বহুমাত্রিক বৈষম্য দূর করা জরুরি

| শনিবার , ১৬ জুলাই, ২০২২ at ৬:৪৩ পূর্বাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে বহুমাত্রিক বৈষম্য বাড়ছে। সুপেয় পানির ঘাটতি, পর্যাপ্ত স্যনিটেশন বা অন্য সুযোগ-সুবিধায় পিছিয়ে পড়ছে বিশেষ কিছু জনগোষ্ঠী। এ শ্রেণির উন্নয়নে কার্যক্রম শক্তিশালী করা হচ্ছে। এ জন্য অর্থনীতিকেও বহুস্তর বিশিষ্ট হতে হবে। ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা : সুবর্ণজয়ন্তীতে ফিরে দেখা’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। ড. মসিউর রহমান বলেন, বিনিয়োগ যতটা হতাশাজনক বলা হয় পরিস্থিতি ততটা হতাশাজনক নয়। চীনের তুলনায় একটু কম হলেও অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় স্বস্তিদায়ক অবস্থানে বাংলাদেশ। শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে মূলত ক্যাপিটাল ইনপুট বাড়ার কারণে। তবে কৃষিখাতে মৌসুমি শ্রমিকের ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের প্রসার ঘটানো হচ্ছে। তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের রূপান্তরের ক্ষেত্রে দক্ষতা ঘাটতি রয়েছে। বিশেষত গ্রাম থেকে শহরে যাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার বেশ ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে দেশে চলমান দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতিহীনতা রয়েছে।
অন্যদিকে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে বহুমাত্রিক বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। এটা দূর করা জরুরি। উৎপাদন ও রপ্তানি খাতে এ বৈষম্য আছে। দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এ বৈষম্য আর দেখতে চায় না। বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেন, কোভিডের আগে নগর দারিদ্র্য ছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রথম লকডাউনে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ শতাংশ, দ্বিতীয় লকডাউনে কমে দাঁড়ায় ৩২ শতাংশ, ওমিক্রনের সময় এটা আরও কমে নামে ২১ শতাংশে। বর্তমানে করোনার সেই শঙ্কা নেই। নগর দারিদ্র্য এখন কমে হয়েছে ১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে মার্চ-এই তিন মাসে দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৬২১; অর্থাৎ দেশে প্রতি মাসে গড়ে ৫৪০ জনের বেশি সংখ্যায় নতুন কোটিপতি তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, করোনায় দেশে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। তবে অন্য একাধিক প্রতিষ্ঠানের তথ্যে সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ার এ হার আরও অনেক বেশি। তো, করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা প্রভৃতি কারণে দেশের মানুষের আয় কমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতেও কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক এবং এমনটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে নব্য কোটিপতিদের চাপে পিষ্ট হতে হতে আয়-হারানো মানুষদের মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা দিন দিন আরও বাড়বে। এদিকে বিবিএসেরই তথ্য, ১৯৭২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ৩৬ বছরে দেশে কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে ১৯ হাজার ১৫৮ জন, আর ২০০৮ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১২ বছরে তা ৭৪ হাজার ১২৭ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০ জনে; অর্থাৎ ৩৬ বছরে যতজন বেড়েছে, ১২ বছরে বেড়েছে তার প্রায় ৫ গুণ।
আবু তাহের খান তাঁর এক লেখায় কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, দেশ অধিকতর সম্পদশালী হয়ে উঠছে বলেই কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিরই পরিচায়ক। এখন কথা হচ্ছে, ১ লাখ কোটিপতি বা তার কাছাকাছি পর্যায়ের আরও কয়েক লাখ মানুষের আয়-উপার্জনের গড়ে ২০৩১ সাল নাগাদ মধ্যম আয়ের দেশ হয়তো হওয়াই যাবে। কিন্তু দেশের ৪২ শতাংশ মানুষকে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় রেখে এ অর্জন কি আসলেই উদযাপনযোগ্য হয়ে উঠতে পারবে? উল্লিখিত কোটিপতি ও তার নিকট-সহযোগীদের আরও বেশি করে সুবিধা ও প্রণোদনাদানের রাষ্ট্রের বর্তমান নীতিমালার আওতায় উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের হারটি হয়তো ঠিকই টিকে যাবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে খাওয়া কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ তাতে বাঁচবে কেমন করে এবং এতে করে তাঁদের জীবন-জীবিকা কতটাই-বা ন্যূনতম প্রয়োজন ও মানবিক চাহিদা পূরণ করে চলতে পারবে, স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে ওঠা তো পরের কথা!
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘দেশে বৈষম্যের মাত্রা বর্তমানে যে হারে বাড়ছে, তাতে মনে হতে পারে, এ থেকে শিগগির মুক্তি পাওয়ার হয়তো কোনো উপায়ই নেই। বর্তমান ব্যবস্থা না পাল্টালে সম্পদের বিদ্যমান বণ্টন প্রক্রিয়া থেকে ভিন্নতর সিদ্ধান্ত না পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টিকে আশাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা যদি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং সংবিধানের অঙ্গীকার ও বাধ্যবাধকতার দিকে তাকিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি মমতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দানের অগ্রাধিকারগুলো সে অনুযায়ী বদল করতে সম্মত হন, তাহলে খুব সহজেই বিষয়টির সমাধান হয়ে যায়।’ তাই যে বিষয়গুলো বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভূমিকা রাখছে, সেগুলোর নিরসনের চেষ্টা চালানো দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে