠাই তাঁর রচনার উৎকৃষ্ট ও মূল বীজমন্ত্র।
ছোটোদের জন্য লেখালেখির ক্ষেত্রে ম্যাক্সিম গোর্কি Simply Interestingly এবং Meaningfully- এই তিনটি শব্দ উচ্চারণ করেছেন। শিশু–কিশোর সাহিত্য রচনার অন্যতম প্রধান শর্ত হল সহজ ও আকর্ষণীয় করা। কেননা, রচনা সহজ সরল না হলে ছোটোদের বুঝতে কষ্ট হবে, আর আকর্ষণীয় না হলে পড়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ জন্মাবে না। ছোটোদের মনে কৌতূহল সঞ্চার করা এবং তাদের নরম, কোমল ও আনন্দময় মনকে উজ্জীবিত করার জন্য সহজ ও আকর্ষণীয় রচনার বিকল্প নেই। এর মধ্যেই নিহিত আছে চিরায়ত সাহিত্যগুণ। শিশুসাহিত্য এমন এক মনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় যা লেখকের জন্য শ্রমসাধ্য হলেও তার প্রকাশ সাবলীল ও প্রাণবন্ত, শ্রম, চেষ্টা ও প্রতিভার সমন্বয়ে সৃষ্টি হতে পারে এমন অভাবনীয় সাহিত্য। শিশু–কিশোরদের আগ্রহ ও আনন্দের জায়গাটুকুর খবর রাখতে হয় আমাদের। বলা যেতে পারে, শিশুকিশোর মনস্তত্ত্ব আয়ত্ত করে নেওয়া জরুরি। শিশুসাহিত্য যেন শিশুর আনন্দসঙ্গী হয়ে ওঠে, তার জন্য আমাদের ভাবতে হয় সব সময়। সেই বিবেচনায় বিশ্বজিৎ চৌধুরীর প্রতিটি কিশোর গল্প অনন্য ও আনন্দময়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী তেমন এক সফল সাহিত্যিক, যিনি ছোটোদের মনের অপরূপ জগৎকে জীবন্ত ও প্রাণময় করে তোলেন। সরল ভাষায় সুমিষ্ট গল্পরসের স্বাদে ভরা তাঁর সমস্ত গল্পকথা। উপস্থাপনা রীতি ও প্রকাশভঙ্গি বেশ সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত। ভূতের গল্প, রহস্য গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প– সব রকমের গল্পই মজার, তা পড়ে ছোটোরা তো বটেই, বড়রাও আনন্দ পাবেন নিঃসন্দেহে। তাঁর গল্পগুলোর বড় বৈশিষ্ট্য–এগুলো ছোটোদের মনে মানবিক আবেদন তৈরি করে, শুভবোধ ও কল্যাণবোধ জাগ্রত করে। গল্পগুলোর মাধ্যমে লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরী ছোটোদের মানসিক ও নৈতিক চরিত্র গঠনে সচেষ্ট হয়েছেন। একটা নিটোল নির্মল সুন্দর আনন্দময় জগৎ তিনি তাদের উপহার দিতে চান। তাঁর রচনা এতোটাই সহজ ও প্রাঞ্জল, এতোটাই হৃদয়স্পর্শী যে গল্পটি শেষ না করে ওঠা যায় না। যে কয়েকটি কিশোর গল্পগ্রন্থ আমরা পেয়েছি, ‘কিশোর গল্প’ তাঁর একটি অসাধারণ প্রকাশনা। যেসব গল্প এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে, সেগুলো হলো : কথাবলা তোতা পাখি ও পুলিশ অফিসার, লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস, ভুতুড়ে সিঁড়ি, একটি বল কিনে দেব বলেছিলাম, এলিজা গনজালবেস কাঁদছে, ভূতের সঙ্গে পরির বিয়ে, কুড়িয়ে পাওয়ার গল্প, মেয়েটার নাম কান্নাহাসি, রেঙ্গুন দাদি, আমার বোন চামেলী, পাখির জন্যে খোলা আকাশ, বাঘ ও মানুষের গল্প, নৌকা, দুঃখ, তৃতীয় রাজপুত্র, সুন্দরী কেমন আছে এবং ফেব্রয়ারির ১৪ তারিখ।
শব্দে, কাহিনির বুনোট আর রহস্যময় চিত্রায়নে গল্পগুলোকে ভরিয়ে তুলেছেন মৌলিক আমেজে; নির্মাণ করেছেন নতুন বিন্যাসে। সহস–সরল, সাবলীল ও চমকপ্রদ বর্ণনাভঙ্গি এবং মানবিক সংবেদনশীলতা গল্পগুলোকে ভিন্ন মাত্রা দান করেছে। একদিকে কাহিনির নতুনত্ব, পরিণতির পরিপূর্ণ মজা, কল্পনার অভিনব বিস্তার; অন্যদিকে অনুপম ভাষায় আধুনিক প্রকাশ কৌশল গল্পগুলোর প্রধান আকর্ষণ, যা ছোটো বড়–সব বয়সের পাঠককে মুগ্ধ করবে। গল্পগুলোতে লেখক মিশিয়েছেন নতুন রূপ ও রঙ। ফলে এগুলো হয়ে ওঠেছে আকর্ষণীয় ও আদরনীয়।
আমাদের সাহিত্যে রহস্য গল্পের জনপ্রিয়তা প্রচুর। বলা যায়, প্রকাশনা শিল্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় আর পাঠকপ্রিয় হলো এই ধারাটি। নিয়মিত পাঠকদের বিরাট অংশ রহস্য গল্প–উপন্যাস পড়ে থাকেন। আমাদের দেশে এমন অনেক পাঠক আছেন, যাঁরা এ ধরনের লেখা পড়তে পছন্দ করেন, পড়ে মুগ্ধ হন। অন্য লেখার চেয়ে এ ধরনের লেখা একটু ভিন্নধর্মী, তাই এর জন্য দরকার হয় নতুন চিন্তা–ভাবনা। তাঁরা ভাবেন ভিন্নধর্মী প্রক্রিয়া নিয়ে। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর গল্পগুলো রহস্যে ভরা। বলার মধ্যে চমক থাকে, কাহিনি বর্ণনায় থাকে আকর্ষণ। শুরু করেন এভাবে:
‘ছাব্বিশ লাখ টাকা!’
