বস্তাবন্দি লাশ মিলল নিখোঁজ আয়নীর

স্বজনদের সাথে শিশুটিকে খুঁজছিল খুনি সবজি বিক্রেতা রুবেলও ।। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে সহপাঠীদের মানববন্ধন

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ৩০ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

শিশু বর্ষাআয়াতের নির্মম পরিণতির তালিকায় সর্বশেষ নাম সংযোজিত হলো আবিদা সুলতানা আয়নী ওরফে আঁখিমণির (১০)। গতকাল বুধবার ভোর রাতে আয়নীর বস্তাবন্দি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নগরের দক্ষিণ কাট্টলী মুরগী ফার্ম এলাকার আলম তারা পুকুর পাড় থেকে লাশটি উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম। এক সপ্তাহ আগে পাহাড়তলী এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিল আয়নী। তার খোঁজ না পেয়ে মঙ্গলবার আদালতে অপহরণের মামলা করেছিলেন তার মা বিবি ফাতেমা। মামলায় আসামি করা হয়েছিল স্থানীয় বাসিন্দা মো. রুবেলকে (৩৫)। রুবেল ওই এলাকার সবজি বিক্রেতা। তাকে আটক করার পর তার দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আয়নীর লাশ উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছে পিবিআই। গতকাল বুধবার ভোরে সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়তলী এলাকার কাজীর দীঘির নূর ভবনস্থ হুদা মিয়ার ভাড়া বাসায় মা বিবি ফাতেমার সঙ্গে থাকতো আয়নী। তিন মাস আগে স্বামী আবুল কাশেমের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মেয়েকে নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে চলে আসেন আয়নীর মা বিবি ফাতেমা। চট্টগ্রামে আসার পর নগরীর পাহাড়তলীর সরাইপাড়া হাজী আব্দুল আলী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে তাকে ভর্তি করিয়ে দেন মা বিবি ফাতেমা। সংসার চালাতে স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন বিবি ফাতেমা।

পিবিআই সূত্রে জানা যায়, সবজি বিক্রির সুবাদে রুবেলের সঙ্গে পরিচয় ছিল আয়নীর নানী বিবি খাদিজার। গত ২০ মার্চ ওই এলাকায় একটি বিড়ালের বাচ্চা ধরতে গিয়ে রুবেলের ভ্যানগাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে আয়নীর। সবজি বিক্রেতা রুবেল তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে ওই শিশু বিবি খাদিজার নাতিন। আয়নীর সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথা বলে রুবেল, যা পরে সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে। আয়নীর বিড়াল প্রীতিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ফাঁদ পাতে রুবেল। শিশু আয়নীকে বোনের বাসা থেকে বিড়ালের বাচ্চা এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ঘাতক রুবেল ২০ মার্চ।

পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস হোসাইন আজাদীকে জানান, এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক রুবেল কাজীর দীঘি এলাকার বাসিন্দা। সেই এলাকায় ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করে। আটকের পর পিবিআই কর্মকর্তাদের রুবেল জানায়, পরদিন বিকালে শিশুটি বাসা থেকে বাইরে এলে বিড়াল ছানা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে রুবেল শিশুটিকে তার ভ্যানের পেছনে করে কাজীর দীঘি এলাকাতেই একটি ভবনের চতুর্থ তলায় নিয়ে যায়। যেটি তার খালা সম্পর্কিত এক জনের বাসা। বাসার সবাই বেড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু ওই বাসায় পোষা কবুতর থাকার কারণে সেগুলোর দেখাশোনার জন্য চাবি দিয়ে যায় রুবেলের কাছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রুবেল জানায়, ওই বাসায় নিয়ে রুবেল দরজা বন্ধ করলেই আয়নী ভয় পেয়ে যায়। রুবেল তাকে প্রথমে প্রলোভন এবং শেষে ভয় দেখায়। শিশুটিকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। ওই সময় চিৎকার করে দরজা খুলে বাসা থেকে বের হবার চেষ্টা করলে তাকে ভয়ভীতি দেখায় এবং বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য হুমকি দেয়। পরে জানাজানির ভয়ে ‘শ্বাসরোধ করে হত্যা করে’ শিশুটিকে। পরে বালিশ চাপা দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং লাশ রেখে বাসার নিচে নেমে আসে। বিকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে শিশুটিকে খুন করা হয়। কিন্তু লাশ গুম করে রাত সাড়ে নয়টার দিকে।

এদিকে নাতনীর খোঁজ না পেয়ে আয়নীর দাদি তাকে খুঁজতে বের হয়। রুবেলকেও ফোন করে। কারণ আশেপাশের মানুষ জানিয়েছে, শিশুটিকে রুবেলের পেছন পেছন যেতে দেখা গেছে। ফোন পেয়ে রুবেল আকাশ থেকে পড়ার ভান করে ছুটে আসে। আয়নীর দাদির সাথে সেও খুঁজতে থাকে এবং বারে বারে আশ্বস্ত করে যে আয়নীকে সে যেকোনো ভাবে খুঁজে বের করবেই। রাস্তার আশেপাশে সিসিটিভি দেখিয়ে বলে, ফুটেজ দেখে বোঝা যাবে আয়নী কোথায় কার সাথে গেছে।

২১ মার্চ রাত নয়টার দিকে লোকজন কমে গেলে রুবেল ভ্যান নিয়ে আবার সেই বাসায় যায়, যেখানে শিশুর মরদেহ লুকিয়ে রেখেছিল। সেখান থেকে লাশটি বস্তায় ভরে আলমতারা পুকুর পাড় এলাকার ডোবায় ফেলে আসে। কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না। তাই লাশ ফেলার তিন দিন পর রুবেল আবার সেখানে যায়। লাশের বস্তাটি দেখা না যাওয়ার জন্য তার উপর কিছু খড়কুটো দিয়ে আসে।

রুবেলের মনে সন্দেহ ছিল, বস্তায় ভরে ফেললেও, পরনের কাপড় দেখে আয়নীকে চিনে ফেলতে পারে। তাই বস্তায় ঢুকানোর আগে, রুবেল তার কাপড় খুলে অন্য একটি লাল থলেতে নেয়। যে স্থান থেকে লাশ উদ্ধার করা হয় সেখান থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে নালার মধ্যে থলেটি ফেলে দেয় সে। বুধবার ভোরে রুবেলকে নিয়ে লাশ উদ্ধারের পর তল্লাশি চালিয়ে পাহাড়তলী পোর্ট কানেক্টিং সড়কে কলকা সিএনজি স্টেশনের পাশের একটি খাল থেকে শিশুটির কাপড় ও জুতা উদ্ধার করা হয়।

পিবিআই মেট্রো এসপি নাইমা সুলতানা জানান, আমাদের কাছে গত বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) থানার সাধারণ ডায়েরির অভিযোগ পত্রটি হাতে আসে। এরপর আমরা ফিল্ডে যাই। রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজগুলো নিয়ে প্রায় দুইতিনদিন পর্যবেক্ষণ করি। তাকে যে গলি দিয়ে নেওয়া হয়েছে সেদিকে কোনো সিসিটিভি নেই। এটা রুবেল আগে থেকেই জানত। আমরা তখন রুবেলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করি। সে সারাদিন কোথায় কি করেছে সেগুলোর বর্ণনা দেয়। এক পর্যায়ে সে আমাদের জানায় বিকেলে তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিয়েছিল। তখন আমাদের সন্দেহ হয়।

কারণ একজন সবজি বিক্রেতা দুই ঘন্টা ধরে কোনো চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে পারে না। এরপর আমরা ওই চায়ের দোকানে গিয়ে দোকানদার আলী সওদাগরকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তিনি রুবেলের দুই ঘন্টা থাকার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে না পারলেও আমাদের এটা জানিয়েছেন যে রুবেল তাকে আয়নীর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ জানিয়েছিল পাঁচটার দিকে। এতে আমাদের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। স্বপ্রণোদিত হয়ে কথাটা সে বলার কথা নয়। এরপর তাকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে শিশুটিকে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করে হত্যার কথা স্বীকার করে। এদিকে গতকাল রুবেল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছে রুবেল।

আয়নীর লাশ যখন উদ্ধার করছিল পিবিআই, তখন মা বিবি ফাতেমার আর্তনাদে আশেপাশের মানুষের চোখেও জল জমেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বিবি ফাতেমা বলছিলেন, আমার জাদুরে ক্যান মারল? তিনি বলেন, আমার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই থানায় গিয়েছিলাম। পুলিশ যদি আমার মেয়েকে তখন খুঁজতোএই ঘটনা ঘটতো না। আমি মেয়েকে অনেক খুঁজেছি। রুবেলকে সন্দেহ করেছি। পুলিশ রুবেলকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমার আম্মু আরও আগে আমার বুকে ফিরে আসতো।

আয়নীর বাবা মো. আলম আজাদীকে বলেন, অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই থানার ওসির পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল। তারা এসে আসামিকে জিজ্ঞেস করে চলে গেছে। তার পরের দিন বাচ্চার মা থানায় গিয়ে এসআই দুলাল ও মনিরকে আবারও বলে। উল্টো তারা বলেছেআমার মেয়ে নাকি প্রেম করে। রুবেল নাকি ভাল ছেলে। নয়/দশ বছরের বাচ্চা মানুষ প্রেমের কী বুঝে? কোন কথা নাই, আমি রুবেলের ফাঁসি চাই। এদিকে বুধবার (২৯ মার্চ) দুপুরে আসামি রুবেলের ফাঁসি দাবি করে মানববন্ধন করেন আয়নীর সহপাঠীরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোজাদারকে ইফতার করানো পুণ্যময় আমল
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে শিক্ষার্থী পেটানোর ঘটনায় তদন্ত চেয়েছে আদালত