বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ৩ মে, ২০২১ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

একজন মানুষের কতটুকু জমির প্রয়োজন
করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় লকডাউন আরো সাতদিন বৃদ্ধি করা হয়েছে। অফিস আদালতসহ অনেকের কর্মক্ষেত্র বন্ধ। করোনার কারণে আমি ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতে পারছি না। চট্টগ্রাম শেভরন হাসপাতালে চক্ষু বিশেষজ্ঞকে ফোন করি। উনি বললেন লকডাউনের জন্য হাসপাতাল বন্ধ। ৫ মে লকডাউন শেষ হলে পরের দিন আমাকে যেতে বলেছেন। অবসাদ, বিষণ্নতা, অনিশ্চয়তা আমাকে গ্রাস করছে। চিকিৎসার অভাবে আমি বিপদে পড়তে যাচ্ছি কিনা তা জানি না। যখন এরকম দুশ্চিন্তার মধ্যে ডুবে ছিলাম তখন আমার মজিদের কথা মনে পড়লো। মজিদ এক কল্পিত নাম। অনেকদিন আগের কথা। একদিন মজিদ আমাকে বললো যারা মাদক সেবন করে তারা জানে এতে মৃত্যু ঝুঁকি আছে। পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মাদক ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে দিচ্ছে। তবুও মাদকের বিস্তার কমছে না। এরকম কেন হয়? আমি তাকে বললাম মাদক নিয়ন্ত্রণ করে মাফিয়ারা। মাফিয়াদের অনেক টাকা। মাদক যুদ্ধে মাফিয়ারা জিতে কারণ স্টাবলিস্টমেন্টের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তারা ওঁৎ পেতে বসে থাকে। আর যে মানুষ জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়, আর্থিক সংকটে থাকে, সামাজিক অন্যায়ের শিকার হয়, বৈষম্যের শিকার হয়, শোষণে শোষণে জর্জরিত হয় সে মাদকের কাছে আত্নসমর্পণ করে। মানুষ মাদকের দাস হয়ে যায়। মজিদ বললো মাদক না হলেও অন্য একটি জিনিসের নেশা আমার ভিতরে আছে। আমি বললাম সেটা কি? সে বললো জমি। আমি হাজার হাজার বিঘা জমির মালিক হতে চাই।
১৯৮০ এর দশকের প্রথম দিকে আমি চট্টগ্রাম শহরের একটি সরকারি কলেজ থেকে পটিয়া সরকারি কলেজে বদলী হই। কালুরঘাটের ব্রীজ হয়ে পটিয়া যেতে হতো। আমার আগ্রাবাদের বাসা থেকে বাসে নিউ মার্কেট, নিউ মার্কেট থেকে আরেক বাসে কালুরঘাট গিয়ে পটিয়ার বাস ধরতাম। মাঝে মাঝে ব্রীজ বন্ধ থাকলে নৌকায় নদীটি পার হতাম। যাওয়া-আসা কষ্টদায়ক ছিলো। একদিন বিকেলে পটিয়া থেকে আসার সময় বাসে উঠি। বাসের সহকারী আমাকে একটি খালি আসনে বসায়। ঐ বাসে একটিই খালি আসন ছিলো। আমার পাশের যাত্রীটিকে দেখলাম। তার শরীর লম্বা, মুখ বেশ বড়ো, পরনে একটি প্যান্ট, গায়ে টি-শার্ট, পায়ে হালকা স্যান্ডেল। সে আমাকে বললো আমার নাম মজিদ। আমি একটি রিক্রুটিং এজেন্টে চাকরি করি। আমার কোম্পানী জাহাজে নাবিক সরবরাহ করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনায় আমাদের অফিস আছে। অফিসের কাজে আমি কঙবাজার গিয়েছিলাম। সেখান থেকে সাতকানিয়া আসি। এখন চট্টগ্রাম শহরে ফিরে যাচ্ছি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি একজন মাষ্টার। আচ্ছা বলেন তো আপনার কয়টি প্লট আছে? আপনার কয়তলা বাড়ি আছে? আমি বললাম, আমার প্লট এবং বাড়ি নাই। পৈত্রিক বাড়ি আছে। আমি সরকারি ঘরে থাকি। মজিদ বললো আপনারা দেড় দুই হাজার টাকা বেতনের মাস্টার, আপনাদের থাকা আর না থাকা কি? আমি খুব অপমানিত বোধ করলাম কিন্তু তাকে কিছু বললাম না। এটা সত্য যে আমি ১৯৭৪ সালে ৪৭৫ টাকা মাসিক বেতনে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করি। এবার মজিদ বললো আমার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুইশোটি প্লট আছে। বান্দরবানের আলী কদম এলাকায় কয়েক হাজার একর জমি লীজ নিয়েছি। চকরিয়াতে মাছের ঘের আছে। অষ্ট্রেলিয়াতে লোক পাঠিয়েছি কৃষি জমি কিনে একটা বিশাল খামার করতে চাই। কানাডার বেগম পাড়ায় আমার লোকেরা বাড়ি কিনে তা ভাড়ায় লাগানোর কাজ করছে। মাদকের নেশার মতো আমার জমি এবং প্লটের নেশা আছে।
বাস পাঁচুরিয়ার কাছাকাছি চলে এসেছে, বাসের হেলপার এসে বলে স্যার আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে? বাস যখন বিরতিতে থামে তখন ড্রাইভারও এসে খোঁজ খবর নেয়। সে বলে আপনি আমাদের বাসে উঠেছেন এটা আমাদের সৌভাগ্য। গ্রামের লোকেরা শিক্ষকদের সম্মান করে। এইসব দেখে মজিদ বলে অল্প বেতনের মাস্টারদের এতো কদর? এইজন্য আমি আমার বড়ভাইকে ঘৃণা করি। আমি বললাম, তোমার বড় ভাইয়ের সাথে বিরোধ চলছে? সে বলে উনি আমার সাথে বিরোধ করেন না। কিন্তু মানুষ উনাকে সম্মান করে এটা আমার সহ্য হয়না। শিক্ষকের আবার সম্মান কি? আমি উনাকে আমাদের পৈত্রিক জমিজমা থেকে উৎখাত করেছি। এটুকু বলে মজিদ থেমে যায়। এবার সে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করে।
মজিদ আমাকে বলে একদিন সে তার গাড়ি নিয়ে লালখান বাজার দিয়ে যাচ্ছিলো। ড্রাইভার গাড়ী থামিয়ে নীচে নামে। সে বলে গাড়ি আর সামনের দিকে যাবে না। পেরেক ঢুকে গাড়ির চাকা ছিদ্র হয়ে গেছে। মজিদ বললো, তুমি চাকাটা খুলে ছিদ্র সারিয়ে নিয়ে আসো। আমি একটা দোকান থেকে চা খেয়ে আসি। গাড়িতে একটি বড়ো আকারের সুটকেস ছিলো। মজিদ ড্রাইভারকে বললো গাড়ি লক করে রেখো। সুটকেসের দিকে নজর রাখো। মজিদ পাশের চায়ের দোকানে ঢুকে একটি চেয়ারে বসে চায়ের অর্ডার দেয়। তার সামনে আরেকজন লোক বসা ছিলো। লোকটি বললো, মজিদ, তুমি আমার মুখের দিকে তাকাও। মজিদ তার মুখের দিকে তাকায়। লোকটি বললো, কিছু দেখতে পাচ্ছো? মজিদ বললো কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। কিন্তু তোমার কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি আমার নাম জানলে কি করে? লোকটি বললো পেরেক দিয়ে তোমার গাড়ির চাকা ছিদ্র করার পেছনে আমার হাত আছে। আমিই তোমাকে প্রভাবিত করেছি এখানে আসার জন্য। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তুমি একজন আল্লাহর অলির ছবি দেখতে পাচ্ছো না? লোকটি আরো বললো, তুমি খুব সাবধানে থাকবে। যদি কখনো ‘‘র” আদ্যক্ষরের কোন মানুষ তোমাকে ফোন করে তাহলে বুঝবে সেদিন থেকে তোমার বিপদ শুরু হয়েছে, বলেই লোকটি বাহিরের দিকে চলে যায়। মজিদ কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকে। তারপর চা খেয়ে গাড়ির কাছে চলে আসে। এসে দেখে গাড়িতে তার সুটকেস নাই। মজিদের প্লট এবং জায়গা জমির দলিলের ফটোকপি ঐ সুটকেসে ছিলো। সুটকেসটি কোথায়? ড্রাইভার বললো একজন লোক এসেছিলো এবং সুটকেসটি দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করলো। সে বললো আপনি নাকি তাকে পাঠিয়েছেন সুটকেসটি নিতে। মজিদ মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো।
মজিদ যখন এইসব ঘটনা আমাকে বলছিলো, তখন আমি খুবই বিরক্তবোধ করছিলাম। এইসব শুনে আমি কি করবো? আমি মজিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাস থেকে নেমে যাই। অন্য বাস ধরে বাসায় চলে আসি। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে আমি চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছি। এখন আমার আর তেমন কোন কাজকর্ম নাই। কিছুদিন ধরে ঢাকায় আমার ছেলের বাসায় ছিলাম। একদিন ছেলে আমাকে বেড়ানোর জন্য গাজীপুর জাতীয় উদ্যানে নিয়ে যায়। তারা যখন ময়ুরের সাফারীতে ঘোরাঘুরি করছিলো আমি একটি দেবদারু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি মজিদ আমার সামনে। আমি অবাক হয়ে বলি, মজিদ তুমি? সে বলে অনেক বছর পরে দেখলেও আপনাকে চিনতে আমার কষ্ট হয়নি। মাষ্টারদের মনে হয় সম্মোহনী শক্তি আছে। আমার বড় ভাই একজন মাস্টার। তার নাম ড. মতিন। সে শিক্ষকতা শেষ করে এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছে। আমার বাবা গ্রামে অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক ছিলেন। ধান বিক্রি করা ছাড়া আর কোনভাবে উনার কাছে নগদ টাকা আসতো না। আমার ভাই-বোনের সংখ্যা বারোজন। আমার বড়ভাই পরিবারের সকলকে খুবই স্নেহ মমতার সাথে দেখাশোনা করতো। তার বেতনের সব টাকা আমাদের জন্য ব্যয় করতো। এটা আমার সহ্য হতো না। সে এতো দয়া দেখানোর কে? আমি আমার মা ও ভাইবোনদের কাছে সবসময় তার বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে কুৎসা রটনা করতাম। এলাকার মানুষদের কাছেও তার বিরুদ্ধে বলতাম। সে সব জানতো কিন্তু কখনো আমাকে কিছু বলতো না। আমি লেখাপড়ার ঘোর বিরোধী ছিলাম। মানুষের অমঙ্গল কামনা করা, অন্যের দুঃখ-কষ্ট দেখে আনন্দিত হওয়া, প্রতিশোধ পরায়ন হওয়া, মিথ্যাচার করা, গীবত করা আমার অভ্যাসের অংশ ছিল। আমার বড়ভাই ড. মতিন একজন ভালো মানুষ হিসেবে সবার কাছে প্রিয় ছিলো কিন্তু আমি তাকে সকল প্রকার পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছি। আমার জমির নেশার ব্যাপারে তো আপনি জানেন। আমি তাকে বললাম, তুমি বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হয়ে খুশিতে আছো তো? সে বললো না। রুমা চৌধুরী নামে একজন মেয়ে আমাকে ফোন করেছে। বলেছে, উনি এনবিআরে চাকুরি করেন। আমার জমি জমার ব্যাপারে উনি খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সহসা আমাকে উনাদের অফিসে ডাকবেন। তখন আমার অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে গেলো। মজিদের সাথে দেখা হওয়া চায়ের দোকানের লোকটি ‘র আদ্যাক্ষরের একজন লোকের কথা বলেছিলো। আমার মনে হচ্ছে মজিদ তখন থেকেই নজরদারীতে ছিলো। মজিদ আমাকে বললো, আমার জমির নেশা কখনো যাবে না। অল্প বেতনের মাস্টারদের আমি কখনো মর্যাদার আসনে বসাতে পারবো না। আমি মনে মনে বললাম, আফসোস, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।
তারপর আরো অনেক বছর কেটে গেছে। আমি জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষক আছেন যারা সকলের কাছে সম্মানিত। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদেরকে আল্লাহর অলিতুল্য বলে মনে করেন। এখন আমি বাসা থেকে বের হতে পারিনা। করোনার চাপে জীবন অতিষ্ঠ। লোকজনের সাথে আমার তেমন কোন যোগাযোগ নাই। টেলিফোন সেটটিও বাজেনা। টেবিলের উপরে পড়ে থাকে। একরাতে হঠাৎ টেলিফোন সেটটি বেজে উঠলো। আমি ধরলাম। ও-মা, ওপ্রান্তে মজিদ। সে বললো আমি বিপদে পড়েছি। আমি বললাম, কি বিপদ? সে কাঁদতে কাঁদতে বললো, মধ্যরাতে হঠাৎ আমার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। আস্তে আস্তে আমি সব ভুলে যেতে শুরু করি। এখনো আমি কোনকিছুই মনে করতে পারছি না। শুধু আপনার নামটাই আমার মনে জ্বলজ্বল করছে। তাই আপনাকে ফোন করেছি। আপনি বলুন, আমি কে? আমার নাম কি? (চরিত্রগুলি কাল্পনিক)।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্মমতার আরেক ইতিহাস মুজাফফরাবাদ হত্যাকাণ্ড
পরবর্তী নিবন্ধসাতকানিয়া ও কুতুবদিয়ায় বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যু