“যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী-/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি-/ দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় /নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়/মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি/ দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি” – সপ্তদশ শতকের বাংলা কবি আবদুল হাকিম তাঁর ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় লিখেছেন। এ কবিতায় বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলার রূপটি স্পষ্ট প্রতীয়মান।
বাংলা ভাষায় সাহিত্য আপন গড়িমায় চলমান থাকলেও এ ভাষাকে অপরাজনীতি উপাদান হিসেবে প্রতিপন্ন করে পাকিস্তান রাষ্ট্র ক্ষমতার শাসকেরা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষার প্রতি রাষ্ট্রীয় চরম অবহেলা এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ। নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করে বাংলা ভাষাকে অবদমিত করার হীন প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। অথচ পুঁথি সাহিত্য, পাণ্ডুলিপি, আরাকান রাজসভার বাংলা সাহিত্য, দৌলতগাজী, সতি ময়না, আলাওলের পদ্মাবতীসহ প্রায় শত বছর পূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ৬৫টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে ৩৫টি বাংলা ভাষায় রচিত বলে প্রমাণ মেলে। এমনকি এরই ধারাবাহিকতায় হর প্রসাদ শাস্ত্রীসহ পঞ্চকবির অবদানে বাংলা সাহিত্যে একটি সমৃদ্ধি দৃষ্ট হয়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জনের ইতিহাস আমরা জানি।
বাংলা ভাষার উৎকর্ষে ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা গেলেও এটি কোনোদিন রাজভাষা হিসেবে মর্যাদা পায়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশ শাসনে তো নয়ই, এমনকি হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম শাসন আমলেও কোনো সময় বাংলা ভাষা রাজভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। শুধুমাত্র ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় ছিল।
বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলার বিষয়টি নতুন কোন ছিল না। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আগমনের পর থেকে বাংলায় মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বহিরাগত মুসলমান ও দেশীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সমন্বয়ে এ সমাজ গঠিত হয়। দেশীয় মুসলমানদের অনেকেই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত। এ সময় বহিরাগত উচ্চ মুসলমানরা আশরাফ ও দেশীয় মুসলমানরা আতরাফ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আশরাফ মুসলমানরা সহজে বাংলাচর্চা করতেন না। শাসকশ্রেণি নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ ও আধিপত্য বজায় রাখার জন্য আতরাফদের ওপর তাদের নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি চাপানোর অপচেষ্টা চালায়। এভাবে ভাষার প্রশ্নে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। এমনকি অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমানদের প্রতিভূ নবাব আব্দুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলী ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় ইংরেজি, আরবি ও উর্দুপ্রীতি ব্যক্ত করেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র বিভক্তির প্রাক্কালে এদেশের রাষ্ট্রভাষা কী হতে পারে এ বিষয়ে তৎকালীন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়া উদ্দিন, ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. খালেকুজ্জামান একদিকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এবং অপরদিকে ড. মো. শহিদুল্লাহ ও ড. এনামুল হক প্রমুখ বাঙালি বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন লেখনির মাধ্যমে বাংলার পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেন- “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা, যা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারা ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা তিলক কিংবা টুপি দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই”।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকার যখন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে অটল অবস্থানে তখন ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে “তমদ্দুন মজলিস” নামক সংগঠন গঠিত হয়। এর নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক আবুল কাশেম। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ঢাকার ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে। সেসময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বাংলা ভাষার সমর্থনে স্লোগান দেয়। পরে বাংলা ভাষার দাবির প্রতি আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হতে থাকে।
ড. মুহাম্মদ এনামুল হক নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘কৃষ্টি’ পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বলেন, “ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটিবে……. উর্দু বহিয়া আনিবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মরণ- রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু।”
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলিতে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। খাজা নাজিমুদ্দীনও এর সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চায়। কিন্তু এটি ছিল বাস্তবতা বিবর্জিত বাঙালিবিদ্বেষী বক্তৃতা। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ এনামুল হক বলেন- ‘ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়া রাখিয়াছে, কোন দেশ ইহার নিজের ভাষা দিয়া অপর দেশকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে নাই।’ তাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মধ্যে ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে পল্টন ময়দানে খাজা নাজিমউদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। উক্ত বক্তৃতায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো তিনিও ঘোষণা করেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ এ ঘোষণার বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের চেয়েও জোরালো আন্দোলন শুরু হয়। নাজিমউদ্দিনের এ ঘোষণার সময়ে তরুণ রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। এসময় বঙ্গবন্ধু অসুস্থতার কারণে মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ১৯৫২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলে বন্দি অবস্থায় শামসুল হক চৌধুরী, আব্দুস সামাদ আজাদ ও ড. গোলাম মাওলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারির হরতাল ডেকে এসেম্বলি ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দেন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও বন্দি মুক্তির দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ কারাগারে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অন্য জেলে স্থানান্তরের সময় নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় শামসুদ্দোহাসহ কয়েকজন ছাত্র নেতার। এসময় শেখ মুজিব অনুরোধ করেন -‘যেন একুশে ফেব্রুয়ারিতে হরতাল মিছিল শেষে আইনসভা ঘেরাও করে বাংলা ভাষার সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয়।’
