বাবা, সবকিছুই আছে আগের মতন, শুধু তুমি নেই

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী | বুধবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

একটা শীতের ভোরে তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, কথা ছিলো ফিরিয়ে আনবো একটু পর। সেই একটু পর আর কোনদিন আসেনি! জলজ্যান্ত তুমি হয়ে গেলে বডি, ঢেকে দেয়া হলো তোমার সমস্ত শরীর, তোমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তোমার আপনজনেরা। বলা হচ্ছে লাশ এখান থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে হবে। হাসপাতালের বারান্দায় তোমার নিথর দেহ, একেই নাকি বলে লাশ! বাবা, আমি শুধু অপলক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম কোন এক মিথ্যের অপেক্ষায়! একটু পরে হাসপাতাল থেকে দেয়া হলো একটা কাগজ, আগে কখনো দেখিনি এরকম কাগজ, জানতে চাইলাম এটা কি! আমার হাতে দিয়ে বলা হলো ডেথ সার্টিফিকেটভবিষ্যতে অনেক কাজে আসবে, এত কষ্টের মধ্যেও হাসি পেলো! মনে হলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দেই এই জঘন্য কাগজটা। পারলাম না ফেলতে, এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি বাবা তোমার ডেথ সার্টিফিকেট‘!

শুধু একবার দেখেছিলাম সেখানে কি লেখা আছে, আর কখনও দেখার চেষ্টা করিনি,মাঝে মাঝে শুধু কাগজটা ছুঁয়ে দেখি আর চোখের জল ফেলি! এরপর তোমাকে নিয়ে আসা হলো তোমার আনন্দ,বেদনা,হাসি,সুখ দুঃখে ভরা ছোট্ট নীড়টিতে, জীবনের অর্ধেকেরও বেশী সময় তুমি যেখানে কাটিয়েছো। যাদের ছাড়া তুমি কখনও নিজেকে ভাবতে পারতেনা তারা আজ অসহায়, কিছুই করতে পারছেনা তোমার জন্য শুধু চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর প্রস্তুতি নিচ্ছে তোমার শেষ যাত্রার! অনেকেই আসছে তোমায় দেখতে, তোমার জন্য কান্নাকাটি করছে, কেউ বিশ্বাস করতে পারছেনা হঠাৎ করে মানুষ কি করে দেহহয়ে যায়! আমি তোমার মুখে বার বার হাত বুলিয়ে, তোমার হাতে, পায়ে স্পর্শ করে বুঝতে চাইলাম তোমার শরীর হিমশীতল কিনা, কেননা কোন একসময় জেনেছিলাম মানুষ যদি মারা যায় তার শরীরটা বরফের মতন ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু তোমার শরীর ছুঁয়ে আমি কিছুই অনুভব করতে পারলামনা, মনে হলো তুমিতো একইরকম আছো,একটু আগেও যেমনটি ছিলে, তোমার কেন শেষ যাত্রা হবে! চিৎকার করে সবাইকে বলতে ইচ্ছে হলো তোমরা কিসের প্রস্তুতি নিচ্ছো, কেন এতো আয়োজন, কিন্তু কে শুনবে আমার কথা! হঠাৎ করে দেখি তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছো,কেমন যেন গবের্র হাসি সেই হাসিটা যেন বলছে, ‘কোন লাভ হবেনা আমাকে ছুঁয়ে দেখে আমি তোদের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি,শত চেষ্টা করেও আমাকে ধরে রাখা যাবেনা

বাবা, সত্যিই তুমি দূরে চলে গেলে,অনেক দূরেনা পারছি ধরতে,না পারছি ছুঁতে। যে ঘরটাতে তুমি দিনের পর দিন কাটিয়েছো সে ঘর আজ তোমার না। যে দরজা দিয়ে তুমি ইচ্ছে মতন ঢুকেছো আর বেরিয়েছো সেই দরজা দিয়ে আজ বেরিয়ে যাবে তুমি সারাজীবনের জন্য! সেই ঘর, সেই দরজা কাঁদছে তোমার জন্য আর কোনদিন তোমার সাথে দেখা হবেনা বলে! একটু পরে তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামানো হবে যেই সিঁড়ি প্রতিদিন তোমার প্রতিক্ষায় থাকতো কবে তুমি উঠবে আর নামবে! আজও তুমি নামবে তবে স্ট্রেচারে শুয়ে এই নামা যে তোমার শেষ নামা কি করে সহ্য করবে সিঁড়িগুলো এই কষ্টতাইতো তারা কাঁদছে অঝোর ধারায় বাবা তারা আজও কাঁদে যখন আমি ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠি, তাদের বেদনা আর আমার বেদনা এক হয়ে যায়! আহা তোমার প্রতিদিনকার যাওয়া আসার পথ পেরিয়ে তুমি চলে যাচ্ছো অন্য কোন পথের ঠিকানায়, অন্য কোন গন্তব্যে! সেই পথ খুঁজে পাচ্ছেনা কোন ভাষা তোমায় বিদায় জানানোর! বাবা

আজ নটা বছর তুমি নেই আমাদের সাথে তবুও আছো আমাদের অস্তিত্ব জুড়ে। কেমন আছো তুমি অন্য ঠিকানায়, ভুলে যাওনিতো আমাদের? অনেক গল্প জমা করে রেখেছি তোমার জন্য যদি কোনদিন দেখা হয় তবে সেই গল্প শোনাবো কোন আনন্দ আড্ডায়। বাবা, ভালো আছে তোমার প্রিয়জনেরা, ভালো আছে তোমার মুগ্ধ। সবকিছুই আছে আগের মতন, শুধু তুমি নেই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযাসনে ওদের কাছে
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপির ২৭ দফা ও প্রাসঙ্গিক কথা