বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার ক্রমপরিবর্তন এবং সিনিয়র সিটিজেনদের বৃদ্ধাশ্রমে গমন

ড. নারায়ন বৈদ্য | সোমবার , ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

মানব সভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায়, পৃথিবীর সকল অঞ্চলে সমভাবে সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। মানব সভ্যতার ধরন নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রাকৃতিক অবস্থা ও মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর। বিশ্বের প্রতিটি ধর্ম মানবজাতির কল্যাণের কথা বলে। তবুও ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সভ্যতা। এই কারণে প্রাচ্যের সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্যের সভ্যতার তেমন মিল দেখা যায় না। তবে সামাজিক পরিমণ্ডলের সভ্যতার মধ্যে ভিন্নতা দেখা গেলেও জ্ঞানবিজ্ঞানের দিক থেকে উভয় অঞ্চলের মধ্যে মিল দেখা যায়। জ্ঞানবিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে গতি, স্বাচ্ছন্দ ও বিলাস। কিন্তু সামাজিক পরিমণ্ডলকে করেছে নিষ্ঠুর এবং নির্মম। বিজ্ঞানের ক্রমউন্নয়নে গতি, স্বাচ্ছন্দ ও বিলাস যতই ক্রমবর্ধমান হচ্ছে ততই সমাজ ব্যবস্থা থেকে আবেগ, স্নেহ, মমতা হ্রাস পাচ্ছে। মানবজাতি হয়ে উঠছে অতি স্বার্থপর এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার ধাক্কায় কোনও সময় যে সদ্যজাত সন্তানের প্রতিও স্নেহ, মমতা হ্রাস পেয়ে বসবে তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানে। পাশ্চাত্যের সমাজ ব্যবস্থায় এখন তা ক্রমাগত স্পষ্ট হচ্ছে।

পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থায় যৌবনের উত্তাল দিনগুলোতে বাধাহীন উচ্ছ্বাসের কারণে যুবকযুবতীরা পরস্পরের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ায়। এমনকি ‘লিভটুগেদার’সূত্র অবলম্বন করে কিছুদিনের জন্য জীবন ব্যবস্থাকে চালিয়ে নেয়। কিন্তু মানবজাতির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য যে, তারা যাযাবরের ন্যায় উত্তাল যৌবনে সঙ্গী পরিবর্তন করতে চায়। এর ফলস্বরূপ ‘লিভটুগেদার’ থেকে আগত সন্তানেরা হয়ে পড়ে পিতামাতার স্নেহ বঞ্চিত ঠিকানাহীন মানব সন্তান। যাদেরকে বাংলাদেশে বলা হয় ‘পথ শিশু’। এরূপ সমাজব্যবস্থায় সামাজিক বন্ধন আর থাকে না। হয়ে পড়ে সমাজব্যবস্থা দুর্বল। এই যে, যাযাবরের ন্যায় দুরন্ত যৌবনে সময়কে কাটিয়ে দেয়ার পর মধ্য বয়সে এসে তাদের উপলব্ধি হয়। তখনই পরিবার গঠনের জন্য তারা উদ্যোগী হয়। কিন্তু এ সময়ে জীবনের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি বছর কেটে যায়। তখন তারা বুঝতে পারে পরিবার গঠনের প্রয়োজনীয়তা। এ সত্য উপলব্ধি করার পূর্বে নিজেদের পিতামাতার কোনও খবর নেয়ার ও পিতামাতার প্রতি দায়িত্ববোধের কোনও বালাই থাকে না। তাই পিতামাতা বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের সাহায্য ও সহযোগিতা না পেয়ে অবশেষে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয়। এ হলো পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা।