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকে পাকিস্তান সরকারের দেয়া ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে ছাত্রজনতা মিছিল বের করলে পুলিশ বাহিনী তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এতে প্রাণ দেন ছাত্র-জনতা। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।
ভাষা আন্দোলনের সূচনা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি, মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার উপরে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ এবং পরবর্তীতে মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি বাংলা ভাষার প্রতি বিশেষ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। বাংলা ভাষার মর্যাদা অর্জনের সেই ইতিহাস ব্যাপক ও বিস্তৃত। আমরা এ বিস্তৃত আলেচনায় না গিয়ে বাংলার প্রবাদপ্রতীম মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ তথা মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তাঁর অনন্য অবদান আলোচনার প্রয়াস থাকবে এ লেখায়। এক্ষত্রে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা থেকে উদ্ধৃতি এ আলোচনায় সম্পৃক্ত করবো।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন -“১৬ তারিখ সকাল দশটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র সভায় আমরা সকলেই যোগদান করলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসলো সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করলো। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হল। আমি বক্তৃতায় বললাম, -যা সংগ্রাম পরিষদ গ্রহণ করেছে, আমদেরও তা গ্রহণ করা উচিত। শুধু আমরা ঐ সরকারি প্রস্তাবটা পরিবর্তন করতে অনুরোধ করতে পারি, এর বেশি কছিু না-” [ অসমাপ্ত আত্নজীবনী, পৃষ্ঠা নং-৯৬]
তিনি আরো লিখেছেন- “বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করবো কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হল আমরা বুঝতে পারলাম না। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ৯৮]
“দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলিমরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারে নাই। যে কোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই। [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ৯৮-৯৯]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরো এক জায়গায় উল্লেখ করেন- “১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসলে হাজার হাজার লোক তাঁকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিল। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম, তবুও ভিজে কাপড় নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”। আমরা প্রায় চার পাঁচ শত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না’। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে” তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল ‘না,না,না’। [সুত্র: অসমাপ্ত অত্মজীবনী, ৯৯]
দীর্ঘদিন জেলে থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলার কোন কিছু না পেয়ে আবেগের ছলে লিখলেন- “পূর্ব বাংলায় বাঙালির মুখ দেখতে পারি নাই কয়েকমাস এ কথা কি কেহ বিশ্বাস করবে? পাঁচ মাসের মধ্যে বাংলায় কথা বলতে পারি নাই। কারণ কেহই বাংলা জানে না। ঢাকা রেডিও এরা শোনে না। হয় কলম্বো, না হয় দিল্লী-হিন্দি উর্দু গান শোনবার জন্য। বাংলা গান এরা বোঝে না বলেই শুনতে চায় না। বাংলা গান হলেই রেডিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। একজন বাঙালি ডাক্তার দেখতে আসতেন, তার বাড়ি কুমিল্লা। নাম মেজর সফিক (ডা.)। তিনি কখনো একাকী আমার কামরায় আসতেন না। সাথে ডিউটি অফিসারকে নিয়ে আসতেন। বাংলায় কথা বলতেন না। ইংরেজি বা উর্দু। আমি তার চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি পূর্ব বাংলার লোক। বাংলায় আমি কথা বললে ইংরেজি বা উর্দুতে জবাব দিতেন। একদিন আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, বোধহয় বাংলা ভুলে গেছেন তাই উর্দু বলেন। [কারাগারের রোজনামচা, ২৬৬-২৬৭]
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কথোপকথন উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু লিখেন – “পরের দিন নৌকায় আমরা রওয়ানা করলাম, আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলি যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদার উদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন “ মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্য়াদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।” আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।’[অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ১১১]
বঙ্গবন্ধুর উল্লিখিত বক্তব্যে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর দরদ এবং মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ও প্রচেষ্টাই প্রতিফলিত হয়েছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন, অসাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার ভিত রচনা এবং এর ধারাবাহিকতায় ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বাঙালিত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৭০’র নির্বাচন ও ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভ করে, প্রতিষ্ঠিত হয় ভাষার মর্যাদা।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনাতেও বাংলা ভাষাকে অন্যতম অবলম্বন করেছেন। এ প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের বাংলা ভাষায় রচিত পাণ্ডুলিপি (কারুকার্যখচিত) ও প্রাঞ্জল অনুবাদ ব্যাখ্যার জন্য বাংলা ভাষা সাহিত্যের পণ্ডিত ড. আনিসুজ্জামানকে আহবায়ক করে প্রফেসর আলী আহসান (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ও ড. মাজহারুল ইসলাম (বাংলা একাডেমির সভাপতি) কমিটি গঠন করেন। এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বিশ্বকবি রচিত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” (স্বদেশ পর্যায়ের প্রথম কবিতা) প্রায়ই বঙ্গবন্ধু গুন-গুন করে গাইতেন। বাংলার মাটি ও মানুষের সমান্তরালে বাংলাভাষার প্রতি অনুরাগী বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় বক্তব্য রাখেন, যা বিশ্বসভায় বাংলাভাষার মর্যাদাকে উজ্জ্বল করেছে। সেই মর্যাদাকে সমাসীন করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে নিয়মিত বাংলায় বক্তব্য রাখছেন।
যদি একটি জাতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সে জাতির ভাষাও সমৃদ্ধ ও মর্যাদায় আসীন হয়। এরই লক্ষ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ তৈরিতে এগিয়ে চলেছেন।
লেখক- সাবেক ডিন কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক