দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করার তোড়জোর চলছে যেন আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ট্রেন চলাচল করতে পারে। রেলমন্ত্রী এবং সরকারের দায়িত্বশীলরা এমনটাই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। ঢাকা থেকে দ্রুতগতির ট্রেন যাবে কক্সবাজার এটি দেখার অপেক্ষায় আছেন দেশবাসী। পদ্মা সেতুর পর যে দুটি মেগাপ্রকল্প দেশবাসীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তা হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেললাইন। দু্থটি প্রকল্পই এ অঞ্চলের আর্থ–সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাবে তা শুধু নয়, পর্যটন খাত এবং শিল্পায়নের বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতেও বিশাল ভূমিকা রাখবে। এ নিয়ে নানা ধরনের সম্ভাবনার কথা আমরা বিশেষজ্ঞজনের লেখা আলাপে জানতে পারছি। আমার আজকের লেখার বিষয় ভিন্ন। রেললাইন ও টানেল চালু হলে পর্যটকের যে চাপ বাড়বে তা সামলানোর প্রস্তুতি আছে কিনা এবং প্রকল্প পরিকল্পনায় সমন্বিতভাবে পর্যটন খাত কতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে তা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একশ কিলোমিটার রেলপথের নির্মাণ কাজের ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। রেললাইন বসানোর কাজটি কক্সবাজারের দিক থেকে হয়ে আসছে। কক্সবাজার সদরে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেল স্টেশন নির্মাণের কাজও প্রায় শেষ। অন্যান্য স্টেশনের নির্মাণ কাজও এগিয়ে চলেছে। দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পর্যটকদের প্রথম পছন্দ কক্সবাজার। অনেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে কক্সবাজার ঘুরে ফেরার পথে বান্দরবানও ঘুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ঢাকা– কক্সবাজার ট্রেন চালু হলে যারা বান্দরবানও যেতে চান তাদের কথা মাথায় রাখা হয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। বান্দরবানকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। সড়কপথে যেসব পর্যটক বান্দরবান যান তারা সাতকানিয়ার কেরানিহাট হয়ে যান। যানবাহনের সমস্যায় তেমন পড়তে হয় না। কিন্তু ট্রেন চালু হলে যারা বান্দরবানও যেতে চাইবেন তাদের বেশ ভোগান্তি পোহাতে হবে। কেরানিহাটের কাছাকাছি কোন রেলস্টেশন থাকছে না। ট্রেন যাত্রী যারা বান্দরবান যেতে বা সেখান থেকে ট্রেনে ফিরতে চাইবেন তাদের অনেক দূরে সাতকানিয়া কলেজের কাছের স্টেশন বা দোহাজারী স্টেশনে নামতে হবে বা যেতে হবে। নেমে বান্দরবানের গাড়ির জন্য ছুটতে হবে। ভীষণ ভোগান্তির বিষয় হবে।
ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দ্রুতগতির ট্রেন চলবে– এমনটাই বলা হচ্ছে। কিন্তু সেই ট্রেন শতবছরের প্রাচীন জরাজীর্ণ কালুরঘাট রেলসেতুর উপর দিয়ে কিভাবে চলবে। এখন অত্যাধুনিক যেসব রেলইঞ্জিন আমদানি হচ্ছে তার ওজন ১৫/১৬ টন, সাইজেও বড়। আগের ইঞ্জিনগুলো ছিল ১১ টনের। বিদ্যমান সেতুটি মেরামত করে আপাতত কোনোভাবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিদ্যমান কালুরঘাট সেতু চাপ সামলাতে না পারায় নতুন করে এখানে আবার ফেরি সার্ভিস চালু করা হচ্ছে। তিনটি ফেরি ইতিমধ্যে এসে পৌঁছছে। অ্যাপ্রোচ রোডের কাজ চলছে। আগামী মার্চে ফেরি সার্ভিস শুরু হবে। ‘চাইলাম সেতু–পাইলাম ফেরি’ ইউটিউবে এরকম একটি গানের ভিডিও দেখলাম। কালুরঘাটে সড়ক কাম রেলওয়ে সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। কর্ণফুলীর ওপারে বোয়ালখালী উপজেলা নগরীর উপকণ্ঠে হয়েও যেন এক দুর্গম জনপদ। বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে বোয়ালখালী সদরের দূরত্ব ৭ কিলোমিটার এবং কড়লডেঙ্গা পাহাড়ের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটারের মত। সড়ক কাম রেলসেতু হলে এই বোয়ালখালীতে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের মেগাপ্রকল্প পরিকল্পনা যারা প্রণয়ন করেছেন তারা কালুরঘাট সেতুর বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। গুরুত্ব পায়নি চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত শাখা রেললাইনটি। একসময় এই শাখা লাইন ছিল খুবই জনপ্রিয়। দৈনিক সাতজোড়া ট্রেন চলাচল করত। লোকজন মাসিক টিকেট কেটে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতেন। গ্রামে থেকে এসে শহরে অফিস করতেন। এখন এই লাইনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলে না। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফার্নেস অয়েল নিয়ে মাঝেমধ্যে যে তেলবাহী ট্রেন দোহাজারীর উদ্দ্যেশ্য যায় তা মাঝপথে লাইনচ্যুত হয়ে খালে– বিলে পড়ছে নিয়মিত। এ রকম জরাজীর্ণ লাইন দিয়ে কিভাবে দ্রুতগতির অত্যাধুনিক ট্রেন কক্সবাজার যাবে তা মাথায় আসে না। কালুরঘাট সড়ক কাম রেল সেতুর নতুন নকশা তৈরি করে তা কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের অনুমোদন পেলে এটি আমাদের একনেক সভায় তোলা হবে বলে আজাদী একটি সুসংবাদ দিয়েছে। কবে নাগাদ এটি বাস্তবায়নের মুখ দেখবে তা সময়ই বলে দেবে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ এ বছর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর ব্যয় এবং সময়সীমা দুটোই বেড়ে গেছে। এই টানেলকে ঘিরে কর্ণফুলীর দুই তীরে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। আনোয়ারা– বাঁশখালী– পেকুয়া হয়ে কক্সবাজার যাওয়ার নতুন মহাসড়ক এবং মিরসরাই থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার পর চট্টগ্রাম মহানগরীতে না ঢুকে ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার চলে যাবে যানবাহনসমূহ। দূরত্ব এবং সময় দুটোই সাশ্রয় হবে তখন। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের মাতামুহুরী নদী, সাঙ্গু নদ, বরুমতি খাল এবং ইন্দ্রপোলে ছয় লেনের সড়ক সেতুর নির্মাণ কাজ শেষের পথে। পাশাপাশি দুটি করে সেতু হচ্ছে। তিনলেনের একটি করে সেতু চালু হয়ে গেছে বরুমতি বাদে। পাশে অন্য সেতুর কাজও শেষের পথে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কটির পুরোটাই দুই লেনের। ফলে ছয় লেনের সেতুর সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেকদিন।
কক্সবাজারে আগে শীতকাল ছিল পর্যটন মৌসুম। এখন শীত– গ্রীষ্ম– বর্ষা সময়ই পর্যটকে ভরা থাকছে কক্সবাজার। টানা দুই– তিন দিন সরকারি ছুটি থাকলে লাখো পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কক্সবাজারে পর্যটকদের ভোগান্তি–দুর্ভোগের কথা পত্র–পত্রিকায় হরহামেশা যেভাবে আসছে তাতে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পর্যটকের চাপ দেখলেই হোটেল– মোটেল মালিকরা রুমভাড়া দুই– তিনগুণ বাড়িয়ে দেন, খাবার হোটেলগুলো গলাকাটা দাম আদায় করে। এতে করে কক্সবাজার পর্যটক বান্ধব নয়–এমন প্রচারণাটা জোরদার ভিত্তি পাচ্ছে। কক্সবাজারে অনেক সংগঠন পরিবেশ রক্ষাসহ নানান সামাজিক আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আপনারা উদ্যোগ নিন পর্যটক হয়রানি বন্ধে। প্রশাসনের সহায়তায় ব্যবসায়ী সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি– পেশার মানুষকে সাথে নিয়ে পর্যটকদের দুর্ভোগ– দুর্দশার কারণসমূহ দূর করার ব্যবস্থা নিন। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক সমাগম হলেও যেন থাকা–খাওয়ার ন্যূনতম সুযোগটি সবাই পান তা সামাজিকভাবে নিশ্চিত করুন। মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ যানবাহনে হয়রানি বন্ধে প্রশাসনের উদ্যোগে সামাজিক সহায়তা নিশ্চিত করুন। কক্সবাজার আমাদের প্রিয় শহর, প্রাণের শহর। এই পর্যটন নগরী হোক সবদিক দিয়ে পর্যটক বান্ধব– এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।