২০১৯ সালের দিকে (যতটুকু মনে পড়ে) আমার এক সহকর্মীর মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। অবশ্য যখন তিনি আমাকে মেয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ করছিলেন তখন মেয়ের বিয়ে সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছিলেন। আমার সহকর্মী তার মেয়েকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর ভারতের একটি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সেখানে মেয়ের সাথে ইউরোপ থেকে পড়তে আসা এক ছেলের পরিচয় ঘটে। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা, পরবর্তীতে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় বাংলাদেশে। উক্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি ছেলের সাথে তার বাবা, মা ও কিছু আত্মীয় স্বজনও এসেছে। তাদের সাথে কথা বলে আমার এতই ভাল লাগলো যে, ভাবলাম পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা এখনো আছে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা যে পুরোপুরি ভালো আছে তা কিন্তু বলা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যা পুরো সমাজব্যবস্থাকে কলুষিত করে। কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় দেখলামবাড়ির উঠানে এম্বুলেন্সে পিতার লাশ রেখে সন্তানেরা পিতার রেখে যাওয়া টাকা (পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ড) নিয়ে পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া করছে। ছেলেদের অভিযোগ ছিল যে, পিতার মৃত্যু হওয়ার পূর্বে এক বোন পিতার নিকট থেকে কৌশলে বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ খবর ছেলেরা জানার পর সেই টাকার ভাগ বসাতে ছেলেরা বোনের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। আজ থেকে বিশ বছর পূর্বেও এরূপ একটি ঘটনা কল্পনাও করা যায় না। তাদের কাছে পিতার মৃত্যুর তুলনায় টাকার ভাগ পাওয়াটাই বড়। অর্থাৎ আমাদের সমাজব্যবস্থা এমনই পরিবর্তন হয়েছে যে, পিতার মৃত্যুতে যেখানে শোকাবহ পরিবেশ বজায় থাকার কথা সেখানে শোকের চাইতে টাকা প্রাপ্তিটাই বড়। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার ধারা কোন দিকে পরিবর্তীত হচ্ছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ রকম আরো অনেক ঘটনা এদেশে ক্রমাগত ঘটছে।

সমসাময়িক সময়ে আর একটি ঘটনা আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছে যা সপ্ত আশ্চর্যকেও হার মানায়। আমার অতি পরিচিত ভদ্রলোক ছাত্রজীবনে খুবই মেধাবী ছিলেন। এলাকার সবাই তাকে খুবই ভালো ছাত্র হিসেবে জানে। স্কুল জীবনে মেধার স্বাক্ষর রেখে শহরের একটি প্রথম শ্রেণির কলেজে ভর্তি হয়। উচ্চ মাধ্যমিকেও ভাল ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই এতই ভাল ফলাফল করেছে যে, অবশেষে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি এনে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করে। কর্মময় জীবনে তিনি অনেক দেশে স্ত্রী, পুত্র পরিবার নিয়ে ভ্রমণ করেছেন। এক পুত্র সন্তান ও দুই কন্যা সন্তানের জনক অধ্যাপক সাহেব সুখের সংসার রচনা করার জন্য ঢাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে অবশেষে পুত্র সন্তানটিকে আমেরিকা নামক ভূখণ্ডে প্রেরণ করেন। আমেরিকা থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সন্তান আর দেশে না আসার সিদ্ধান্ত নেয়। অধ্যাপক সাহেবও মনে মনে বেশ খুশি হয়েছিলেন এ বলে যে, তিনি অবসর গ্রহণ করার পর বাকী জীবন আমেরিকায় ছেলের নিকট কাটিয়ে দিবেন। কন্যা সন্তান দুইটিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষায় শিক্ষিত করে যথাসময়ে পাত্রস্থ করেন। দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ে স্বামীকে নিয়ে বিদেশ থাকে, আর এক মেয়ে দেশে চাকরি করে। অধ্যাপক সাহেব যথাযথ সময়ে অবসরে গেলেন। অবসরে যাওয়ার পর যে পরিমাণ পেনশনের টাকা পেতেন এবং যে পরিমাণ ঘরভাড়া পেতেন তা দিয়ে তিনি খুবই আরাম আয়েশে দিন গুজরান করছিলেন। সময় অতিবাহিত হচ্ছে, তিনি খুব শখ করে বাঙালি একটি মেয়ের সাথে ছেলেকে আমেরিকা থেকে এনে বিয়ে দিলেন। বিয়ের দুই মাসের মাথায় পুত্র ও পুত্রবধূ আমেরিকায় চলে যায়। সময় অতিবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ বছর চলে যায়। পুত্র আমেরিকা থেকে খবর পাঠাই তার কিছু টাকা প্রয়োজন।