‘জি, ছাব্বিশ লাখ।’
‘এত টাকা ঘরে রাখে নাকি কেউ? আপনারা কি পাগল?’
এ প্রশ্নের আর কী উত্তর হতে পারে? আব্বু শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন প্রশ্নকর্তা পুলিশের দিকে।
আমাদের পরিবারের সবার মন খারাপ। মন খারাপ বললে অবশ্য পুরোটা বোঝানো যায় না, বলতে হবে, আমাদের মন ভেঙে গেছে। এই কদিন খাবার টেবিলে বসে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। আব্বু মাঝেমধ্যে একেকটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। আম্মু রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠছেন, আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। আর নায়লা আপু পড়ার টেবিলে একটা বই খুলে বসে থাকে বটে, কিন্তু তার উদাস চোখ জানালার বাইরে, যেখানে দোতলা পর্যন্ত উঠে এসেছে একটা শিউলিগাছ, গাছের নিচে সবুজ ঘাসে কমলা রঙের বোঁটার সাদা ফুল ছড়িয়ে আছে। আমি জানি, অন্য সময় হলে আপু সেই ফুল কুড়িয়ে এনে তার টেবিলে রাখত। ঘরটা ভরে যেত মিষ্টি একটা গন্ধে। কিন্তু এখন তো মন ভালো নেই।
তিন দিন আগে, মানে গত সোমবার বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমাদের বাসা থেকে ছাব্বিশ লাখ টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতেরা। এত টাকা কেউ ঘরে রাখে নাকি? প্রশ্ন করেছিল পুলিশের লোকেরা। সে উত্তর পরে দিচ্ছি।….
(কথাবলা তোতা পাখি ও পুলিশ অফিসার)
কিংবা,
শেষে কী হলো?
নিকিতার এই প্রশ্ন শুনে রেঙ্গুন দাদি হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলেন– শেষের কথাডা যে আগে জিগায়, তার লগে আমার কুন কিস্সা নাই…।
(ভূতের সঙ্গে পরির বিয়ে)
তদ্রুপ তাঁর ‘লাল বাড়িটা ডেঞ্জারাস’ তেমনি এক অসাধারণ রহস্যগল্প। গল্প বলার চমক আর আকর্ষণ পাঠককে ধরে রাখে পরম মমতায়।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী আমার প্রিয় একজন লেখক। যিনি বাংলাদেশের পাঠকদের মধ্যে নির্মল আনন্দ দানে ভূমিকা রাখছেন অনেক দিন ধরে। বড়দের লেখালেখির জন্য বিশেষ বিখ্যাত হলেও ছোটোদের ভিন্ন রসের গল্পের জন্যও তিনি সমাদৃত। ছোটোদের চোখে দেখার ক্ষমতা ১৯৮২ সালেই তিনি অর্জন করেছেন, যখন তাঁর প্রথম বই ‘লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস’ প্রকাশিত হয়।
ছোটোদের লেখার একটি প্রধান ও প্রচলিত সংজ্ঞা হল, এটি সববয়সী পাঠককে সমানভাবে আকর্ষণ করবে। অজিত দত্ত বলেন, ‘ছোটোদের বই এমন হতে হবে যা তাদের ভালো লাগবে আর যা পড়ে তাদের মনের ভালো বৃত্তিগুলোতে খানিকটা সাড়া জাগাবে।’ এক্ষেত্রে বলি, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কিশোরগল্প সব বয়সী পাঠকের জন্য আনন্দস্বরূপ। একেকটা গল্প একেকটা সুন্দর উপহার। তাঁর বইও তেমন সবার আনন্দানুভূতিকে জাগিয়ে তোলে।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো, বাংলা একাডেমি