অধ্যাপক মহোদয় একমাত্র পুত্রকে যথাসম্ভব টাকা পাঠানোর চেষ্টা করে। অধ্যাপক মহোদয়ের বয়স প্রায় ৬৫ পার হয়েছে। জীবনের সমুদয় অর্জিত অর্থ অতি আদরের পুত্রের নিকট পাঠিয়ে তিনি মনে মনে আত্মতৃপ্তি পেলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রী কিন্তু এক ধাপ এগিয়ে। ইতিমধ্যে খবর আসল যে তিনি দাদা হয়েছেন। খুশি আর আটকায় কে? দিনরাত অধ্যাপক মহোদয় এবং তাঁর স্ত্রী স্বপ্ন দেখতে লাগলো যে, তারা নাতিকে নিয়ে অনেক দূরে বেড়াতে যাচ্ছেন। ছয় মাস পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, যে করে হোক তিনি ও তার স্ত্রী নাতিকে দেখতে যাবেন সেই সুদূর আমেরিকায়। ছেলেকে ফোনে তাঁদের আগ্রহের কথা জানানো হলে ছেলে প্রস্তাব দেয় যে, আগামী বসন্তে সে তাদেরকে নেয়ার ব্যবস্থা করবে। তবে সে তার পিতামাতাকে একেবারে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় নিয়ে যেতে চায়। এজন্য আমেরিকায় একটি বাড়ি কিনতে যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন তার জন্য ঢাকার বাড়িটি বিক্রয় করার প্রস্তাব দেয়। অধ্যাপক মহোদয় অনেক ভেবে চিন্তে অবশেষে ছেলের প্রস্তাবে রাজী হয়। কারণ একমাত্র ছেলে বিদেশে। তাছাড়া মেয়ের সংসারেও থাকার ইচ্ছা নেই। অবশেষে এক ডেভেলপার কোম্পানীর নিকট বাড়িটি বিক্রয় করে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সুদূর আমেরিকায় ছেলের নিকট চলে যান। সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে। নাতির বয়স প্রায় দুই বছর হয়েছে। আমেরিকায় ছেলের বাড়িতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সুখেই দিন যাচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন থেকে তিনি লক্ষ্য করলেনছেলে ও বৌ এর কথা বার্তা যেন একটু আলগা আলগা। হঠাৎ একদিন রবিবার সকালে ছেলে মা ও বাবাকে ডেকে বললেন, বাবা, আমি ও তোমাদের বৌ একটু অন্য দেশ ভ্রমণে যাবো। তোমরা একা একা এখানে থাকতে পারবে না। তোমাদের বয়স হয়েছে। তোমরা কিছুদিনের জন্য দেশে চলে যাও। বাবা হতবাক হয়ে বললো, বাংলাদেশে তো আমাদের থাকার জায়গা নেই। উত্তরে ছেলে বললোকেন? শিউলির (ছোট বোন) বাসায় থাকবে। বৃদ্ধ মাবাবার মুখে কোনো উত্তর আসল না। নীরবে চোখ থেকে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। একদিন পর ছেলে ও ছেলের বৌ বড় বড় দুইটি ব্যাগের মধ্যে মা ও বাবার সব কাপড় চোপড় ঢুকিয়ে দিয়ে বললোতোমাদের জন্য আজ বিকাল তিনটার ফ্লাইটের টিকেট করে এনেছি। যথাসময়ে ঘরের দুয়ারে গাড়ি চলে আসে। মা ও বাবাকে তড়িঘড়ি করে গাড়ি নিয়ে ফ্লাইটে তুলে দিল। একদিন পর অধ্যাপক মহোদয় ও তার স্ত্রী ঢাকায় নেমে মেয়ে শিউলিকে ফোন করে জানায় যে, তারা ঢাকা বিমান বন্দরে এসেছে। মেয়ে এসে বাবামাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ছেলে একটি বারের জন্যও মাবাবার খবর নেয়নি।

এটি একটি বাস্তব সত্য ঘটনা। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাও এরূপ ক্রম অবনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন ব্যস্ত থেকে যা কিছু সন্তানের জন্য সঞ্চয় করেন তা কোন কাজে আসবে না। সন্তানকে সামাজিক শিক্ষা দিন। অর্থের প্রতিযোগিতা নয়, বরং স্বল্প অর্থ আয় করে দেশ, জাতি ও সমাজের দায়িত্ববোধের দিকে মনোযোগ দিন। অন্যথায় নচিকেতার সেই বৃদ্ধাশ্রমের গানটির মত হবে সমাজ। ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার। মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী। সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম। আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।

লেখক: কলামিস্ট, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজার রেলপথ, বঙ্গবন্ধু টানেল পর্যটনের সম্ভাবনা ও কালুরঘাট সেতু
পরবর্তী নিবন্ধদোহাজারী-চট্টগ্রাম রেল লাইন পরিদর্শনে জিআইবিআর